অভিসার কাকে বলে তা ব্যাখ্যা করে এর বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো এবং এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকতার পরিচয় দাও।

অভিসারপর্যায়ের পদাবলীতে আধ্যাত্মিক গৌরবের সঙ্গে রোমান্টিকতা যুক্ত হওয়ায় এর আশ্বাসে এসেছে বৈচিত্র্য- আলোচনা করো।

অভিসারের অতুলনীয় কবি গোবিন্দ দাস। তার রচিত অভিসারের পদে প্রকৃতি মান আলোচনা করো।


নায়কের উদ্দেশ্যে নায়িকার কিংবা নায়িকার উদ্দেশ্যে নায়কের যে গমন তাকেই বলে অভিসার। বৈষ্ণব সাহিত্যে অভিসারের পদ এক অসামান্য প্রাণরসে সঞ্জীবিত। ইংরাজী সাহিত্যে অভিসার স্বতন্ত্র। সেখানে নায়ক নায়িকার উদ্দেশে অভিসার করেছে। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে ও সাহিত্যে নায়িকাই অভিসার করে নায়কের উদ্দেশে। কারণ ভারতীয় জীবনদর্শনে পুরুষ নিষ্ক্রিয় এবং প্রকৃতি সক্রিয়। তাই নারী পুরুষের নিকট অভিসারিকা। দুঃসহ দুঃখকষ্ট ও বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সে প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে অভিসারে গমন করে। এইভাবে সে আধ্যাত্মসাধনার বিজয় পতাকা উড্ডীন করে।


রবীন্দ্রকাব্যে অভিসারের তাৎপর্য সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে—

যে অভিসারিকা তারই জয়। 

আনন্দে চলেছে সে কাঁটা মাড়িয়ে। 

বাঞ্ছিতের আহ্বান আর অভিসারিকার চলা

পদে পদে মিলছে একই তালে। 

তাই নদী চলেছে যাত্রার ছন্দে,

সমুদ্র দুলছে আহ্বানের সুরে। (পুনশ্চ)


বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে অভিসারের প্রকৃতি বর্ণনা ক'রে বলা হয়েছে—

যাভিসারয়তে কাস্তং স্বয়ং ব্যাভিসরত্যপি।

সা জ্যোৎস্না তামসীযানযোগ্যা বেশাভিসারিকা।


নায়কের গমন কিংবা নায়িকার গমন অভিসারের লক্ষণ। তবে নায়িকার অভিসার অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দে রাধার অভিসারের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়—

রতি সুখসারে গতমভিসারে মদন মনোহর বেশম্।

ন কুরু নিতম্বিনি গমনবলম্বন মনুসর তৎ হৃদয়েশম্।।


পীতাম্বর দাস নায়িকার বিভিন্ন প্রকার অভিসারের কথা বর্ণনা করেছেন- জ্যোত্স্নাভিসার, কুঞ্ঝটিকাভিসার, তীর্থ্যাভিসার, উন্মত্তাভিসার, সঞ্চরাভিসার।


পদাবলী সাহিত্যে অভিসারের মত একটি লৌকিক বিষয়কে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে কবিগণ অলৌকিকতার পথে নিয়ে গেছেন। অন্যান্য সাহিত্যের মত বৈষ্ণবসাহিত্যে অভিসার লৌকিক নয়, ভগবৎ সাধনার একটি দুঃসাধ্য উপায় মাত্র। ঈশ্বর লাভের উপায়স্বরূপ অভিসার প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনের নানা কর্মবন্ধনে জড়িত মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে না। ভগবৎ সাধনার কথা ভাবতেও পারে না। এই সকল বন্ধনকে যতক্ষণ না ত্যাগ করা যায় তুচ্ছ করা যায় ততক্ষণ মন ঈশ্বরাভিমুখী হয় না। বাধার অভিসারের মধ্যে দিয়ে সাধনার সেই সুকঠিন স্তরটিকে অতিক্রম করার কথা বলা হয়েছে।


