শাক্ত পদাবলীতে বাঙালী পরিবারের অন্তরঙ্গ চিত্র | 'আগমনী' ও 'বিজয়া' পর্যায়ের পদ অবলম্বন করিয়া হিমালয় ও মেনকার গার্হস্থ্যজীবনের পরিচয়

“আগমনী-বিজয়ার রঙ্গভূমি বস্তুত হিমালয় বা কৈলাসপুরী নয় প্রতি বাঙালী গৃহস্থ হৃদয়ই এদের অনুভূতি ক্ষেত্র।”– আলোচনা করো।

"পৌরাণিক পটভূমিকায় রচিত হলেও আগমনী ও বিজয়াসঙ্গীত বাঙালীর গার্হস্থ্য জীবনেরই সঙ্গীত।" -আলোচনা করো।

'আগমনী' ও 'বিজয়া' শীর্ষক পদাবলীতে মাতৃহৃদয়ের সুন্দর সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে— মন্তব্যটি উদ্ধৃতিসহ আলোচনা করো।


আগমনী-বিজয়ার গার্হস্থ্য জীবন পরিচয়

বিভিন্ন পুরাণে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ, হিমালয়-গৃহে মেনকা গর্ভে উমা-রূপে তার জন্মগ্রহণ, শিবের সঙ্গে উমার বিবাহ এবং কার্ডিক ও গণেশ নামক তার পুত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শাস্ত্রে শারদ সপ্তমী অষ্টমী নবমীতে দুর্গাপূজা এবং দশমীতে বিজয়া উৎসব তথা বিসর্জনের নির্দেশ রয়েছে। বাঙালী কবির দৃষ্টিতে এ দুটি ঘটনা একাকার হয়ে এরকম একটি রূপ পেলো পতিগৃহবাসিনী কন্যা উমার দীর্ঘ অদর্শন-জনিত শোকে কাতরা মা মেনকা স্বামী গিরিরাজকে বারবার অনুরোধ করে পাঠালেন কৈলাস ধামে— সেখানে জামাতা শঙ্করের অনুমতি নিয়ে গিরিরাজ কন্যা উমাকে নিয়ে এলেন স্বগৃহে। মাতা ও কন্যার মিলন হল—উভয় পক্ষে অভিমান অভিযোগ আাপনের পর কুশল-মঙ্গল আদান-প্রদান হল। কন্যা উমা সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী—এই তিন দিন রইলেন পিতৃগৃহে। নবমী দিনই মাতৃহাদয়বেদনা যেন দ্বিগুণিত হ'য়ে আত্মপ্রকাশ করে। দশমী প্রভাতে জামাতা শঙ্কর এসে কন্যাকে নিয়ে গেলেন— কন্যা-শোকাতুরা মাতার হাদয় হাহাকারে যেন জীর্ণ হয়ে গেলো। কন্যার অদর্শনজনিত বেদনায় যার আরম্ভ, বিদায়জনিত বেদনায় তার সমাপ্তি। এটুকু নিয়েই শাক্ত পদাবলীর উমাসঙ্গীত বা আগমনী-বিজয়া'র গান। বাঙালী জীবনের হহৃদয়-বেদনা-মথিত এই গানে যে শুধু বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের মা-মেয়ের সম্পর্কের বাস্তব ও স্পর্শকাতর জীবনচিত্রই ফুটে উঠেছে, তাই নয়, মনে হয়, এই গান বুঝি বাঙালী ছাড়া অপর কারো পক্ষে রচনা সম্ভবপর নয়—কারণ বাঙালীর ঘরোয়া জীবনের এই উপলব্ধি বাঙালী কবি ছাড়া আর কারই বা হতে পারে। জগজ্জননী উমাকে এইভাবে ঘরের মেয়ে-রূপে কল্পনা করতে পেরেছে বলেই শারদীয়া দুর্গাপূজা বাঙালীর প্রাণে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পেরেছে যে বস্তুত এটি পুজা না হ'য়ে যেন বাঙালীর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালীর হৃদয়ানুভূতির যে অনুপম প্রকাশ ঘটেছে মা ও মেয়েকে কেন্দ্র কৰে আগমনী-বিজয়ার পদগুলির মধ্য দিয়ে তা বাঙালীর লেখনি ছাড়া আর কোনো উপায়ে সম্ভব কি?


