এই গৌরচন্দ্রিকায় শ্রোতার মানস-নয়নে যে চিত্রখানি ফুটিয়া উঠে তাহা পূর্বরাগে ভাবান্তরিতা রাধার চিন্তা ঔৎসুক্য উদ্বেগের চিত্র”—তোমার অধীত 'গৌরচন্দ্রিকা' এবং 'পূর্বরাগে'র পদ অবলম্বনে উদ্ধৃত উক্তিটি বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দাও।

মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের অনুক্ষণের সঙ্গী এবং চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষদ্রষ্টা স্বরূপ দামোদর রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত চৈতন্যাখ্য কৃষ্ণস্বরূপকে নমস্কার জানিয়েছেন। চৈতন্যদেব কৃষ্ণস্বরূপ বিবেচিত হলেও তিনি যে রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত অর্থাৎ রাধাভাবেই ভাবিত ছিলেন, এই উপলব্ধি স্বরূপদামোদরের নিজস্ব নয়- এটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়েরই একটি মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি। বৈষ্ণব দর্শনের অন্যতম ব্যাখ্যাতা কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীও স্পষ্টভাবেই এই স্বীকারোক্তি করে গেছেন যে রাধিকার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করেই শ্রীকৃষ্ণ গৌরাঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। চৈতন্যদেবের জীবন কাহিনী বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যে আজীবন তিনি রাধাভাবের সাধনাই করে গেছেন। তিনি যে প্রকটকালের শেষ বারো বৎসর রাধাভাবেই ভাবিত হয়ে কাটিয়েছেন, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন কবিরাজ গোস্বামী –

‘রাধিকার ভাবমূর্তি প্রভুর অস্তর।

সেইভাবে সুখদুঃখ ওঠে নিরস্তর।।'


বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে নায়ক শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য নায়িকার কথা বলা হলেও কৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া রাধাই ছিলেন সর্বোৎকৃষ্টা। নায়িকার সঙ্গে নায়কের সম্পর্ক মধুর বা শৃঙ্গাররসাত্মক। মধুর রসের দুটি ভেদ – বিপ্রলস্ত ও সস্তোগ; বিপ্রলম্ভ আবার চারিভাগে বিভক্ত–পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিপ্স বা আক্ষেপানুরাগ এবং প্রবাস বা বিরহ অথবা মাথুর। বৈষ্ণবপদকর্তাগণ রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী রচনা প্রসঙ্গে রাধার জীবনে এই সবকটি পর্যায়ই সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। এদের মধ্যে পূর্বরাগ নায়ক বা নায়িকার মিলনপুর্ব অবস্থা—

‘রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা।

তয়োরুশ্মীলিতি প্রাজৈ: পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।।'


মিলনের পূর্বে দর্শনশ্রবণাদি দ্বারা নায়ক-নায়িকার হৃদয়ে যে রতির উম্মীলন ঘটে, তাকে বলে পূর্বরাগ। মান, প্রেমবৈচিত্র এবং প্রবাস মিলনোত্তর ঘটনা। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার মিলন ঘটেছিল বলেই রাধার জীবনে তথা রাধাকৃষ্ণলীলা বর্ণনায় মান-আদির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। কিন্তু চৈতন্যদেব তো সারা জীবন শুধু কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হবার সাধনাই করে গেছেন, কাজেই তার জীবনে সবই তো পূর্বরাগ। তিনি জীবনভোর জগন্নাথ-স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে'–এই আতিই তো প্রকাশ করে গেছেন। কোনো কোনো বৈষ্ণব কবি কৃষ্ণলীলার সঙ্গে সাদৃশ্য দেখানোর উদ্দেশ্যে গৌরাঙ্গদেবকে অবলম্বন করেও গোষ্ঠ, মান, মাথুর প্রভৃতির পদ রচনা করেছেন। তবে এগুলো শুধু অনুকরণই হয়েছে, এর মধ্যে গৌরাঙ্গসুন্দরের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। চৈতন্যদেবের সারা জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে শুধু পূর্বরাগের আর্তিই ধ্বনিত হয়েছে।


