ব্রজবুলি ভাষা সম্পর্কে সবিশেষ বিচারসহ সাধারণভাবে বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিদ্যাপতি থেকে আরম্ভ করে অনেক বাঙালি কবি সুদীর্ঘকাল ‘ব্রজবুলি' ভাষায় বৈষ্ণব পদ রচনা করে গেছেন। শুধুমাত্র বৈষ্ণব কবিতা তথা রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীর বাহন এই ভাষা বলে একসময় সকলেই ধারণা করতেন যে এর ‘বুলি' ব্রজের বুলি-ব্রজ অর্থ মথুরা-বৃন্দাবন, যেখানকার কাহিনী অবলম্বনে বৈষ্ণব কবিতা রচিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই সম্ভবত ঈশ্বর গুপ্ত ‘ব্রজবুলি' শব্দটি ব্যবহার করেন অনুরূপ অর্থে। বৈষ্ণব কবিতার ভাষা দ্বিবিধ—একটা বাংলা অপরটি ব্রজবুলি। ব্রজবুলিতে পদ রচয়িতাদের মধ্যে বিদ্যাপতি সর্বাগ্রগণ্য; তখনও পর্যন্ত বাঙালিদের ধারণা ছিল যে বিদ্যাপতি বাঙালি কবি। কিন্তু তিনি যখন এই অপরিচিত ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন, তখন সাধারণ লোকের ধারণা ছিল—এ ভাষা সম্ভবত ব্রজ অঞ্চলের ভাষা 'ব্রজবুলি', যে অঞ্চলে বর্তমান ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতী রাধিকা। কালক্রমে যখন গবেষণায় প্রমাণিত হল যে বিদ্যাপতি মিথিলার অধিবাসী ছিলেন, তখন অনেকের ধারণা হল, তবে ব্রজবুলি মিথিলারই ভাষা, বাঙালির মুখে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে একটা কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষার রূপ লাভ করেছে। কিন্তু --সর্বাধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ব্রজবুলির ভাষা অবহট্টের একটা কৃত্রিম সাহিত্যিক রূপ মাত্র- এটা কোনো অঞ্চলের ভাষাই নয়। ব্রজের ভাষা ব্রজভাখা বা ব্রজভাষা, যা থেকে হিন্দি ভাষার উৎপত্তি। আর 'ব্রজাওলি বা ব্রজবুলি – অবহট্ট ভাষা থেকে সৃষ্ট একটা কৃত্রিম - সাহিত্যিক ভাষা যার মধ্যে মিশেল ঘটেছে মৈথিল, বাংলা এবং সম্ভবত হিন্দীরও।


মিথিলার কবি বিদ্যাপতিই ব্রজবুলির সর্বাগ্রগণ্য রূপকার হলেও তিনি আদি নন। ব্রজবুলির‌ জ্বাদি লেখক মিথিলারই উমাপতি উপাধ্যায়। তাঁর সবসময়েই অথবা স্বল্প পরেই দেখা যায় যে ব্রজবুলির চর্চা চলছে সমগ্র পূর্বাঞ্চল জুড়েই – বাংলায়, আসামে, উড়িষ্যায়। বাংলায় ব্রজবুলির প্রথম রূপকার যশোরাজ খান তার রচিত 'এক পয়োধর চন্দনে লেপিত / আরে সহজই গোর পদটিই বাঙালি রচিত প্রথম ব্রজবুলি পদের মর্যাদা লাভ করেছে। ত্রিপুরার রাজ-পণ্ডিত জ্ঞানের একটি পদ পাওয়া যায়, তাও পঞ্চদশ শতকের শেষ বা ষোড়শ শতকের প্রথমেই রচিত–

‘প্রথম তোহর প্রেম গৌরব বাড়লি গেলি। 

অধিক আদরে লোভে লুবুধলি চুকলি তে রেতি-খেড়ি।।'


উড়িষ্যায় রায় রামানন্দ কৃত 'পহিলহি রাগ নয়ন ভঙ্গ ভেল' ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদ। আসামে শঙ্করদেবও ব্রজবুলির ভাষায় পদ রচনা করেছেন।


