বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের অনুষঙ্গে 'মহাজন' শব্দটির অর্থ বল এবং জ্ঞানদাস বৈষ্ণব পদসাহিত্যের একজন বিশিষ্ট মহাজন' এই উক্তিটির সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত করো।

বৈষ্ণৰ পদকর্তা হিসাবে জ্ঞানদাসের কাব্যোকর্ষ

বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে জ্ঞানদাসকে শ্রেষ্ঠ বলা যায় না কিন্তু তিনি যে প্রধানদের মধ্যে একজন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একদিকের বিচারে অবশ্য জ্ঞানদাসের মাথাতেও রাজমুকুট বসানো চলে কারণ বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে একমাত্র তার রচনাতেই যেন আধুনিক মনের প্রতিফলন দেখা যায়। জ্ঞানদাস মধ্যযুগের কবি হয়েও কীভাবে যুগাতিশায়ী ভাবধারার অধিকারী হয়েছিলেন, তা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। এইদিক থেকে তিনি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের সমধর্মী।


জ্ঞানদাসের চৈতন্যদর্শন না ঘটলেও তিনি যে চৈতন্যের জীবৎকালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত হয়ে থাকে। অন্তত তিনি যে চৈতন্য পরিমণ্ডলেই লালিত পালিত‌ হয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জ্ঞানদাসের ব্যক্তিগত পরিচয় জানবার বিশেষ সুযোগ নেই। তাঁর সর্বজনস্বীকৃত পরিচয় সামান্য—সম্ভবত বর্ধমান জেলার কাদড়া গ্রামে ১৫৩০ খ্রিঃ এক ব্রাহ্মণ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ষোড়শ শতকের শেষভাগে নরোত্তম দাসের আহ্বানে যে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়, জ্ঞানদাস তাতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি নিত্যানন্দ-পত্নী জাহ্নবীদেবীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন পরে নিত্যানন্দ শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। নিত্যানন্দ-বিষয়ে রচিত জ্ঞানদাসের পদে প্রত্যক্ষদর্শীর পরিচয় পাওয়া যায়। ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার বলেন, “জ্ঞানদাসের নিত্যানন্দের ভাববর্ণনার পদগুলি দেখিয়া মনে হয়, কবি যেন নিজ চোখে দেখিয়া এগুলি লিখিতেছেন।"


চণ্ডীদাসকে অবলম্বন করে যে বিরাট চণ্ডীদাস সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে জ্ঞানদাসকে অবলম্বন করে তেমন কোনো জটিল সমস্যার সৃষ্টি না হলেও যে যথাকালে ঐরূপ সমস্যা দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তেমন আশঙ্কার কারণ রয়েছে। জ্ঞানদাসের রচিত পদের সংখ্যা বিষয়ে সমালোচকদের মধ্যে মতৈক্য নেই। জ্ঞানদাস রচিত একটি পালাগান ('যশোদার বাৎসল্যরস') আবিষ্কৃত হয়েছে— এর প্রামাণিকতা নিয়েও সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “জ্ঞানদাস নাম তখন এবং পরেও অনেকের নিশ্চয়ই ছিল। এবং তাঁহাদের মধ্যে কেহ না কেহ পদ রচনা করিয়া থাকিবেন।” অতএব জ্ঞানদাসকে নিয়েও ভবিষ্যতে সমস্যার আশঙ্কা রয়েই গেছে।


জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভার উৎকর্ষ:

জ্ঞানদাস বাংলা, ব্রজবুলি এবং বাংলামিশ্রিত ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন। সমসাময়িক যুগে কীর্তন গানের বহুল প্রচারের জন্যই হয়তো জ্ঞানদাস ব্রজবুলি ভাষায় এত পদ রচনা করেছিলেন। তার ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদের সংখ্যা বাংলা পদ থেকে অনেক বেশি হলেও উৎকর্ষে বাংলা পদগুলোই শ্রেষ্ঠ। অবশ্য ডঃ সুকুমার সেন জ্ঞানদাসের ভাষায় রচিত পদগুলোর উৎকর্ষ বিষয়ে সপ্রশংসভাবে বলেছেন, “. Jnana Das was the most careful writer of Brajabuli though there are a few poems where Brajabuli is greatly mixed up with Bengali."। কিন্তু গোবিন্দদাসের ব্রজবুলি পদের সঙ্গে অথবা জ্ঞানদাসের রচিত বাংলা পদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় একথা নিঃসন্দেহেই প্রতিপন্ন হবে যে জ্ঞানদাসের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে বাংলা ভাষাতেই। কাব্য-ধর্মের দিক থেকেও যেমন জ্ঞানদাসের ব্রজবুলি পদগুলি হীনপ্রভ, তেমনি ছন্দ এবং অলঙ্কার ব্যবহারেও তিনি গোবিন্দদাসের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। কোনো কোনো পদে কবির অস্তর স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হলেও অধিকাংশ পদেই যেন কৃত্রিমতাজনিত কিছুটা আড়ষ্টতাও পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ব্রজবুলি পদে বিদ্যাপতির অনুকরণই শুধু করেছেন, তার অতিরিক্ত কিছু করে উঠতে পারেননি। অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাংলার সঙ্গে ব্রজবুলির যে মিশ্রণ ঘটিয়াছে তাহার কারণ কবি convention বা প্রথার খাতিরে ব্রজবুলিতে পদ রচনা করিলেও তাহার মনের কথাটি কিন্তু বাংলা পদেই যথার্থ ধরা পড়িয়াছে। রসলোকের খাস দরবারে প্রবেশের জন্য তিনি বাংলা পয়ার-ত্রিপদীর চাবিকাঠি ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার ব্রজবুলিতে বুদ্ধির কৌশল, আবেগ, আস্তরিক কলানৈপুণ্য— সবই আছে, কবি যেন গজ কাঠি মাপিয়া মাপিয়া এই ব্রজবুলির পদগুলি রচনা করিয়াছিলেন। অবশ্য দুটি চারিটি পদের ব্রজবুলিতে স্বতোস্ফূর্ত ভাবাবেগ যে নাই তাহা নহে, কিন্তু কবি যেন এই জাতীয় পদে বেশ সুস্থ হইয়া নিজেকে পুরোপুরি সঁপিয়া দিতে পারেন নাই।... ব্রজবুলি তাঁহার কবিভাষা, প্রাণের ধাত্রী নহে।”


জ্ঞানদাস আপনাকে স্বচ্ছন্দভাবে প্রকাশ করবার সুযোগ পেয়েছেন বাংলা ভাষায় রচিত বৈষ্ণব পদগুলিতেই। ভাবে এবং ভাষায় এই জাতীয় অনেক পদই রসোত্তীর্ণ হয়েছে, এমন কি একালের বিচারেও তার কোনো কোনো পদ অসামান্য বলে অভিহিত হবার যোগ্যতা রাখে। মধ্যযুগের কবি জ্ঞানদাসের রচনায় আধুনিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গি লাভ এক আশ্চর্য ব্যাপার। এ দিক্ থেকে কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী এবং কবি ভারতচন্দ্রই শুধু তার সঙ্গে একাসনে বসবার যোগ্য জ্ঞানদাসের পদে আমরা আধুনিক মানব-মানবীর হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারি—সেকালের একজন কবির পক্ষে এ কম কৃতিত্বের কথা নয়।


শুধু বৈষ্ণব কবিতার উচ্চ ভাবকল্পনার প্রকাশ বলেই নয়, জ্ঞানদাস রচিত কতকগুলি পদের ভাষারীতিও লক্ষ্য করবার মতো। যেমন

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।'


একালের কোনো কবিও যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল' জাতীয় পদ রচনা করতে পারলে আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করতে পারেন। অত্যাধুনিক কোনো কবিও পুলকিত হয়ে উঠতে পারেন নিম্নোক্ত পদের মতো কোনো কবিতা রচনা করতে পারলেও—

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।। 

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।'


বিদ্যাপতি বা গোবিন্দদাসের মতো জ্ঞানদাস ভাষা শিল্প সম্বন্ধে এত সচেতনতার পরিচয় না দিলেও আলোচ্য পদগুলিতে ভাষা ও ভাবের হর-পার্বতী মিলন সাধিত হয়েছে। নিম্নোক্ত পদটিতেও‌ অনুরূপ শিল্পকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়—

‘দেইখ্যা আইলাম তারে সই দেইখ্যা আইলাম তারে। 

এক অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে।।'


পূর্বোদ্ধৃত জ্ঞানদাসের পদগুলোতে যে রোম্যান্টিক কবিমানসের পরিচয় পাওয়া যায়, বৈষ্ণব গীতিকাব্য-সাহিত্যেও তার তুলনা মেলা ভার। এইদিক থেকে বিচার করলে সম্ভবত জ্ঞানদাসের পদগুলোকে খাঁটি লিরিক কবিতার মর্যাদা দান করা চলে। রোম্যান্টিক মনোভাব সাধারণত একটু বিষণ্ণতার ধারা ঘেঁষে চলে বলেই জ্ঞানদাসের বিরহের পদগুলিও খাঁটি মানবিক আকৃতিতে সমৃদ্ধ।

