কালিদাসের নাট্যপ্রতিভা আলোচনা করো।

কালের সীমা অতিক্রম করে মহাকবি কালিদাসের লেখনীপ্রসূত মালবিকাগ্নিমিত্রম্ বিক্রমোবশীয়ম্ ও অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ তিনটি নাটক আমাদের হাতে এসেছিল। নাট্যরচনায় কালিদাস তার অনুপম নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। দৃশ্যকাব্যের রচনাতে তাঁর জনপ্রিয় প্রতিভার ক্রমবিকাশ পরিলক্ষিত হয়। তিনটি নাটকেই শৃঙ্গার রসপ্রধান। আবার তিনটি নাটকেই নায়িকা-প্রধান। নায়িকা চরিত্রের পাশে নায়ক চরিত্রের তুলনায় আছে নিষ্প্রভ ও মলিন। নাটকের প্রতি চরিত্র সজীব এবং বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।


(১) মালবিকাগ্নিমিত্রম্ : নাট্যকার কালিদাসের দৃশ্যকাব্য সমূহের মধ্যে মালবিকাগ্নিমিত্রম প্রথম। ইহা সম্ভবত তার নবীন বয়সের রচনা। পঞ্চাঙ্গ পরিমিত এই নাটক মহাকবির পৃষ্ঠপোষক শৃঙ্গবংশীয় রাজা অগ্নিমিত্রের লাবণ্যময়ী মালবিকার প্রণয় কাহিনি নিয়ে রচিত। বিদিশার অধিপতি ছিল অগ্নিমিত্র। অন্য এক রাজ্যের রাজকন্যা মালবিকা দস্যুহস্তে পড়ে দৈবক্রমে বিদিশা রাজ্যের অন্তঃপুরে আশ্রয় নিয়েছে। অপূর্ব লাবণ্যবতী বালিকা মালবিকার চিত্র দর্শনে রাজা মুগ্ধ। সেই রূপবতী চোখে দেখার জন্য রাজা লালায়িত হয়ে পড়লেন। রাজার বিদূষক গৌতমের রমণীয় কৌশলে নায়ক ও নায়িকার সাক্ষাত ঘটল। কিন্তু উভয়ের প্রণয় নিবেদনের সুযোগ মিলছে না। প্রধানা মহিষী ধারিণী প্রতি অগ্নিমিত্রের মনোভাব অনুধাবন করে মালবিকাকে মানব কৌশলে অন্তঃপুরে রাখিতেছেন। কৌশলীকে গৌতম রাজকে সুযোগ দেবার জন্যে ছলনার আশ্রয় নিলেন। বিদূষকের সাহায্যে আনন্দ সুন্দরী মালবিকা লীলাচঞ্চল নৃত্যকলায় লিপ্ত হন। তরুর অন্তরালে থেকে রূপে মুগ্ধ রাজা মালবিকার নৃত্য ও ললিতকলা অবলোকন করেছেন। ইষৎ পরে দ্বিতীয় রানি ইরাবতি ঘটনাস্থলে এলেন। বরং মালবিকা ও অগ্নিমিত্রের গোপন প্রণয় দর্শনে রুষ্ট হয়ে প্রধানা মহিষী ধারিণীকে সকল ঘটনা বলিলেন। ঈর্ষার শ্রদ্ধা ধারিণী মালবিকাকে অন্তঃপুরের কারাগারে করলেন অবরুদ্ধা।


তাঁর স্বীয় অঙ্গুরীয়ক প্রদর্শন বিনা তার মুক্তি নেই। মালবিকার মুক্তির ভার গৌতম অবলম্বন করলেন অভিনব কৌশলে, গৌতম সর্পদ্রষ্ট হয়েছেন এই ভান করে ধারিণীর বিষনায়ক অঙ্গুরীয়টি হস্তগত করলেন। ধারিণীর ধরাবতীর অঙ্গতে সেই অঙ্গুরীয়কটির সহায়তায় মালবিকাকে মুক্ত করলেন। গৌতমের সহায়তায় সমুদ্রক গৃহে অগ্নিমিত্র ও মালবিকার হল পুনর্মিলন। ইতিমধ্যে সংবাদ এল মালবিকার পদস্পর্শে অশোকতরু হয়েছে পুষ্পিত। এই প্রণয় পূর্ণিবার জেনে ধীমতি ধারিণী স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য মালবিকাকে বিবাহিত রেখে সঞ্চিত করে অগ্নিমিত্রের হস্তে সমর্পণ করলেন। নায়ক-নায়িকার পরিপূর্ণ মিলনে নাটক হল পরিসমাপ্ত।


