“কবিকঙ্কন মুকুন্দ বস্তুর কারবারি ছিলেন না, ছিলেন বাস্তবরসের স্রষ্টা।”— উদ্ধৃতি সহযোগে মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

মুকুন্দরামের বাস্তবতা বোধের পরিচয় বস্তুসঞ্চয়ে নয়, বাস্তবরসের পরিবেশন-নৈপুণ্যে। সর্বাগ্রে আমাদের মনে রাখাতে হবে, বস্তুর কারবারী ও বাস্তবরসের স্রষ্টা ঠিক এক নয়, বিশিষ্ট সমালোচকদের ভাষায় বলতে হয়— 'বস্তুপুঞ্জ হইতে বাস্তব রস নিষ্কাশন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পবোধ সাপেক্ষ। তাঁর কৃতিত্বের আরও এক কারণ হল বাস্তব তথ্যের সঙ্গে জীবনরসের, সাহিত্যের সত্যের সঙ্গে জীবনসত্যের এক অপূর্ব সমীকরণ দান করা। সঠিকভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই মুকুন্দরামের কাব্যে বস্তুধর্ম, রসধর্ম এবং আদর্শ একত্রে মিশ্রিত হয়ে তার জীবনের চরম সত্যকে প্রকাশ করেছে।


মুকুন্দরামের কাব্যে বাস্তবরস সার্থকভাবে পরিবেশিত হলেও তিনি বস্তুতান্ত্রিক কবি নন। জীবন অভিজ্ঞতায় উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি তাঁর কাব্যে বাস্তবকে রূপায়িত করেছেন এবং তা রসগ্রাহী ও হৃদয়গ্রাহীও করেছেন। 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে যেমন শরৎচন্দ্রের নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি হুবহু বর্ণিত হয়নি তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা উপন্যাসের রসোত্তীর্ণতার মূলে, সুকুন্দরামের কব্যেও ঠিক তেমনি। কালকেতু গুজরাট নগর পত্তন করে যখন বুলান মণ্ডলকে বলে—

“শুন ভাই বুলান মণ্ডল,

আইস আমার পুর   সন্তাপ করিব দূর

কানে দিব সোনার কুন্ডল।।

আমার নগরে বৈস   যত ইচ্ছা চাষ চষ

তিন সন বহি দিয়ো কর।”


তখন স্বভাবতই মামুদ সরিপের অত্যাচারে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত কবির বেদনা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শ ভূস্বামীর চিত্রাঙ্কনের কথাটি মনে পড়ে।


মূলত মুকুন্দরাম নানা রসের সংমিশ্রণে জীবনের ঘটনাবহুল কাহিনি রচনাতে সক্ষম হয়েছেন। এইভাবে কালকেতুর বীরত্বে ও দ্বিতীয় কাহিনীতে লহনা-খুল্লনার সপত্নী-বিবাদের মধ্যে তাঁর সাধারণ বাঙালির দাম্পত্যজীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বিভিন্নমুখী নারী চরিত্রের তিনি যে এত সুনিপুণ স্রষ্টা তার কারণ তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা। নারীচরিত্রের সবগুলি দিক তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং তাকেই তিনি তাঁর কাব্যের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করেছেন। সেই জন্যই তাঁর কাব্য লঘুভার কল্পনার পক্ষবিহারী না হয়ে বাস্তব জীবনের গুরুভারে মন্থরগামী হয়েছে।


চণ্ডীমঙ্গলে বাস্তবরস-স্ফুরণের আপেক্ষিক উৎকর্ষ ও প্রাচুর্যের কারণ—অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মানবিক রূপের মধ্যেই নিহিত। তা নাহলে ছদ্মবেশিনী চণ্ডীর ফুল্লরার গৃহে গিয়ে ফুল্লরার সপত্নী থাকার কথা প্রসঙ্গে তাঁকে বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হোত না। ফুল্লরার বারমাস্যা অংশে যে করুণরস উদ্ঘাটিত তা বড়ই বেদনাদায়ক,—

“যেদিন যতেক পায়   সেদিন তাহাই খায়

দেড়ি অন্ন নাহি থাকে ঘরে।"


কালকেতুর বিবাহ দৃশ্যে দেখা যায় কাহিনি ও আখ্যান বর্ণনার সাথে সাথে উপমা অলঙ্কার নির্মাণেও জীবন রসিক মুকুন্দরামের কৃতিত্ব।—

“সেই রব জুগরা কন্যা তোমার ফুল্লরা। 

খুঁজিয়া পাইল যেন হাঁড়ির মুঞের সরা।।”


বর কালকেতু যেন হাড়ির মতো, আর কনে ফুল্লরা যেন সরা, হাঁড়ির মুখ অনুযায়ী সরা না হলে যেমন মানায় না, এই কথা বলে কবি এসে পৌঁছলেন বস্তু পুঞ্জের জগৎ থেকে একেবারে রস—সাগরে।


অতএব বলা যায়, মুকুন্দরামের 'চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বাস্তবরস আসলে তাঁর জীবনরস রসিকতারই পরিচয়। বাস্তব রস পরিবেশনে তার দক্ষতাই তাঁকে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বিরল কৃতিত্বের শীর্ষশিখরে অধিষ্ঠিত করেছে।