অনেক রসিক সমালোচক মনে করেন যে চৈতন্যদেবের জীবনে ও আচরণে যে রাধাভাব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত, তাতে পূর্বরাগের লক্ষণই সুস্পষ্ট এবং তার এই ভাবোম্মাদ চিত্র দেখে বা কল্পনা করেই অনেক বৈষ্ণব পদকর্তা রাধার পূর্বরাগের পদ রচনা করেছেন। এইজন্যেই গৌরচন্দ্রিকার পদগুলোর সঙ্গে শ্রীরাধার পূর্বরাগের পদের বিস্ময়কর সাদৃশ্য দেখা যায়। অতএব নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি— “এই গৌরচন্দ্রিকায় শ্রোতার মানস-নয়নে যে চিত্রখানি ফুটিয়া উঠে, তাহা পূর্বরাগে ভাবাস্তরিতা রাধার চিন্তা-ঔৎসুক্য উদ্বেগের চিত্র"– সামগ্রিকভাবে যথার্থ বলেই মেনে নিতে হয়।


পূর্বরাগ ত্রিবিধ -সাধারণ সমঞ্জস এবং প্রৌঢ় ইন্দ্রিয়-পিপাসা চরিতার্থ করবার বাসনা থেকেই সাধারণ পূর্বরাগের সৃষ্টি হয়। এখানে 'আত্মেন্দ্রিপ্রীতি ইচ্ছা থাকলেও তাতে সামান্য পরিমাণ হলেও ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি ইচ্ছা' বর্তমান থাকে। এই স্তরের পূর্বরাগের নিদর্শন কুব্জার পূর্বরাগ। বিবাহ দ্বারা সন্তোগেচ্ছা পুরণের আকাঙ্ক্ষা থেমে সমঞ্জস পূর্বরাগের সৃষ্টি। সত্যভামা ও রুক্মিণীর পূর্বরাগ এই জাতীয় প্রৌঢ় পূর্বরাগ আত্মসুখবাসনাগন্ধলেশবর্জিত। ব্রজগোপী তথা রাধিকার পূর্বরাগ এই জাতীয় যাবতীয় পূর্বরাগের মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ। গৌরচন্দ্রিকার পদে গৌরাঙ্গের আচরণে এই প্রৌঢ় পূর্বরাগের লক্ষণই উপস্থিত। এই পূর্বরাগে লালসা, উদ্বেগ, জাগর্ষা, তানব, জড়িমা, বৈয়গ্র, ব্যাধি, উন্মত্ততা, মোহ ও মৃত্যু—এই দশবিধ দশার উদ্ভব হতে পারে। চিন্তা, ঔৎসুক্য, উদ্বেগ-আদি লক্ষণ এই দশ দশারই অন্তর্ভুক্ত। চৈতন্য জীবনে এই দশাগুলোরই পরিচয় পাওয়া যায়, যার কিছু কিছু নিদর্শন গৌরচন্দ্রিকায়ও সহজপ্রাপ্য।


আমাদের পাঠ্যতালিকায় যে কয়টি পূর্বরাগের পদ গৃহীত হয়েছে তাদের মধ্যে একটি পদে (গোবিন্দদাস রচিত 'যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি') কৃষ্ণের পূর্বরাগ বর্ণিত হয়েছে, এ ছাড়া অপর সব কটি পদই রাধার পূর্বরাগে রঞ্জিত। পূর্বরাগের সব পদেই সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রায় এক– কৃষ্ণ দর্শনে অথবা কৃষ্ণকথা শ্রবণে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্য রাধার মনে যে আর্তি সৃষ্টি হয়েছে তাকে কবিরা নিজস্ব উপায়ে প্রকাশ করেছেন। প্রকাশভঙ্গিতে পার্থক্য থাকলেও শ্রীরাধার মনোভাব এবং আচরণে ঐক্যবোধ পরিলক্ষিত হয়। কৃষ্ণের জন্য রাধার মনে জেগেছে চিন্তা, ঔৎসুক্য, উদ্বেগ, ব্যাকুলতা প্রভৃতি এবং বাইরের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে কখনও নীরব ঔদাসীন্য, কখনো বা মুখর চঞ্চলতা। পূর্বরাগের কিছু কিছু পদ থেকে এই বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যাবে।


চণ্ডীদাসের 'সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম' কবিতাটিতে শ্রীরাধিকার শ্যামনাম শ্রবণজনিত পূর্বরাগের পরিচয় পাওয়া যায় নাম নিতে নিতে দেহ ‘অবশ করিল গো' নামের প্রতাপেই যখন এরূপ তখন অঙ্গপরশে ‘যুবতীধরম কৈছে রয়' কৃষ্ণকথা ভুলতে চাইলেও 'পাসরা না যায় গো'— পূর্বরাগের অনেক লক্ষণ ফুটে উঠেছে। চণ্ডীদাসের আর একটি পদে 'রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা'—রাধিকার পূর্বরাগের যে লক্ষণ ফুটে উঠেছে, এইসব লক্ষণ যে কৃষ্ণ-সাধনায় মগ্ন চৈতন্যদেহেও দেখা দিত, একথা চৈতন্যজীবনীকারগণ উল্লেখ করে গেছেন। চৈতন্যজীবনের শেষ স্বাদশ বৎসরের কথা লিখতে গিয়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন

শেষ লীলায় প্রভুর বিরহ উন্মাদ। 

ভ্রমময় চেষ্টা সদা প্রলাপময় বাদ।।

রাধিকার ভাব হৈছে উদ্ভব দর্শনে।

সেইভাবে মণ্ড প্রভু রহে রাত্রি দিনে।।

রাত্রে বিলাপ করে স্বরূপের কণ্ঠ ধরি।

আবেশে আপন ভাবে কহেন উঘাড়ি ৷৷


রাধা-বিরহের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে চৈতন্যদেবের বিরহচিত্র অঙ্কন করলেও প্রকৃতপক্ষে একে কৃষ্ণবিরহ বল্লেও বৈষ্ণব পদের বিরহ এটি নয়। কারণ বৈষ্ণবপদে মিলনের পর বিরহ এবং এর পর আর কখনো মিলন হয়নি। কিন্তু চৈতন্য-জীবন চিরকাল কৃষ্ণসদ্ধানেই ব্যয়িত হয়েছে, কৃষ্ণসঙ্গে মিলনের পর চৈতন্যের বিরহের কথা কল্পনা করা যায় না। কাজেই চৈতন্যদেবের এই যে বিরহের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে মিলন পূর্ব পূর্বরাগের লক্ষণ বলেই ধরে নিতে হয়। চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের পদটিতে রাধার এরূপ আত্মহারা ভাবের চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে -

“বসিয়া বিরলে     থাকয়ে একলে

না শুনে কাহার কথা....

বিরতি আহারে       রাঙা বাস পরে

যেমত যোগিনী পারা....."


রাধামোহন রচিত 'গৌরচন্দ্রিকা'র পদটিতেও গৌরাঙ্গদেবের এই আত্মহারা ভাবের চিত্রই ফুটে উঠেছে -

'আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপ চন্দ

করতলে করই বয়ন অবলম্ব।।

পুন পুন গতাগতি করু ঘর পন্থ।

খেনে খেনে ফুলবনে চলই একাস্ত।।'


পূর্বরাগের লক্ষণ বর্ণনাপ্রসঙ্গে রসশাস্ত্র প্রণেতাগণ যে অশ্রু-গ্বেদ-পুলক কিংবা অস্থিরতা চাঞ্চল্য আদির কথা উল্লেখ করেছেন, এ সমস্ত লক্ষণ বৈষ্ণব কবিতার বিভিন্ন পদে শ্রীরাধার মধ্যে যেভাবে দেখা দিয়েছে, গৌরাঙ্গ চন্দ্রিকাতেও গৌরাঙ্গের মধ্যে এ সমস্ত লক্ষণের পরিচয় পাওয়া যায়।


গোবিন্দদাসের একটি পদে -

‘নীরদ নয়নে     নীর ঘন সিঞ্চনে

পুলক-মুকুল অবলম্ব।

গ্বেদ-মকরন্দ      বিন্দু বিন্দু চুয়ত

বিকশিত ভাব-কদম্ব ।।'

এখানে ‘অশ্রু-স্বেদ' এবং 'পুলকে'-র পরিচয় রয়েছে, পরে—

‘অভিনব হেমকল্পতরু সঞ্চরু'

এবং 'চঞ্চল চরণ কমল তলে’ প্রভৃতিতে অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যের ভাবটিও সুস্পষ্ট।

গোবিন্দদাসের অপর একটি পদে -

‘লহু লহ্ হাসনি      গদ গদ ভাষণি

কত মন্দাকিনী নয়ন ঝরে।'

অনুরূপ ভাব প্রকাশ পেয়েছে। জ্ঞানদাসের পূর্বরাগের পদে (রূপ লাগি আঁখি ঝুরে') রাধার মধ্যেও অনুরূপ চাঞ্চল্য-আদি লক্ষিত হয়। অতএব এ কথা নিঃসংশয়ে স্বীকার করা চলে যে “এই গৌরচন্দ্রিকার শ্রোতার মানস নয়নে যে চিত্রখানি ফুটিয়া ওঠে তাহা পূর্বরাগে ভাবাস্তরিতা রাধার চিস্তা ঔৎসুক্য উদ্বেগের চিত্র।