মালবিকাগ্নি মিত্র নবীন লেখকের রচনা হলেও রচনার পরিপাঠ্য ও সাবলিলতা দেখে মনে হয় না যে ইহা লেখকের প্রথম নাটক। নাটকের অন্যান্য চরিত্রে ঘটনা বিন্যাস নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি কালিদাসের নিজস্ব সৃষ্টি। প্রেম পূজারি কালিদাস এই নাটকে প্রেমের গতি ও বিলাসকেই সর্ব প্রসঙ্গে চিত্রিত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। সংস্কৃত সাহিত্যে প্রেমের নাটক হিসাবে মালবিকাগ্নি সত্যই একটি পরম উপাদেয় নাটক। নাটকের নাটকীয়তা ও বাস্তবধর্মীতা প্রকৃতি উপভোগ্য। হাস্যরসিকতায়, কৌতুকে, অভিনব কৌশল প্রয়োগে এবং শানিত বুদ্ধির মারপ্যাঁচে সহৃদয় অগ্নিমিত্রের বুদ্ধিমান বন্ধু হিসেবে বিদূষক গৌতম এই নাটকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছেন।


(২) বিক্রমোর্কশীয়ম্ : পাঁচ অঙ্কে রচিত কালিদাসের আর একখানি নাটক রাজা পুরুরবা ও অপ্সরা উব্বশী কাহিনি অবলম্বনে নাটকটি রচিত। পুরুরবা দস্যুর হাত থেকে ঊর্ধ্বশীকে উদ্ধার করেন এবং তার প্রতি আসক্ত হন। ইতিমধ্যে স্বর্গরাজ্যে লক্ষ্মী স্বয়ংবরা নাটকের অভিনয়ের জন্য ইন্দ্রিয়ের আমন্ত্রণে উব্বশী সর্গে গেলেন এবং এই বিরহ ব্যঞ্জনা হত পুরুরবা মর্মাহত হলেন।


লক্ষ্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণা উমনা উব্বশী অভিনয়কালে “পুরুষোত্তম” মহলে পুরুরবার নামকরণ করলেন, ফলে নাট্যাচার্য ভরতের অভিশাপে উৰ্ব্বশীকে স্বর্গ ভূমি ত্যাগ করে। মর্ত্য ভূমিতে আসতে হল। উব্বশীর গর্ভে পুরুরবার ঔরসে জাত পুত্রের দর্শনান্তে তিনি আবার-স্বর্গভূমিতে ফিরে আসতে পারবেন ইহাই ছিল অভিশাপের সৌধ। অপ্সরা উব্বশী পরম সুখে দিন কাটাতে লাগলেন।


কিন্তু রাজা প্রীতিরোষ বসত উৰ্ব্বশী স্ত্রীলোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ সত্ত্বেও প্রবেশের ফলে একটি লতায় রূপান্তরিত হলেন। উর্ধ্বশীর বিরহে পুরুববার প্রেমোন্মত্ততা এবং পরিশেষে উব্বশী পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হন। পুত্র আয়ুর জন্মের পরেই উব্বশী সুরলোকে প্রত্যাবর্তনের দিন সমাগত। দেবাসুর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার জন্য পুরুরবা ইন্দ্র কর্তৃক স্বর্গরাজ্যে আমন্ত্রিত হয়ে আজীবন উব্বশীর সঙ্গসুখ লাভে কৃতার্থ হলেন। প্রেমাতুর পুরুরবার উব্বশীর বিচ্ছেদজনিত মর্মস্পর্শী আর্তনাদ বহুলাংশে কৃত্রিম হলেও কাব্য সম্পদের দিক দিয়া ইহা অমূল্য। নাট্যকার সুকৌশলে বিয়োগান্ত কাহিনিকে মিলনাত্মক করে তুলেছেন। বিরত পীড়িত প্রেমিক পুরুরবার আত্মবিলাপের মধ্য দিয়ে অপূর্ব শোভন উব্বশীর প্রতি রাজার অনুরাগ যে কত প্রগাঢ় তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। কালিদাসের বর্ণনায় প্রতিফলিত হয়েছে সুন্দর ভাবে নারী হৃদয়ের প্রেমতৃষ্ণা।