‘রজনি শাঙন ঘন      ঘন দেয়া গরজন

রিমিঝিমি শবদে বরিষে।'

পদটি পড়বার পর মুগ্ধচিত্ত রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে একটা বিরাট পটভূমিকায় একটি উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছিল। কবিতাটিতে জ্ঞানদাস অত্যুৎকৃষ্ট চিত্র প্রতীকেরও সার্থকতম ব্যবহার দেখিয়েছেন।


জ্ঞানদাসের রোম্যান্টিক রহস্যপ্রিয়তার সঙ্গে মাধুর্যের স্বাদও যেন সর্বত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শব্দব্যবহার, প্রকাশরীতি, বর্ণনাভঙ্গি এবং ঘটনা সংস্থান রচনায় এই মাধুর্যগুণের প্রবেশ হয়েছে অবারিত সর্বত্রসঞ্চারী এই মাধুর্যগুণের জন্যই বিরহের তীব্রতা বা মর্মভেদী হাহাকার তাঁর রচনায় দুষ্প্রাপ্য। বেদনার মধ্যেও জ্ঞানদাস তত গভীরতা প্রকাশ করতে পারেন নি, তার মধ্যেও যেন একটা প্রশান্ত নিরাসক্তির ভাব লক্ষ্য করা যায়।


জ্ঞানদাসের কৃতিত্ব-অকৃতিত্ব বিচার করে অধ্যাপক শঙ্করীপ্রদাস বসু লিখেছেন, “ভাষা নির্বাচনে জ্ঞানদাসের মনোদুর্বলতাই কবিরূপে তাঁহার বাণীদুর্বলতার মূলে। অন্য যে সকল ব্যর্থতা আছে, যথা, কোনো কোনো রসপর্যায়ে প্রত্যাশিত সাফল্যলাভ না করা,—সেগুলিকে ব্যর্থতা না বলে সীমাবদ্ধতা বলাই ভালো। সীমাবদ্ধতা সব সময় দোষের নয়....সীমাবদ্ধতা নিবিড়তার সহায়ক। ….জ্ঞানদাস অনুরাগ, রূপানুরাগ, রসোগার ইত্যাদির শ্রেষ্ঠ কবি। নিবেদন, আক্ষেপানুরাগেও তাহার কৃতিত্ব আছে, যদিও আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাসীয় দুঃখ-নিবিড়তা তাহার অনায়ত্ত। এবং দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, নাপিতানী মিলন, বংশী-শিক্ষা ইত্যাদি পূর্ণ ও খণ্ড পর্যায়ে তাহার কবিত্বশক্তির প্রমাণ পাইয়াছি।”


জ্ঞানদাসের বিভিন্ন রসপর্যায়ে কৃতিত্ব:

বৈষ্ণব রসপর্যায়ের সর্ববিধ শাখায়ই জ্ঞানদাস বিচরণ করেছেন, কোথাও সার্থকভাবে, কোথাও বা ব্যর্থতাসহকারে। চৈতন্য ও নিত্যানন্দ বিষয়ে যে তিনি পদগুলি রচনা করেছেন, তার কোনো কোনোটিতে প্রত্যক্ষতার পরিচয় থাকলেও কবিপ্রতিভার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না। জ্ঞানদাস রাধাকৃষ্ণের পদেই অধিকতর সার্থকতা লাভ করেছেন। কিন্তু যেখানে তিনি বিদ্যাপতির অনুকরণ করেছেন, সেখানেই তিনি স্বভাবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, ফলে সার্থকতা সীমাবদ্ধ, কিন্তু যখন তিনি চণ্ডীদাসের ভাবানুসারী তখনই তিনি সার্থকতার চূড়াস্তে উপনীত হয়েছেন। কিন্তু তিনি চণ্ডীদাসের মতো তদ্‌গতচিত্ত হতে পারেননি, জ্ঞানদাস ছিলেন মূলত আত্মগত কবি। আবার “কবিত্বের বাহিরের লক্ষণ ধরিয়া বিচার করিলে জ্ঞানদাস চণ্ডীদাস অপেক্ষা উচ্চতর কারুশিল্পী, কারণ রূপনির্মিতিতে জ্ঞানদাস অধিকতর শিল্পপ্রয়াসের পরিচয় দিয়াছেন।”