রবীন্দ্রনাথ তার 'ছেলে ভুলানো ছড়ায় লিখেছেন, “আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙ্গালী গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া বাঙ্গালীর হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙ্গালীর অম্বিকাপূজা এবং বাঙ্গালীর কন্যাপুজাও বটে। আগমনী ও বিজয়া বাঙ্গালীর মাতৃহৃদয়ের গান।”


বহু পদকর্তার বিচ্ছিন্ন কতকগুলি পদ নিয়ে আগমনী-বিজয়ার কাহিনী গড়ে ওঠায় তা নিটোল হ'য়ে ওঠবার অবকাশ পায় নি সত্য কিন্তু কাহিনী নয়, তার অন্তর্গত বিভিন্ন চরিত্র এবং তাদের হৃদয়বেদনার সার্থকতম প্রকাশ ঘটেছে বলেই এই শাক্ত পদগুলি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসাধারণ মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠতে পেরেছে। কাহিনীর এই আবেষ্টনীতে রয়েছে দুটি পরিবার একটি গিরিরাজ হিমালয় ও তার পত্নী মেনকার পরিবার-পরিবারের একজন অতিরিক্ত নিষ্ক্রিয় সদস্য জয়া, অবশ্য প্রতিবেশীদের ভূমিকাকেও এই প্রসঙ্গে অস্বীকার করা যায় না। অপর পরিবারটি দেবাদিদেব মহাদেব ও তৎপত্নী জগজ্জননী ভগবর্তী দুর্গার— যিনি গৌরী বা উমার নামধারিণী এবং হিমালয় মেনকার কন্যা। এই পরিবারে দুটি নিষ্ক্রিয় সদস্য কার্ত্তিক ও গণেশ। এখানে সবই স্বর্গীয় ব্যাপার, ঐশ্বরিক মাহাত্ম্যপূর্ণ। কিন্তু বাঙালী কবিগণ গোটা ব্যাপারটিকেই বাঙালী ঘরের পরিমণ্ডলে স্থাপন ক'রে একেবারেই আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এখানে ঐশ্বর্যের নামগন্ধও নেই, গোটা ব্যাপারটাই মধুর রসে পরিপূর্ণ।


আগমনী-বিজয়ার প্রায় সমগ্র অংশই বর্ণিত হয়েছে উমার পিতৃগৃহে। এখানে মেনকার ভূমিকাই প্রধান—অবশ্য উপস্থিত আছেন স্বয়ং গিরিরাজও। মেনকার সমস্ত বক্তব্যই পরিবেশিত হয়েছে গিরিরাজকে উদ্দেশ্য ক'রে। প্রধানত মেনকার উক্তি শেষ পর্বে গিরিরাজের উক্তি কিংবা প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে গিরিরাজ ও মেনকার গার্হস্থা তথা পারিবারিক জীবনের একটি সুন্দর চিত্র ফুটে ওঠে।


উমার অদর্শনজনিত বিরহযন্ত্রণা নিয়ে কাহিনীর আরম্ভ। বৎসরে মাত্র তিনটি দিনের জন্য কন্যার আগমন ঘটে—কিন্তু জননীর মন তা’তে তৃপ্তি পায় না। তাই মা মেনকার পরিকল্পনা—

'ঘরে জামাতা করে রাখবো কৃত্তিবাস, 

গিরিপুরে করবো দ্বিতীয় কৈলাস।'


প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে, বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলিতে কিন্তু শিবকে ঘর-জামাই-রূপেই দেখানো হয়েছে। যাহোক, মেনকা ভাবছেন, শিবকে ঘরজামাই রেখে বিহুপত্র দিয়ে পূজা করা যায়, তবেই তিনি তুষ্ট থাকবেন। “শিব তুষ্ট বিহুদলে”— বাঙালীর ঘরে ঘরে শিবপুজার এই বিধান মেনকার উক্তির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়।


