বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত ব্রজবুলি ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করো।

বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্রজবুলি ভাষা

মৈথিলী বাংলা ও অবহট্ট ভাষার সংমিশ্রণে গঠিত এক কৃত্রিম অথচ মধুর সাহিত্যিক ভাষাতে বাংলা দেশে ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অসংখ্য মহাজন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তভাগে তরুণ রবীন্দ্রনাথও পদ রচনা করেন। এই কৃত্রিম ভাষাকে বলা হয় ব্রজবুলি। এই নতুন ভাষা শুনে পাঠক মনে করল যে রাধাকৃষ্ণ ব্রজে এই ভাষাতেই কথা বলতেন। এটি ব্রজের বুলি— তাই এর নাম ব্রজবুলি। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল।


আসলে ব্রজবুলি ভাষাতে মৈথিল, বাংলা এবং অবহট্ট শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে। এটি একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা।


এই ভাষায় প্রথম পদ রচনা করেন বিদ্যাপতি। পরবর্তীকালে সারা পূর্বাঞ্চলে এই সাহিত্যিক ভাষাকে অবলম্বন ক'রে নানা পদ রচনা করা হয়। বাংলায় ব্রজবুলিতে প্রথম পদ রচনা করেন যশোরাজ খান (“এক পয়োধর চন্দন লেপিত আর সহজেই গোরা।”) কিন্তু ব্রজবুলিতে শ্রেষ্ঠ পদকার হিসাবে বিদ্যাপিত অমর হয়ে আছেন। মিথিলার হয়েও ব্রজবুলিতে রচিত পদের জন্যই তিনি বাঙালী কবির মর্যাদা পেয়েছেন। চৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতি রচিত ব্রজবুলি পদ আস্বাদন করতেন।


যে সকল বাঙালী-কবি ব্রজবুলিতে পদ রচনা ক’রে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই গোবিন্দদাসের নাম উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া জ্ঞানদাস, বলরাম, দাস, শেখর প্রভৃতি কবিগণ ব্রজবুলিতে পদ রচনা ক'রে খ্যাতি লাভ করেন। গোবিন্দদাস ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনায় এমন দক্ষতা দেখিয়েছেন যে তাকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি আখ্যা দেওয়া হয়। যেমন—

ঘন ঘন বজর নিপাত।

শুনইতে শ্রবণে মরি যাত৷৷

দশ দিশ দামিনী দহন বিথার।

হেরইতে উচকেই লোচন তার।।


শেখর ব্রজবুলির পদে শিল্পোৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন। ব্রজবুলিকে অবলম্বন করে বৈষ্ণব পদাবলী সার্থকতার স্বর্গে উপনীত হয়েছে।


কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী কেবল ব্রজবুলি ভাষায় রচিত নয়। বাংলা ভাষা ও ব্রজবুলি ভাষা—এই দুই ভাষাতেই শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কবিগণ পদ রচনা করেছেন। গোবিন্দদাস জ্ঞানদাস শেখর ইত্যাদি যেমন ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছেন তেমনি অন্যদিকে চণ্ডীদাস খাঁটি বাংলা ভাষায় পদ রচনা ক’রে বিখ্যাত হয়েছেন।


এছাড়া মুরারি গুপ্ত, বাসুদেব ঘোষ প্রভৃতির রচনায় ব্রজবুলির নিদর্শন পাওয়া যায়। চৈতন্য পরবর্তীকালে গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, রায় শেখর ব্রজবুলি পদ রচনায় সার্থকতা লাভ করেছেন যে ভাবলে বিস্মিত হতে হয়—

যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

তাঁহ’ তাহাঁ বিজুরি চমকময় হোতি।

যাঁহা যাঁহা অরুণ-চরণ চল চলই। 

তাঁহাঁ তাঁ থল-কমল দল দলই।।

কিংবা

পাঞ্ছ নেহারিতে   নয়ন অন্ধায়ল

দিবস লিখিতে নখ গেল।

দিবস দিবস করি   মাস বরিষ গেল

বরিষে বরিষে কত ভেল।।

বাঙালী কবিগণ ব্রজবুলি ভাষা এত স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করেছেন যে মনে হয় ব্রজবুলি যেন মাতৃভাষা। তাছাড়া এই ভাষার শ্রুতিমাধুর্য এত অধিক যে তার একটি আকর্ষণ আছে।


জয়দেবের গীতগোবিন্দের ছন্দ যেমন রবীন্দ্রনাথের আবিষ্ট করেছে তেমনি ব্রজবুলির সুমধুর ধ্বনিঝংকার তরুণ রবীন্দ্রনাথকে ব্রজবুলিতে পদ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছে–

“মরণ রে তহুঁ মম শ্যাম সমান।”