'মুসলমানদিগের শ্রেণিবিভাগ’ ও ব্রাহ্মণগণের অংশে কবিকঙ্কন মুকুন্দের সমাজচেতনার ভিন্নতর মাত্রা উপলব্ধ হয়— আলোচনা করো।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য সামাজিক পটভূমিতে সৃষ্ট। মুকুন্দরামের কাব্যের ‘গুজরাট নগর পত্তন’ অংশে কালকেতুর আদর্শ সমাজ গঠনের কথা পরিস্ফুট হয়েছে। সম্পূর্ণ শোষণ মুক্ত এক সমাজ সে গড়েছে। বলা বাহুল্য জমিদারের পীড়নে জর্জরিত মুকুন্দরাম কল্পনায় এক আদর্শ শোষণমুক্ত রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই কালকেতুকে দিয়ে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন।


গুজরাট নগর পত্তনের পর নানা জাতির নানাবৃত্তির বহুলোক সেখানে বসতি স্থাপন করে। ভালো-মন্দ দুই শ্রেণির মানুষের বাস। কলিঙ্গদেশ ছেড়ে এলো নানা জাতির মুসলমান। তাদের জন্য কালকেতু নগরের পশ্চিম ভাগে বসতির ব্যবস্থা করলো। মুসলমানদের মধ্যে আছে নানাপ্রকার বৃত্তিজীবী গোলা, জোলা, মুকেরি, পিঠারি, কাবাড়ি, গরসাল, সনাকার, হাজাম, তীরকার, কাবাজী, কলন্দর দেশাধি, দরজি, রংবেজ, কসাই ইত্যাদি, মুসলমানদের আচার ব্যবহার প্রসঙ্গে কবি বলেছেন—

“যার দেখে খালি মাথা    তার সনে নাহি কথা

সারিয়া চেলার মারে বাড়ি। 

আপন টোপর নিয়া   বসিল গাঁয়ের মিয়া

ভুঞ্জিয়া কাপড়ে পুছে হাত।”

এ উক্তির মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।


ডিহিদার মামুদ সরীপ ধর্মে মুসলমান হলেও কবি মুকুন্দরাম জাতিগতভাবে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিলেন না। তাঁর মনোভাব ছিল একান্ত অসাম্প্রদায়িক। এ জন্যেই তাঁর কল্পিত রাজ্যে স্থান দিয়েছেন, এবং এদের অনেকের সম্বন্ধে কবি সশ্রদ্ধ উক্তিও করেছেন-

“বড়ই দানিসবন্দ   না জানে কপট ছন্দ

প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ে।।”


অতএব গুজরাট নগরে মুসলমানদের বসতি স্থাপনে কবির সমাজ চেতনার বোধ ও অসাম্প্রদায়িকতার মনোভাবই ফুটে উঠেছে।


কলিঙ্গ রাজ্য প্রবল বন্যায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যাওয়ায় গুজরাটে দলেদলে এল বিভিন্ন গোত্র গোষ্ঠির পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির ব্রাহ্মণ। তাদের মধ্যে আছেন পণ্ডিত ও মূর্খ, যাজক ও অধ্যাপক, বারেন্দ্র ও রাঢ়ী, গৃহবিপ্র ও বৈষ্ণুব প্রভৃতি। এলো নানা জাতি–চন্দ্রবংশী, সূর্যবংশী, রাজপুত ও মল্লযোদ্ধা ; এলো নানা উপাধিকারি কায়স্থগণ। এলো গোপ, চাষি, কামার প্রভৃতি হিন্দুজাতি। একদা ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেখা যায়-

“মুর্খ বিপ্র বৈসে পরে   নগর যাজন করে

শিখিয়া পূজার অনুষ্ঠান।।”

কেহ দেয় চাল কড়ি   কেহ দেয় ডাল বড়ি

গ্রামযাজী আনন্দে সাঁততি।।”


কালকেতুর নগরে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ছিল এবং ব্রায়ণ ছাড়া অন্যান্য জাতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়-সমাজের পরিমণ্ডল চিত্রণে মুকুন্দরাম বাস্তবতাবোধ ও বিশ্বাস যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।