মেনকা জানেন, এই পরিকল্পনা কল্পনামাত্র — স্তবে তা সম্ভব নয়। তাই আবার নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন— 'শিব শ্মশানে মশানে ফিরে, ঘরের ভাবনা ভাবে না’–এমন জামাতার ঘরে কন্যার মনে কি সুখ থাকতে পারে? এতএব, 'এবার আমার উমা এলে, আর পাঠাব না। —এতে লোকে যদি মন্দ বলে, বলুক, এমন কি এর জন্যে যদি প্রয়োজন হয়, তবে এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া, জামাই বলে মানবো না। কন্যার সুখের জন্য বাঙালী মায়েরা এমনিভাবেই চিরদিন লোকনিন্দাকে অগ্রাহ্য করে থাকে।


কন্যার মঙ্গলকামনায় মেনকা দিনভর যে চিন্তায় কালাতিপাত করেন, রাত্রিতে তা-ই আবার স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। তিনি স্বপ্নে দেখেন

'চারিদিকে শিবা-রব হে।

তার মাঝে আমার উমা একাকিনী শ্মশানে।'


এ দেখে মায়ের প্রাণ আর সইতে পারে না। তিনি এবার গিরিরাজকেও গঞ্জনা দিয়ে বলেন, “গিরিরাজ ভিখারী সে শূলপাণি, তাঁরে দিয়ে নন্দিনী, আর না কখন মনে কর একবার।' অতএব এর একমাত্র প্রতিবিধান –

'বিলম্ব না কর আর হে গৌরী আনিবার।'


মেনকার এবারের অনুরোধে গিরিরাজ কান দেন না কারণ পুরুষকে এত বিচলিত হ'লে চলে না। তিনি মাঝে মাঝে মেনকার কাছে গৌরীর সংবাদ জানতে চান মেনকা জানান—নতুন স্বপ্নের কথা

'বাহার নাই সে বরণ নাই আভরণ,

হেমাঙ্গী হইয়াছে কালীর বরণ।'

শুধু তাই নয়—স্বপ্নে ঊমা অনুযোগ জানিয়েছে, কেন তার সংবাদ নেওয়া হয় না।


অতএব মেনকার সানুনয় অনুরোধ—গিরি যেন অবিলম্বে গৌরীকে নিয়ে আসবার জন্য কৈলাস গমন করেন। এখন শিব জামাতা হ'লেও তো জগৎপুজ্য। তাই মেনকা গিরিকে জানিয়ে দেন যে কৈলাসে গিয়ে তিনি যেন সচন্দন বিহুদল এবং গঙ্গাজলে শিবকে পূজা ক'রে তার মন ভুলিয়ে নেন। তিনি আরও বলে দেন যে সঙ্গে যেন কার্ত্তিক-গণেশ আর লক্ষ্মী-সরস্বতীকেও মর্যাদার সঙ্গে নিয়ে আসা হয়, এমন কি জামাতা শিব রাজি হলে তাকেও অবশ্যই নিয়ে আসতে হবে। সাধারণত পুরুষ তথা গৃহকর্তারা গৃহ-বিষয়ে উদাসীন থাকেন বলেই তাদের এসব বিষয়ে গৃহস্বামিনীরা সচেতন করে দিয়ে থাকেন। স্বামিনিন্দা শুনে পূর্বজন্মে সতীরূপে পার্বতী দেহত্যাগ করিয়াছিলেন, তাই মায়ের মনে ভয়—

'আমি সেইটে করি ভয়, ঝি জামাই আনতে হয়।

এসো কৈলাসবাসীদের সব, নিমন্ত্রণ করে।।'


শুধু জামাতাকে নয়, সবান্ধব তাঁকে নিমন্ত্রণ করাই সামাজিক নিয়ম মেনকা কথাটা -স্মরণ করিয়ে দেন গিরিরাজকে।


গৌরীকে অনেকদিন পিতৃগৃহে আনা হয় নি বলে নারদের মারফত গৌরী অভিযোগ জানিয়েছে—

'দেব দিগম্বরে সঁপিয়া আমারে মা, বুঝি নিতান্ত পাসরিছে।'


অতএব গিরী যেন অবিলম্বে গৌরীকে আনতে যান। মেনকার নিজের তো কিছু করবার উপায় নেই, কারণ—

