বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের উদ্ভব

আমাদের দেশে একটা অতি প্রচলিত অভিমত এই যে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অভ্যুদয় ঘটেছিল, তারি সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবস্থায় থাকার ফলেই বৈষ্ণব সাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি। বৈষ্ণব পদাবলীর সৃষ্টি বিষয়ে এই অভিমতটি সমর্থনযোগ্য না হলেও বৈষ্ণব পদাবলীর পুষ্টি-ব্যাপারে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মই যে প্রধান সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পুর্বেই যে এই ধারার সৃষ্টি এবং স্বয়ং চৈতন্যদেবই যে এই বৈষ্ণবপদের রস আস্বাদনে পরম তৃপ্তি লাভ করতেন, এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর জীবনীকারগণ। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন,

'চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি    রায়ের নাটক গীতি

কৰ্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।

স্বরূপ রামানন্দ সনে    মহাপ্রভু রাত্রদিনে

পায় শুনে পরম আনন্দ।।'


শ্লোকে উদ্ধৃত সকলেই - চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, রামানন্দ রায় রাধাকৃষ্ণকে অবলম্বন করে কাব্য ও নাটক রচনা করেছেন, বিল্বমঙ্গল ‘কৃষ্ণকর্ণামৃত' গ্রন্থে এবং জয়দেব গোস্বামী ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যেও রাধাকৃষ্ণের কাহিনীই বর্ণনা করেছেন এবং এগুলি সর্বার্থেই বৈষ্ণবপদ। বাংলাদেশে সর্বাদৌ উল্লেখযোগ্য পদাবলী রচনা করেন জয়দেব গোস্বামী। তিনি গীতগোবিন্দ কাব্যে উল্লেখ করেছেন,–

‘যদি হরিস্মরণে সরসং মনো

যদি বিলাসকলাসু কুতূহলম্। 

মধুর কোমলকাস্ত পদাবলী

শৃণু তথা জয়দেবসরস্বতীম্।।'


“যদি হরিস্মরণে মন সরস হয়, যদি বিলাসকলায় কৌতূহল থাকে তবে জয়দেবকৃত বাণী 'মধুর কোমলকান্ত পদাবলী’ শ্রবণ করে।” বস্তুত ‘পদ’ শব্দটির প্রয়োগ আরও পূর্ববর্তী হলেও প্রকৃতপক্ষে জয়দেব থেকেই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের শুরু ধরতে পারি। তবে তিনি রচনা করেছেন সংস্কৃত ভাষায় এবং এই ঐতিহ্যও অপর কেউ কেউ বয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রকীর্ণ কবিতা ছাড়াও রামানন্দ রায়ের 'জগন্নাথল্লভ নাটক, গোবিন্দদাস কবিরাজের 'সঙ্গীতমাধব', পুরুষোত্তম মিশ্রের 'ধ্রুবগীতি' প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। এগুলি ছাড়াও কয়েকটি সঙ্কলনগ্রন্থ 'কবীন্দ্ৰবচনসমুচ্চয়” বা ‘সুভাষিতরত্নকোষ’, ‘সদুক্তিকর্ণামৃত' প্রভৃতিতেও রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কিছু কিছু শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। রূপ গোস্বামী রচিত 'হংসদূত', 'উদ্ধব-সন্দেশ' এবং 'গীতাবলি' গ্রন্থও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কাব্য। এছাড়াও রূপ গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি – বিদগ্ধমাধব', 'ললিতমাধব', 'ভক্তিরসামৃত সিন্ধু’ ও ‘উজ্জ্বলনীলমণি'। শেষোক্ত গ্রন্থদ্বয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে সর্বাধিক প্রামাণিক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ সমস্তই বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে সংশ্লিষ্ট, তবে সংস্কৃত ভাষায় রচিত।


