"পুরাণের শক্তিদেবীর শাক্তপদাবলীতে আসিয়া কল্যাণী জননীর রূপ পরিগ্রহ করিয়াছেন।'—'ভক্তের আকৃতি' পর্যায় হইতে রামপ্রসাদের পদ-অবলম্বনে ইহার সমর্থনযোগ্যতা বিচার করো।

‘ভক্তের আকৃতি'তে শক্তিদেবীর কল্যাণী জননীতে রূপান্তর


ভারতীয় সাধনায় শক্তির আবির্ভাব প্রথম কবে ঘটেছিল, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ অভিন্নমত নন। প্রাগার্য-যুগ হরপ্পা-মোহেন্-জো দড়োর ভগ্নাবশেষে শক্তি সাধনার নিদর্শন পাওয়া গেছে—কোনো কোনো ঐতিহাসিকের এই অভিমত গ্রহণযোগ্য এবং তা আর্য ধ্যান-ধারণার বহির্ভূত বলেই স্বীকার ক'রে নিতে হয়। তবে বেদ-উপনিষদেও যে শক্তি-মাহাত্ম্য স্বীকৃত হয়েছে–এর নিদর্শনও দুর্লভ নয়। প্রমাণ স্বরূপ বেদের 'দেবীসৃক্ত' এবং 'রত্রিসূক্ত' উল্লেখযোগ্য। উপনিষদেও উমা-হৈমবতীকে পাওয়া যায়। মহাভারতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে 'দুর্গাস্তোত্র' পাঠ করতে বলেছেন। পরবর্তী কালে বিভিন্ন পুরাণে 'আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতি' বা সবৈশ্বর্যময়ী ভগবতীর মাহাত্ম্য বিস্তৃতভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে।


উমা-হৈমবতী, দাক্ষায়ণী সতী এবং ভগবতীর দুর্গার কাহিনীতে তাঁদের অসাধারণ কর্মকুশলতার নিদর্শন থাকলেও প্রধানত তাদের শাস্তমূর্তিই ভক্তগণের দ্বারা উপাসিত হ’য়ে থাকে। কিন্তু এই শক্তির যে রূপভেদ তান্ত্রিক সাধকদের কল্পনায় ধরা দেয় যেখানে দেবীকে ‘ভীমা, ভীষণা, ভয়ঙ্করী’ বলেই মনে হয়, দেবী মুশুমালা-বিভূষিতা, তিনি খর্ণরধারিণী, তার পদচাপে পিষ্ট স্বয়ং শিব শবে পরিণত হয়েছেন।


শাক্তসঙ্গীতের কাহিনীদেহ নির্মিত হয়েছে প্রধানত দেবীভাগবত, কালিকাপুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণাদিকে কেন্দ্র করেই। মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ডীকে ‘তেজসঃ কূটং জ্বলস্তমিব পর্বতম’–জ্বলন্ত পর্বতের ন্যায় তেজঃপুঞ্জ বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেবী চামুণ্ডার আবির্ভাব-সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে দেবী কৌশিকীর ভূকুটি কুটিল ললাটদেশ থেকে ভয়ঙ্করী চামুণ্ডা দেবী উদ্ভূতা হলেন—

'ভ্ৰুকুটি কুটিলাত্তস্যা ললাটফলকাদ্ দ্রুতম্।

কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।'


সাধারণ বাঙালীর ধারণায় তান্ত্রিক শক্তি প্রধানত কালী বা শ্যামারূপেই পরিচিত। কালীর ধ্যানমন্ত্রের অংশবিশেষ থেকেই তাঁর ভয়ঙ্করী মূর্তির পরিচয় পাওয়া যাবে। 'দক্ষিণা কালিকাদেবী করালবদনা, ঘোরা, ভীষণাকৃতি...দেবীর গলদেশে মুণ্ডমালা... বামকরে সদ্যছিন্ন মুণ্ড, ঊর্ধ্বকরে খড়া... তার কর্ণে দুটি শবশিশু অলঙ্কাররূপে বিদ্যমান... প্রভৃতি। কোনো কোনো শাক্তপদকর্তার পদে দেবীর এই উগ্রমূর্তির প্রকাশ ঘটেছে।