'কামিনী করিল বিধি, তেঁই হে তোমারে সাধি,

নারীর জনম কেবল যন্ত্রণা সহিতে।'


স্বামিগৃহে কন্যার দুর্দশার কথা চিন্তা করে মায়ের মন যন্ত্রণায় ভারাতুর হয়ে ওঠে। সেখানে ‘ঘরেতে সতিনীজ্বালা', 'ভোলানাথ ভিক্ষা করে’, ‘যথাকালে খায় ফল দিবা অবসান, কিন্তু ‘তাহে কি উদর ভরে'; কিংবা জামাতা আছে কিনা ছেলেমেয়ে রাখে না সন্ধান'। তার দুর্দশার এখানেই শেষ নয়–মেনকা নারদের কাছে আরো শুনেছেন, জামাতা আপনি শ্মশানে ফিরে সঙ্গে লয়ে যায় তারে, কত আছে কপালে উমার।'


মেনকার অনুরোধ অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়, তাই তাঁকে বলতে হয়, প্রতিদিন কিহে আমারে ভুলাবে'। মেনকার দুঃখ তো কেবল কন্যার দীর্ঘ অদর্শনজনিতই নয়,— তাঁর একমাত্র -পুত্র, 'সোনার মৈনাক ডুবিল নীরে, সে শোকে রয়েছি পরাণ ধরে’ – কিন্তু আর তিনি পেরে - উঠছেন না বলে স্বামীকে ধিক্কার জানাচ্ছেন। স্বামী তো 'কৈলাসে যাই' বলে যেতেন এবং ফিরে এসে শিবের শতেক নিন্দা শুনিয়ে বলতেন যে উমা শরৎকালে আসবে।


শিবের দোষ থাকলেও তিনি জামাতা, তাই কন্যার সঙ্গে জামাতাকেও আনতে হয়। নারীর মনস্তত্ত্ব গিরিরাজের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলেই তিনি জামাতাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে পারেন— মেয়ের যেরূপ মন, মায়ে বোঝে যেমন পাষাণ পুরুষের তা' বোঝবার কথা নয়। এই প্রসঙ্গে মেনকা স্মরণ করেন আর একবারের কথা, যখন জামাতাকে বাদ দিয়ে শুধু উমাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। মেনকা শিবের কুশল জানতে চাইলে উমার চোখে জল এসেছিল তিনি ছলনায় তা ঢাকতে চাইলেও মেনকা বুঝেছিলেন 'হিয়ের জল ঝিয়ের চোখে উথলিল, জামায়ের প্রসঙ্গে।' আর একবারও জামাইকে বাদ দিয়ে শুধু মেয়ে আর নাতিদের নিয়ে আসা হয়েছিল। সেবার কার্ত্তিক যখন জিজ্ঞেস করেছিল, মা, আমার বাবা কেন এল না তখন উমা শুধু বলেছিলেন,—“কেন এলেন না, তোমার দিদি জানে।' অর্থাৎ জামাতাকে আনা হয়নি—মেয়ে সেই ঘোঁটাটাই দিয়েছিল।


মেনকার জ্বালা তো কেবল নিজেকে নিয়ে নয়—পাড়া-পড়শীরাও এতে ইন্ধন যোগায়। কন্যাবিহনে কিভাবে মেনকা দিন কাটাচ্ছেন, তারা জানতে চায়। তারা আরও বলে, 'নারদের বাক্যকৌশলে, না জেনে শুনে কি বলে, মেয়েকে ফেলিলে জলে, ভূধর-র মণি!'—অতএব চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মেনকার পুনরায় অনুরোধ, ‘আন গে নন্দিনী'।


পরম ধৈর্যশীল গৃহপতি গিরিরাজ বহু লাঞ্ছনা-গঞ্জনায়ও নিরুত্তর থেকে মুখ খুলে মেনকাকে বোঝালেন পুরুষের মনস্তত্ত্ব—উমাকে ছেড়ে শিব থাকতে পারেন না, কারণ ‘উমার অঙ্গের ছায়া শীতলে শঙ্কর-কায়া'। অতএব গিরিরাজ কৈলাসে যাবেন, কিন্তু তিনি শিবকে কিছু বলবেন না; বরঞ্চ গিরি মেনকাকে খোঁটা দিয়ে বললেন,— 'অবলা অল্পমতি না জান কার্যের গতি।'