সংস্কৃত ভাষার বাইরে, যাকে আমরা একালে বৈষ্ণব মহাজনপদ' বলে চিহ্নিত করি, তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে 'অভিনব জয়দেব’ উপাধিধারী কবি বিদ্যাপতি রচিত পদাবলী। বিদ্যাপতি মিথিলার অধিবাসী এবং তিনি বৈষ্ণবপদ রচনা করেছিলেন অবহট্টজাত একটা কৃত্রিম ভাষা ‘ব্রজবুলি'তে। বিদ্যাপতির সমকালেই বাংলায়, উড়িষ্যায় এবং আসামেও ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণবপদ রচিত হতে আরম্ভ করে।


বাংলা ভাষায় রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক প্রথম কাব্য বড়ু চণ্ডীদাস রচিত 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। তবে একে পদাবলী বলা হয় না, এটি আসলে পালাকীর্তন। গ্রন্থটি জয়দেব গোস্বামীর অনুসরণে পরিকল্পিত। তবে গীতগোবিন্দে রাসলীলাই প্রধান বিষয়, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে' বিষয়-বিস্তৃতি ঘটেছে। এর শ্রীকৃষ্ণ জন্ম থেকে তাঁর মথুরা গমন পর্যন্ত ব্রজলীলার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এর প্রধান উপজীব্য রাধাকৃষ্ণ প্রেমকাহিনী। তবে একথা সত্য, 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' পালাকীর্তন হ'লেও এর শেষদিকে কয়েকটি আস্বাদনযোগ্য পদের সন্ধান পাওয়া যায়। এর কোনো কোনো পদসঙ্কলকগণ বৈষ্ণবপদ সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।


চৈতনা-পূর্ববর্তী কবি জয়দেব, বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের পদ চৈতন্যদেব আস্বাদন করতেন ঠিকই, কিন্তু চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে এদের একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। চৈতন্যপুর্ববর্তী পদাবলী সাহিত্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য রসেরই সবিশেষ প্রকাশ ঘটেছে। পক্ষাস্তরে চৈতন্যোত্তর পদসাহিত্য একান্তভাবেই মধুর-রসাশ্রিত। তাছাড়াও, চৈতন্যপূর্ব যুগের বৈষ্ণব সাহিত্যে কবিগণ কবিতার বাহাসৌন্দর্যের প্রতি যতটা দৃষ্টি দিয়েছিলেন, ভিতরের দিকে ততটা দৃষ্টিপাত করেন নি। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব পরবর্তী কবিদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এনেছিল। বিশেষত চৈতন্যদেব নিজেও জয়দেব-বিদ্যাপতি- আদির বর্ণিত রাধাপ্রেমের প্রভাবে পড়ে রাধাভাবের সাধনায় আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন বলে তাঁর জীবনীকাররা উল্লেখ করে গেছেন। অতএব পদাবলী সাহিত্যের সৃষ্টি যে চৈতন্য প্রভাবজাত নয়, তা প্রায় বিনাথিধাতেই স্বীকার করা চলে। কিন্তু চৈতন্যলীলা যে পদাবলী সাহিত্যের পুষ্টিতে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছে, এ কথাও নিঃসন্দেহে বলা যায়।


চৈতন্যদেবের আবির্ভাব সবসময়েই তাঁর ভক্তদের উদ্দীপিত করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই—মুরারি গুপ্ত, ঘোষ ভ্রাতৃত্রয়, নরহরি প্রভৃতি চৈতন্য জীবনকে অবলম্বন করে পদ রচনা শুরু করেছিলেন। তাঁরাই প্রথম চৈতন্যের বাল্যলীলা এবং তাঁর অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ওগোষ্ঠলীলার পদ রচনা করেন। কাজেই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে বাৎসল্য ও সখ্যরসের পদগুলো যে চৈতন্য প্রভাবজাত এবং চৈতন্য-সমকালে ও চৈতন্যোত্তরকালে রচিত হয়েছিল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। চৈতন্য সমকালীন কবি বাসুদেব ঘোষ (বা নরহরি সরকার) যথার্থই বলেছেন যে, গৌরাঙ্গ না হলে শ্রীরাধার প্রেমরসসীমা কেউ জানতে পারত না। বস্তুত পদাবলী সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি যে চৈতনা-আবির্ভাবের ফলেই সম্ভব হয়েছিল, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।