ব্রজবুলি ভাষায় প্রথম সার্থক কবি মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতি। সমসাময়িক যুগে বাংলা দেশ মুসলমান অধিকৃত হলেও মিথিলা ছিল স্বাধীন রাজ্য। তাই বাংলা দেশের বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রয়োজনে মিথিলা যেতেন— মিথিলা ছিল তখন বিভিন্ন শাস্ত্র-আলোচনার প্রধান কেন্দ্র। সেই সূত্রেই সম্ভবত বাঙালিরা মিথিলা থেকে বিদ্যাপতির পদ বাংলা দেশে আমদানি করেছিলেন- এ ঘটনা প্রাক্‌-চৈতন্য যুগের। কারণ চৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতির রচনার একজন শুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন—এ সংবাদ দিয়েছেন চৈতন্যের জীবনীকারগণ। চৈতন্যের কালেও বাংলা দেশে ব্রজবুলির চর্চা তেমনভাবে শুরু হয়নি / চৈতন্যোত্তর কালে, বাংলাদেশে বৈষ্ণব ধর্মের বন্যা দেখা দিল, তখনই রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে অসংখ্য পদ রচিত হতে লাগল। বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজবুলি ভাষায়ও অনেক বৈষ্ণব পদ রচনা করা হল। এ প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখযোগ্য—ব্রজবুলি ভাষা একমাত্র বৈষ্ণব পদেই সার্থকভাবে প্রযুক্ত হয়েছিল। এর বাইরে অর্থাৎ বৈষ্ণব পদ ছাড়া যে অপর কোনো বিষয় ব্রজবুলিতে রচিত হয়নি, তেমন নয়। ভারতচন্দ্র এবং রামপ্রসাদও ব্রজবুলিতে মাতৃসঙ্গীত রচনা করেছিলেন, কিন্তু সেগুলি কখনও জনসাধারণের দ্বারা আদৃত হয়নি।


বাংলাদেশে ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের শিরোমণি—গোবিন্দদাস। গোবিন্দদাস সর্ববিধ পর্যায়ের পদেই ব্রজবুলি ব্যবহার করেছেন। গোবিন্দদাস ছাড়াও যে সকল বাঙালি কবি ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন, - বলরাম দাস, শেখর, রাধামোহন, অনস্তদাস, যদুনন্দন, রায়শেখর, নরোত্তম দাস, নরহরি দাস, ভূপতি, কবিবল্লভ, বংশীদাস প্রমুখ। কবি জ্ঞানদাসও ব্রজবুলিতে কিছু পদ রচনা করেছেন, কিন্তু তার রচিত ব্রজবুলির পদ খুব সার্থকতা অর্জন করতে পারেনি।


রোম্যান্টিক গীতিকবিতা রচনার পক্ষে ব্রজবুলি খুবই উপযোগী ভাষা। ব্রজবুলিতে যুক্তব্যঞ্জনের ব্যবহারের ন্যূনতা, নাসিকাযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির আধিক্য এবং স্বরধ্বনির বাহুল্য স্বাভাবিকভাবেই কবিতার মাধুর্য বাড়িয়ে দেয়। ব্রজবুলির স্বরাস্ত উচ্চারণ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রুদ্ধদল, দীর্ঘস্বর ও যৌগিক স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ ব্রজবুলিতে যে ছন্দোহিল্লোল জাগিয়ে তোলে, তা একটি উপরি পাওনা।


ব্রজবুলি একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা, এই ভাষা মানুষের নিত্য ব্যবহারের দ্বারা উচ্ছিষ্ট নয়। অতএব আরাধ্য দেবতার সেবায় এ ভাষার নিয়োগই সর্বাধিক উপযোগী— এ রকম একটা মনোভাব ভক্ত বৈষ্ণব কবির মনে থাকা বিচিত্র নয়। এই কারণেও রাধাকৃষ্ণের প্রেমসঙ্গীত রচনায় ব্রজবুলির প্রতি কবিদের পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে।


কবিশেখর কালিদাস রায় ব্রজবুলির ব্যবহার সম্বন্ধে বলেন “কীর্তন সঙ্গীতের রসমূর্ছনা ও সুরের অলঙ্করণে বাংলা অপেক্ষা ব্রজবুলি অধিকতর উপযোগী বলিয়া বোধ হয় কবিরা ব্রজবুলিতে পদ রচনা করিতেন।”


এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে, সম্ভবত ব্রজবুলি ভাষার মাধুর্য দ্বারা আকৃষ্ট হয়েই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও প্রথম জীবনে ব্রজবুলিতে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে 'ভানুসিংহের পদাবলী' নামে কয়েকটি পদ রচনা করেছিলেন। ব্রজবুলিতে রচিত পদের ব্যবহারের এইটিই শেষতম নিদর্শন।


ব্রজবুলিতে তৎসম শব্দ ব্যবহারের বাহুল্য লক্ষ্য করা যায়। এর একটা কারণ এই হতে পারে যে, ব্রজবুলিতে মোটামুটি সংস্কৃত ধ্বনিপ্রকৃতি বজায় ছিল যথা দীর্ঘ স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ, পদাস্তে 'অ' কারের উচ্চারণ প্রভৃতি— এ সমস্ত তৎসম শব্দেই ব্যবহারোপযোগী। তদ্ভব শব্দ যথেষ্ট ব্যবহহৃত হত। দেশি শব্দ ব্যবহার কম, তবে ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার আছে। বিদেশি শব্দের মধ্যে কিছু কিছু আরবি ফরাসি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, যেমন- আতর, কলম, কাগজ, চাকর, মালিশ, বাজার প্রভৃতি, তবে এদের ব্যবহার অতিশয় সীমিত।


ব্রজবুলিতে মোটামুটিভাবে সংস্কৃত স্বরধ্বনির উচ্চারণ বজায় থাকলেও মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমও দেখা যায়। হ্রস্বদীর্ঘ উচ্চারণ সাধারণভাবে মেনে চলা হলেও কখন কখন বিপর্যয় ঘটতো। অনেক সময়, স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটতো। যথা— আষাঢ়>অষাঢ়, যমুনা>যামুন, রুচী>রুচ, ভাগ্য>ভাগ, ভাগি, স্নেহ>সিনেহ, কীর্তি>কিরিতি।


যুগ্ম বাঞ্জন সরল হলেও অনেক সময় পূর্বস্বর দীর্ঘ হত না। উত্তর>উত্তর, ছদ্ম>ছদ। স্বরমধ্যগত মহাপ্রাণ ধ্বনি 'হ'-কারের পরিণত হত। মেঘ>মেহ, শোভা>সোহা। মৈথিলির প্রভাবে 'ক্ষ' স্থলে 'খ'-এর ব্যবহার বর্তমান ছিল। প্রাবৃষ>পাউখ, রোষ>রোখ। শব্দরূপ সাধারণভাবে অস্ত্যমধ্যযুগের বাংলার মতোই ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য পরিবর্তন দেখা যায়। ব্রজবুলিতে সর্বনামের বহুবচন পদ দুর্লভ।


ব্রজবুলিতে যৌগিক কালো ব্যবহার নেই। মৌলিক বর্তমান, শত্রুর্থ বর্তমান, নিষ্ঠান্ত অতীত, কৃৎ-যুক্ত ভবিষ্যৎ, বর্তমান অনুজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার রূপ পাওয়া যায়। অসমাপিকা ক্রিয়া— ‘ই, ইয়া, ইতে' প্রভৃতি। নামধাতু প্রভৃতি ব্যবহার ব্রজবুলিতে বর্তমান।


ব্রজবুলির ছন্দ মাত্রামুলক। আমরা একালে এ জাতীয় ছন্দকে বলি ‘প্রত্নমাত্রাবৃত্ত। বাংলা ভাষায় লিখিত প্রাচীনতম কাবা চর্যাপদেও এ জাতীয় ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ জাতীয় ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য—এতে সংযুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্বস্বর এবং হসস্ত বর্ণের পূর্বস্বর দীর্ঘ তথা দ্বিমাত্রক হত। এ ছাড়া যৌগিক বা দীর্ঘস্বরও প্রায়শ দ্বিমাত্রক হত তবে এর ব্যতিক্রমও যথেষ্ট ছিল।