যাহোক, মেনকাকে কাদতে নিষেধ ক'রে গিরিরাজ কৈলাস যাত্রা করেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, ‘গেলে যদি কৃত্তিবাস না পাঠান। একদিকে মনে সংশয়, অন্যদিকে অস্তরে আনন্দ– “হৈরিব শঙ্কর শিব, আজি তনু জুড়াইব আনন্দ-সমীরে' শিব উমাকে পাঠাতে অস্বীকৃত হ'তে পারেন, এই আশঙ্কায় প্রবেশে কৈলাসপুরী, না ভেটিয়ে ত্রিপুরারি গমন করিল গিরি শয়ন মন্দিরে।' পিতাকে দেখতে পেয়ে জগন্মাতা গৌরী ছুটে এসে পিতাকে প্রণাম করতে উদ্যত হ'লে “নিষেধ করয়ে গিরি ধরি দুটি করে।'


গিরিরাজ জানালেন মেনকার অস্তর বেদনার এবং ভ্রাতা মৈনাকের আত্মাহুতির কথা

'তোমার বিচ্ছেদানল অস্তরে হাঁয়ে প্রবল, 

সিন্ধুনীরে প্রবেশিল মৈনাক স্রাতা তোমার।'


ঊমা বিহিত-বিধানে শঙ্করের কাছে মায়ের দুঃখ এবং মাতৃ-অদর্শনে নিজের দুঃখের কথা বলে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি চাইলে শঙ্কর অনুমতি দিয়ে বলেন,

‘জনক-ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার? 

আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর।'


উমা এলেন পিতৃগৃহে-প্রতিবেশীরা দূর থেকে উমাকে দেখেই মেনকাকে উমার আগমন সংবাদ জানালে উথাল-পাতাল মেনকা ছুটে দিয়ে কন্যাকে বুকে তুলে নেন। কন্যার কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন। কখনো অভিমানিনী উমা বলেন—'কে মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে?'


কখনো বলেন, 'আমি আপনি এসেছি জননী বলে। বিভিন্নজনের মুখে শিবের ভিক্ষাবৃত্তি ও শ্মশানবাসের কথা শুনেছেন মেনকা, তাই উমার কাছে তার সত্যতা জানতে চান— 'কও দেখি উমা, কেমন ছিলে মা, ভিখারী হরের ঘরে।' উমা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,— 'ছিলাম ভাল জননী গো হরেরি ঘরে। কে বলে জামাই তব শ্মশানেতে বাস করে। শিবের মহিমা বোঝবার শক্তি কার আছে?

'ষড়ৈশ্বর্য আছে যার ভিক্ষা কি জীবিকা তার?

সকলে না বুঝে সার, ভিক্ষাজীবী বলে হরে।।'


উমা পিতৃগৃহে আসবার পর গিরিরাজের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। এখানে কেবলি মায়ে ঝিয়ের বোঝাপড়া। তিন দিন-সপ্তমী অষ্টমী-নবমী পিতৃগৃহে বাসের পর উমা যখন ফিরে যাবেন কৈলাসে, তখন আবার মেনকার মনে হয়, এ দুঃখ থেকে যদি ত্রাণ করতে পারেন গিরিরাজ মেনকার কাতর প্রার্থনা গিরিরাজকে লক্ষ্য করে– “আমার গৌরীকে লয়ে যায় হর আসিয়ে, কি করহে গিরিবর, রঙ্গ দেখ বসিয়ে।। কিন্তু গিরিরাজ তো জানেন— 'জামাতা সামান্য নয়'—অতএব তার কিছু করণীয় নেই। কিন্তু এ কথায় কন্যাস্নেহাতুরা মাতার মন প্রবোধ মানে না। অতএব তার শেষ চেষ্টা—

'গিরি যায় হে ল'য়ে হর প্রাণকন্যা গিরিজায়।

পার তো রাখ প্রাণের ঈশানী, বাঁচে পাষাণী, গিরি যায়।।

মোর বচন ধরহে নাথ ধর গঙ্গাধর পায়।'