ঈশ্বর আমাদের অবিরত আকর্ষণ করেন। তাই সেই আকর্ষণে মানুষ ঈশ্বর অভিমুখে যাত্রা করে। তখন সে সমাজ ও সংসারের ভয় লজ্জা শাসন প্রভৃতি কিছুই গ্রাহ্য করে না। শীত, অন্ধকার, দুর্যোগ, অভিশ্রান্ত বর্ষণ, বিষধর সর্পভয় এই সকল বাধাবিঘ্ন জয় করে ভগবৎ সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশে গমন করতে সে এতটুকু দ্বিধা করে না। কারণ তখন তার সকল দেহবুদ্ধির বিলোপ ঘটে। এই সাধনায় জয়ী হলেই সে ভগবৎ সান্নিধ্য লাভ করবে। অলৌকিক অভিসার ভিন্ন মানুষ কখনও এত দুঃখকষ্ট সহ্য করে না। ঈশ্বরকে লাভ করতে হলে প্রবল দুঃখ জয় করতে হয়। দুঃখজয়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ হলেই ঈশ্বর পাওয়া যায়। অভিসার আমাদের এই শিক্ষা দেয়। আর বৈষ্ণবকবিগণ অভিসারের এই ব্যঞ্জনাটুকু নিয়ে সাহিত্য সাধনায় তৎপর হয়েছেন।


রাধার মাধ্যমে এই অভিসারের তত্ত্বটুকু উপস্থিত। তাই রাধাই অভিসার সাধনার মেরুদন্ড। সমাজ সংসারের সকল বাধাবিঘ্ন তুচ্ছ করে রাধা চলেছেন কৃষ্ণ অভিসারে। তার মন প্রাণ কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে ব্যাকুল। এই অভিসারের নিভৃত প্রস্তুতিটুকুও চমৎকার—

কণ্টক গাড়ি    কমল সম পদতলে

মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।

গাগরি বারি   ঢারি করি পিছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি৷৷


এ এমন প্রস্তুতি যে নিজের হাতের কঙ্কনের বিনিময়ে ওঝার কাছে ফণীমুখ বন্ধনের উপায় জানতে হয়। প্রস্তুতির পর সাজসজ্জা—রূপলাবণ্য সকল কিছুই কৃষ্ণের পায়ে উৎসর্গ করতে হবে। তাই রাধা অপরূপ সাজে সজ্জিতা হলেন—

নিরুপম কাঞ্চন রুচির কলেবর লাবণি বরণি না হোই।

নিরমল বদনে হাসরস পরিমলে মলিন সুধাকর অম্বরে রোই।।

রাধা সকল রূপ ও সজ্জা নিয়ে কৃষ্ণে আত্মসমর্পণের জন্য অভিসারে যাত্রা করেন।


গোবিন্দদাসের অভিসারের পদ: অভিসার পর্যায়ের পদে গোবিন্দদাসের কৃতিত্বই সর্বাপেক্ষা বেশী। তিনি অভিসারিকা রাধার অপূর্ব সুন্দর ভাবমূর্তি রচনা করেছেন। রাধা কৃষ্ণপদে নিবেদিতা। অভিসারের প্রস্তুতি, পরবর্তী পর্যায়ের সাজসজ্জা এবং শেষে অভিসার যাত্রা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তথাপি রাধা দেহকে উপেক্ষা করে অভিসার যাত্রা করেন। তাই গোবিন্দদাস বলেন—

ইয়ে যদি সুন্দরী তেজবি গেহ।

প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।


প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রাধা কেমন করে দয়িতের কাছে পৌঁছোবেন কবির মনে সেই প্রশ্ন—

সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।

হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।


কিন্তু ভক্ত যেখানে ভগবান আত্মলীন হতে চান সেখানে। প্রাণভয় তো তুচ্ছ। তাই রাধার কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনও বাধাই নয়—

কুল মরিয়াদ  কপাট উদ্‌ঘাটলু

তাহে কি কাঠকি বাধা।

নিজ মরিয়াদ    সিন্ধু মঞ্চে পঙারলু

তাহে কি তটিনী অগাধা।।

গোবিন্দদাসের পদে রাধার অভিসার অপূর্ব ভাবব্যঞ্জনা লাভ করেছে।


বিভিন্ন রসপর্যায়ের পদাবলীর মধ্যে অভিসার একটি বিশেষ মর্যাদা দাবী করতে পারে। কারণ এখানে মানসিক দিকটি এত বাস্তব যে তা আমাদের হৃদয়কে সহজে মুগ্ধ করে। আধ্যাত্মিক ভাবব্যঞ্জনা এখানে কাব্যরসাস্বাদে বাধা দেয় না। রাধা হৃদয়ের প্রস্তুতিটুকু যে অসামান্য সাধনার স্তর তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।