(৩) অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ : কালিদাসের অনবদ্য সৃষ্টি ইহা তাঁর মহতী প্রচেষ্টায় শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে পাঠক সমাজে এত সমাদৃত।


সাত অঙ্কের দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বহুল প্রচলিত প্রণয় কাহিনি অবলম্বনে নাটকটি রচিত। ইহা কালিদাসের পরিণত ভাবনার সার্থক রূপায়ণ। প্রথম অঙ্কে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার সাক্ষাৎকার দ্বিতীয় অঙ্কে রাজা বিদূষকের সঙ্গে শকুন্তলা বিষয়ক কথোপকথন ও কণ্বশ্রেয়বাসী ঋষিগণ কর্তৃক রাজার নিকটে কতিপয় রাত্রি যাপন ও আশ্রমে আতিথ্য স্বীকার প্রার্থনা, তৃতীয় অঙ্কে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার মিলন। চতুর্থ শকুন্তলার পতিগৃহে স্থাপন। পঞ্চম অঙ্কে শকুন্তলার দুষ্মন্ত সমীপে প্রস্থান ও প্রত্যাখ্যান। ষষ্ঠ অঙ্কে রাজার বিরহ এবং সপ্তম অঙ্কে শকুন্তলার সঙ্গে পুনর্মিলন।


মালিনী নদীর তীরে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে মহর্ষি কণ্বের আশ্রম অবস্থিত। মহারাজ দুষ্মন্ত সুদূর বহির্গত হয়ে মালিনী নদীর তীরে এসে উপস্থিত। মৃগয়া তাঁর করা হল না। তিনি উদ্ভিন্ন যৌবনা শকুন্তলার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিখুঁতভাব লক্ষ্য করলেন। প্রণয়াসক্ত রাজা দেহজ কামনায় বশবর্তী হয়ে শকুন্তলাকে বিবাহ করলেন। দুষ্মন্ত শকুন্তলার সঙ্গে মিলিত হয়ে দাম্পত্য প্রেমের মধুরস আকণ্ঠ পান করলেন। কর্তব্যের তাগিদে দুষ্মন্ত কধাশ্রম ছেড়ে রাজধানীতে চলে গেছেন। পতির চিন্তায় তন্ময় হয়ে শকুন্তলা তার স্বাভাবিক সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেছেন। বাস্তব জগৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করবার অবসর তখন শকুন্তলার ছিল না। তাই যখন দুর্বাসার মতন একজন সুলভ ফেরৎ মহর্ষি—গণ্যমান্য অতিথি আশ্রমে উপস্থিত হলেন, তখন শকুন্তলার টনক নড়ল না। মহর্ষি দুর্বাসা উপেক্ষিত হলেন এবং তিনি দীপ্ত কণ্ঠে শকুন্তলাকে অভিশাপ দিলেন। “তুমি একমনে যাহাকে চিন্তা করিতেছ, তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলেও সে তোমাকে চিনতে পারিবে না।”


আসন্ন প্রসবাপতি বিরহে গৃহে যাত্রা করল। কিন্তু অভিশাপের ফলে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে না পেরে তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রত্যাখ্যাত শকুন্তলার বিরহিণীর বেশ ধারণ করে মারীচাশ্রমে দিন কাটাতে লাগল। পরে একদিন এক বীরের হাতে শকুন্তলার অঙ্গুলী ভ্রষ্ট দুষ্মন্তের নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়কটি পেয়ে শকুন্তলার কথা দুষ্মন্তের স্মৃতিপটে উদিত হতে লাগল। তিনি তাঁর পুত্র ভুল বুঝতে পেরে অত্যন্ত পরিত্যপ্ত হলেন। পরিশেষে একটানা বিরহ-যন্ত্রণা উপভোগের পর মারিচ আশ্রমে ভরত জননী শকুন্তলার পুনর্মিলন হল।