রাধার বাল্যলীলার চিত্রাঙ্কনে জ্ঞানদাসের কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। দানখণ্ডের কোনো কোনো পদরচনায়ও জ্ঞানদাস জনরুচিকে তৃপ্ত করতে পেরেছেন। মান-অভিমান রঙ্গরসের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের অস্তরের মমতাটুকুও সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। নৌকা-বিলাসের কোনো কোনো পদও খুবই উল্লেখযোগ্য।

'মানস গঙ্গার জল        ঘন করে কল কল

দুকূল বাহিয়া যায় ঢেউ।'

—এই পদটার শেষে এসে

‘ডরেতে কাঁপিছে দে      এ জ্বালা সহিবে কে

কাণ্ডারী ধরিয়া করে কোৱে।।'

সামগ্রিকভাবে কবিতাটিতে রাধার আর্তির সঙ্গে সঙ্গে চিত্রপ্রতীক ও আবেগপ্রতীক কবি জ্ঞানদাসের উৎকৃষ্ট কবিপ্রতিভার পরিচায়ক।


রসোগারের পদরচনায় জ্ঞানদাস অপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণত রসোগারের পদে আদিরসের বাহুল্য থাকলেও জ্ঞানদাসের পদে সম্ভোগের উত্তাপের চেয়েও স্নিগ্ধ-সজল মমতার কোমল স্পর্শই লক্ষণীয়। এই রসোেগার পর্যায়েরই একটা কবিতা

'রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।'


জ্ঞানদাসের আধুনিক মনের পরিচয় পাওয়া যায় এ ধরনের পদগুলিতে। বিশ্বময় রাধাকে অনুভব করে জ্ঞানদাসের কৃষ্ণ যখন বলে ওঠেন—

‘গগনে ভুবনে     দশ দিগ্‌গণে

তোমারে দেখিতে পাই।'

“তখন এই দশদিকে পরিব্যাপ্ত ভুবনভরা প্রেমতন্ময়তা অতীত দিনের স্বপ্ন পার হয়ে আমাদের যুগের তট স্পর্শ করে।"


আক্ষেপানুরাগের পদে জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের তুলা কৃতিত্ব অর্জন করতে না পারলেও এমন কিছু কিছু পদ রচনা করেছেন, যেগুলো চণ্ডীদাসের নামেই প্রচারিত হয়ে থাকে। এরূপ একটা অতি বিখ্যাত পদ–

সুখের লাগিয়া      এ ঘর বাঁধিনু

আনলে পুড়িয়া গেল।


জ্ঞানদাস রচিত এই পদটিতে রাধার বেদনার্ত হৃদয়ের যে অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে, তা যেন চণ্ডীদাসের কৃতিত্বকেও অতিক্রম করে যায়। নিবেদন পর্যায়ধৃত এ ধরনের আর একটি পদের উল্লেখ করা চলে

বঁধু, তোমার গরবে      গরবিণী আমি

রূপসী তোমার রূপে।


রূপানুরাগ-এর কবিতায়ও জ্ঞানদাসের কৃতিত্বের কথা উল্লেখযোগ্য। সত্য বটে, গোবিন্দদাস রূপ বর্ণনার ক্ষেত্রে যে অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, জ্ঞানদাসের রচনায় সেই রূপ কখনও তেমন অপরূপ হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু কাব্যরূপে পদগুলি যে কবিত্বের উচ্চসীমা স্পর্শ করেছে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শ্রীকৃষ্ণের রূপানুরাগে জ্ঞানদাসের কৃতিত্ব তত নয়, যতটা শ্রীরাধার রূপানুরাগে। এই পর্যায়ের রচনা -

'দেইখ্যা আইলাম তারে

সই দেইখ্যা আইলাম তারে। 

এক অঙ্গে এত রূপ নয়ানে না ধরে।।'

অথবা

'রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।'


প্রভৃতি পদের তুল্য রচনা বৈষ্ণব কবিতায়ও দুর্লভ। বস্তুত রূপের কথা বলতে গিয়ে জানদাস রূপ ছেড়ে অনুরাগে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন।


ভাবসম্মেলন এর পদগুলিতে ভক্ত কবিগণ যে কল্পনার স্বর্গ রচনা করে মিলন সুখ অনুভব‌ করে থাকেন, জ্ঞানদাস হয়তো তাতে সান্ত্বনা পেতেন না বলেই এ ধরনের পদ রচনায় খুব আগ্রহ বোধ করেননি।