এই গিরিরাজ ও মেনকার গার্হস্থ্য জীবন তথা পারিবারিক জীবন। পিতামাতা ও সস্তানদের নিয়ে পরিবারের মূল কাঠামো গড়ে উঠলেও তথায় পাড়াপ্রতিবেশীদেরও কিছুটা ভূমিকা থাকে। হিমালয় মেনকার সংসারে মেনকাই কেন্দ্রস্থ হ'য়ে স্নেহের আকর্ষণে সবাইকে টেনে রেখেছেন তার স্নেহই সমস্ত ঘটনা ও চরিত্রকে ঐক্যসূত্রে একসঙ্গে গেঁথে রেখেছে। এখানে দুটি পরিবারের কাহিনী—“ইহাদেরই পটভূমিকায় পতি-পত্নীর গৃহস্থালি, দম্পতির রহস্যালাপ, তাঁহাদের মান-অভিমান, সন্তানের জন্য মাতৃহৃদয়ের স্নেহের ব্যাকুলতা, তনয়া-বিশ্লেষজনিত দুঃখার্তি, মিলনের অনন্দ, বিরহের বেদনা মুখর হইয়া উঠিয়াছে। পিতার সংযত ধৈর্য ও ফল্গুধারার ন্যায় অন্তঃসলিলা স্নেহ, প্রতিবাসীর সমালোচনা, কলকোলাহলও বাদ যায় নাই। পারিবারিক জীবনের সূক্ষ্ম ও সুকুমার বৃত্তি, অতি সুকোমল অনুভূতি বিচিত্র রাগিণীতে ঝঙ্কারময় হইয়া উঠিয়াছে।”


বাঙালীর পারিবারিক জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই শাক্তপদগুলির সৃষ্টি—এই অভিজ্ঞতা থেকেই কবিরা মানবমনের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপায়ণ ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালীর পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের আচার আচরণ, লোক-লৌকিকতা, পারস্পরিক সম্পর্কের বোঝাপড়া, বিশেষত শ্বশুরগৃহে জামাতার মর্যাদা এবং পিতৃগৃহে কন্যার একক আগমনে তার মানসিক অবস্থা প্রভৃতির পরিচয় আগমনী বিজয়ার পদগুলিতে যেভাবে ফুটে উঠেছে তাতে এই পদাবলীকে লোকজ্ঞানের ভাণ্ডার নামে অভিহিত করলেও অত্যুক্তি হয় না। শাক্ত কবিরাই সর্বপ্রথম একটি পৌরাণিক কাহিনীকে বাঙালীর গার্হস্থ্যজীবনের মধ্যে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন, তাই মেনকার মধ্যে আমাদের কন্যাবিচ্ছেদকাতরতা বাঙালী জননীর চিরন্তন রূপটি ধরা পড়েছে।


অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী শাক্তপদাবলীর যথাযথ বিশ্লেষণ ক'রে যথার্থই বলেছেন, “শাক্ত পদাবলীর লীলা পর্ব পৌরাণিক কাহিনীর গার্হস্থারসসিক্ত সঙ্গীতময় বাণীরূপ।" বাঙালী জীবনের এমন একটি বিশ্বস্ত ও নিপুণ সামগ্রিক চিত্র ইতঃপূর্বে বাঙলা সাহিত্যে আর কখনো দেখা যায় নি।


ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলেন—“বাংলার কুটীরের বালিকা-দুহিতাদের স্বামী-গৃহে যাওয়ার পর মাতৃহহৃদয়ের বিরহের হাহাকারকে করুণ রসের অফুরস্ত উৎস করিয়া যে সকল আগমনী গান পল্লীতে পল্লীতে বহিয়া গিয়াছে, সেই আগমনী গানের আদি গঙ্গা হরিদ্বার এই প্রসাদ সঙ্গীত। আশ্বিন মাসের ঝরা শিউলি ফুলের মত এই যে মাতৃমিলনের প্রত্যাশায় বালিকা বধুদের চক্ষুজল দিনরাত ঝরিত, এই সকল আগমনী গান সেই সকল অশ্রুরচিত হার—উহা তৎকালীন বঙ্গ জীবনের জীবন্ত বিচ্ছেদ রসে পুষ্ট।"