মহাকবি কালিদাসের নাট্য প্রতিভা ও কাব্য প্রতিভা গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমই এই দৃশ্যকাব্য অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ মর্ত্যের মালিনীর তার হাতে স্বর্গের সুর সভা পর্যন্ত এই নাটকের স্বর্গমর্ত্য ব্যাপী পরিব্যাপ্তিতে বিস্মিত হতে হয়। সঙ্গ নিসর্গ নরলোকে দেবলোক সবকিছুকে নিয়ে এই নাটকের প্রসার অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ কালিদাসের সর্বপ্রথম দৃশ্যকাব্য। তাই সহৃদয় সমাজের সদুক্তি “কালিদাসস্য সর্বস্বম অভিজ্ঞানমশকুন্তলম্‌” এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।


সংস্কৃত ভাষায় যত নাটক আছে অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ সেই সকল অপেক্ষা সর্বাংশে উৎকৃষ্ট। এই নাটকে সর্বাংশই সর্বাঙ্গ সুন্দর। ইহাতে হস্তিনাপুরের অধিপতি দুষ্মন্তের এবং ক্রান্তদর্শী কল্পনা শক্তির ও চিত্তহারিণী রচনা শক্তির পরকাষ্ঠা প্রদর্শিত হয়েছে। কবি তাঁর সকল সামর্থ্য ব্যয় করে শকুন্তলার সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয় অক্ষয় ভাণ্ডার অক্ষয় ভাণ্ডারী তিনি।


কালিদাস 'প্রেমের পূজারি। তাই তিনি প্রণয় রাজ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সম্রাট শিবকে তদীয় প্রণয় প্রধান গ্রন্থারম্ভে ভক্তিভরে প্রণতি জানিয়েছেন। কালিদাসের নিকট এই প্রেম বাধা-বাঁধন হারা নয়। এই প্রেমের গতিবিধি একান্ত সীমাবদ্ধ পরিধির মধ্যে সুকৌশলী নাট্যকার মহাকবি কালিদাস প্রেমকে তপস্যার অগ্নিতে শানিত, মার্জিত ও পরিশোধিত করবার জন্য এবং অভিশাপের পাবক শিখায় দুষ্মন্ত ও শকুন্তলাকে কলুষ মুক্ত করবার জন্য দুর্বাসার শাপের অবতারণা করেছেন। এই অভিশাপের ফলে ভোগসর্বস্ব দৈহিক প্রেম ভোগাতীত সত্তায় উন্নীত হয়েছেন। তপস্যা, সংযম ও নিষ্ঠা না থাকলে যে দেহ মধ্যস্থ প্রেম দেহাতীত প্রেমের পরিণতি হতে পারে না, রসিকজনের কান্ত কবি কালিদাসের সেই আবেদন এই নাটকে রেখেছেন। তার ফলে এই নাটকে প্রতিপন্ন আবেদন সর্বজনীন ও সর্বকালিক হয়ে উঠেছে।


“উপমা কালিদাসস্য"—তিনি উপমা প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। কালিদাসের নাটকে ব্যবহৃত ভাষা সরল ও অনাড়ম্বর। তাঁর রচনায় উপমা অলংকারের ছড়াছড়ি। তিনি যে শুধু যান্ত্রিকভাবে উপমা অলংকার ব্যবহৃত করেছেন তাই নয়, এই অলংকার প্রয়োগের মারফৎ তিনি সাহিত্য সৃষ্টির অনেকখানি কাজ সেরে নিয়েছেন। সেজন্য কালিদাসকে “ভারতের শেকসপিয়র" বলেও অভিহিত করা হয়। তাঁর রচনায় ব্যবহৃত সমাজবদ্ধ পদসমূহ তেমন দীর্ঘ নয়। শব্দচয়ন ও তার নাটকীয় বিষয়বস্তু মাফিক রয়েছে। তিনি ছন্দশাস্ত্রের প্রধান প্রধান ছন্দলিপিকে তার রচনায় স্থান দিয়েছেন। সুতরাং সর্বদিক দিয়ে বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যে, অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ তাঁর নাট্যাকৃতির চরম উৎকৃষ্ট।