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শক্তির এই উগ্রতা ক্রমক্ষীয়মাণ হলেও তার অনিষ্টকারী শক্তির একেবারে বিলোপ ঘটেনি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দেবী চণ্ডী কালকেতুকে ভগবতী দুর্গার রূপে দেখা দিয়েছিলেন এবং ধনপতি ও তৎপুত্র শ্রীমস্তকে 'কমলে কামিনী' রূপে দেখা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সকলকেই কিছু-না-কিছু শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছিল। শক্তি সাধনা যে ঐ যুগে নিন্দিতও হতো, তার সাক্ষ্য দিচ্ছে চৈতন্য চরিতামৃতা ও চৈতন্য ভাগবত'। শাক্তসাধকগণ মদ্যমাংস দিয়ে শক্তিপূজা করতেন এবং রাত্রিকালে মন্ত্র পাঠ করে পঞ্চকন্যাকে নিয়ে আসতেন— প্রভৃতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে শক্তিপূজার সঙ্গে ভয়ানক এবং বীভৎস রসের সম্পর্ক খুঁজে পাই।


অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ—যে কালটি ছিল বাংলার সমাজজীবনে অবক্ষয়ের সমস্ত দুর্লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত, সেকালে আবির্ভূত হলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন রামপ্রসাদ একজন তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। কিন্তু তান্ত্রিক সাধনার যে ধারাটি তিনি অনুসরণ করেছিলেন, তা' ঐ অন্ধকার যুগের বুকে যে বিদ্যুচ্চমকের মতো আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করেছিল, কালে কালে তা বিস্তৃতি লাভ করে আধুনিক কাল অবধি প্রসারিত হয়েছিল। আমরা শক্তি দেবতার যে মধ্যযুগীয় চিত্র একটু আগে পরিবেষণ করেছি, তা হল দেবীর দিক্‌ মাত্র। তার আরও একটি দিক আছে। যেখানে দেবী ‘বরাভয়দাত্রী এবং যাঁর মুখমণ্ডল সুপ্রসন্ন ও হাস্যবিকশিত (অভয়ং বরদঞ্চৈব ….সুখপ্রসন্নদেশাং শ্বেরাননসরোরুহাম্)। ভক্ত দেবীর কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে তারি চরণে শরণ গ্রহণ করেন। ভক্ত কবি রামপ্রসাদ ছিলেন এই ধারার সাধক এবং তার সাধনমন্ত্র যে দেবীকে লক্ষ্য করে উচ্চারিত হল, তিনি শুধু জগজ্জননীই নন, তিনি রামপ্রসাদেরও জননী।


সাধক হলেও রামপ্রসাদ ছিলেন কবিস্বভাব, কাজেই স্বভাবতঃই ভীষণের মধ্যেও তিনি মধুরকেই খুঁজে নেবেন, ভয়ানক বীভৎস রস অপেক্ষা শাস্ত মধুর রসের প্রতিই থাকবে তার আগ্রহ––এটুকু কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয় না। আমরা তাই রামপ্রসাদের সঙ্গীতে শক্তিদেবীকে কল্যাণী জননী-রূপেই সমাসীন দেখতে পাই। দীর্ঘদিনের ক্রমবিবর্তনেই অবশ্য শক্তিদেবীর এই রূপান্তর ঘটেছে।


অধ্যাপক শশিভূষণ দাসগুপ্ত এ বিষয়ে লিখেছেন – “যিনি ছিলেন শক্তিরূপিণী, ক্রমপরিণতির প্রবাহের ভিতর দিয়া তিনিই আসিয়া রূপ পরিগ্রহ করিয়াছেন পরম প্রেমরূপিণী মূর্তিতে।" সাধক কবি রামপ্রসাদের বিভিন্ন শ্যামাসঙ্গীতে বিশেষভাবে 'ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ে। দেবী একেবারে মাতৃরূপ ধারণ করেছেন, যাঁর নিকট সন্তানরূপে রামপ্রসাদের শুধুই নালিশ, আবদার আর বায়না। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই সকল আবদার বা বায়নার পেছনে রামপ্রসাদের কোনো জাগতিক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ছিল না।


'ভক্তের আকৃতি' পর্যায়ের কোনো কোনো কবি অবশ্য জগজ্জননীকে ঐশ্বর্যমূর্তিও কল্পনা করেছেন, কিন্তু রামপ্রসাদের প্রায় সব পদেই শক্তিকে জননীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সংসারজীবনে সস্তান যেমন একান্তভাবেই মায়ের কল্যাণী রূপের সঙ্গে থাকে পরিচিত এবং তার যাবতীয় অভাব-অভিযোগের জন্য সন্তান জননীরই দারস্থ হয়ে থাকে, ভক্তের আকুতি' পর্যায়ের পদে সাধক রামপ্রসাদ তেমনি একান্তভাবেই কল্যাণরূপিণী জননীর শরণ গ্রহণ করেছেন।


‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের শাক্তপদগুলিতে সংসারের দুঃখক্লান্ত, বহুবিধ সমস্যা জর্জরিত এবং প্রবৃত্তিতাড়িত সস্তানের মর্মভেদী হাহাকার এবং তার হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য মাতৃপদে শরণ গ্রহণ। মা যে সন্তানকে রক্ষা করবেনই, এ বিষয়ে কবি নিশ্চিত, কাঁরণ—

‘কুপুত্র অনেক হয় মা, কুমাতা নয় কখনো তো।'


কবির অভিমান মায়ের ওপর, কারণ 'মা, খেলবি বলে, ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতলে’, কিন্তু কার্যত 'মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে হলো। ওমা, মিঠার লোভে তিত মুখে সারা দিনটা গেল।।' যা হবার তা তো হয়েই গেছে, এখন কবির কামনা—'এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে ঘরে নিয়ে চলো' কল্যাণী জননীর কোলেই সন্তানের অভয় আশ্রয় অতএব এছাড়া কবির আর কিই-বা কামনা থাকতে পারে?


মায়ের সঙ্গে সস্তানের সম্পর্ক যে কত গভীর, একের ওপর অপরে যে কতখানি নির্ভরশীল, তারও পরিচয় দিয়েছেন রামপ্রসাদ

'কিছু দিলে না পেলে না নিলে না খেলে না,

সে দোষ কি আমারি?

যদি দিতে পেতে নিতে খেতে দিতাম খাওয়াইতাম তোমারই।।'


জননী যদি কল্যাণী না হয়ে ভয়ঙ্করী হতেন, তবে কি আর রামপ্রসাদ এমনভাবে বলতে পারতেন? জননী কল্যাণী বলেই সস্তান সর্ব অবস্থাতেই তাঁর নিকট আশ্রয় কামনা করেন। ভক্তের আকৃতি পর্যায়ে রামপ্রসাদ যতগুলি পদ রচনা করেছেন, তাদের সবকটিতেই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় পড়েও তিনি মায়ের চরণে শরণ নিয়েছেন, –এ থেকেই শক্তির কল্যাণী রূপটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মাতৃরূপিণী শ্যামার সঙ্গে সস্তান রামপ্রসাদের সম্পর্কেও নিবিড়তা, গভীরতা ও আন্তরিকতার পরিচয় পাই এই পর্যায়ের গানগুলিতে। গবেষকগণ অনুমান করেন যে রামপ্রসাদ যদিও দিব্যভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, কিন্তু আসলে তিনি বীরাচারী তান্ত্রিক সাধক অমোঘ বলবীর্য এবং বলিষ্ঠ পৌরুষের অধিকারী হয়েও রামপ্রসাদ কল্যাণময়ী জননীর নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে তার সকল আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটিয়েছেন। তাই তিনি বলতে পারেন—

'আমি কি দুখেরে ডরাই?

দুখে দুখে জন্ম গেল, আর কত দুখ দেও, দেখি তাই। 

দেখ, সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে, আমি করি

দুখের বড়াই।।'


মানবজন্ম মানেই তো দুঃখযন্ত্রণা ভোগ, চিরতরে তিনি সেই দুঃখের হাত থেকে মুক্তি নেবেন মায়ের অভয় চরণে আশ্রয় নিয়ে।

'জন্মমৃত্যু যে যন্ত্রণা, যে জন্মে নাই সে জানে নাই।

তুই কি জানিবি সে-যন্ত্রণা, জন্মিলে না মরিলে না।

তবু বব মায়ের চরণে, আর তো ভবে জন্মিব না।'

অন্যত্র বলেছেন

‘জন্ম জন্মান্তরেতে মা, কত দুঃখ আমায় দিলে। 

রামপ্রসাদ বলে, এবার মোলে ডাকব সর্বনাশী বলে।'


রামপ্রসাদ যে করালবদনী ভয়ঙ্করী শ্যামামুর্তির পরিবর্তে তাকে কল্যাণময়ী জননীরূপেই গ্রহণ করেছেন তার সর্বোত্তম পরিচয় রয়েছে নিম্নোক্ত পদটিতে—

'যশোদা নাচাতো গো মা বলে নীলমণি;

সে বেশ লুকালে কোথা করালবদনী? 

একবার নাচগো শ্যামা,

হাসি বাঁশী মিশাইয়ে, মুণ্ডমালা ছেড়ে, বনমালা পরে, 

অসি ছেড়ে বাঁশী লয়ে, আড়-নয়নে চেয়ে চেয়ে,

গজমতি নাসায় দুলুক।'

শ্যামা মাকে রামপ্রসাদ এখানে একেবারে প্রেমিক শ্যামের পর্যায়ে নিয়ে এসে তার কল্যাণসুন্দর রূপটিই দেখতে চাইছেন।