'রাধা কৃষ্ণের প্রেমগীতিকায় ভক্তিরসের সঙ্গে একটি পরিচিত মর্ত্যধরণীর মেদুর স্পর্শ রহিয়াছে।” বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন রস পর্যায়ের পদ অবলম্বনে মন্তব্যটির যাথার্থ বিচার করো।

বৈষ্ণব পদাবলীতে আধ্যাত্মিকতা বনাম বাস্তবতা 

‘শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান?'


বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সমগ্র প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর কোনো তুলনা নেই। বস্তুত প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই একটিমাত্র শাখাই বিশ্ব সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত হবার যোগ্যতা রাখে। অথচ বৈষ্ণব সাহিত্য নিঃসন্দিগ্ধ ভাবেই গোষ্ঠীচেতনা সমৃদ্ধ ধর্মীয়, কিংব৷ আরও খুঁটিয়ে বলতে গেলে সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। অতএব অতি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে, যে পদাবলী একটি সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মীয় সাধনারই অঙ্গ বিশেষ, কোন্ গুণে এমনভাবে তাকে সর্বজনীন স্বীকৃতি দান করা হয়। বিষয়টি একটু বিচার করে দেখা আবশ্যক।


চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব বাংলাদেশে তথা বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের একটা বিশিষ্ট রূপ ও রীতির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রবক্তা। তাঁর প্রবর্তিত এই ধর্মদর্শনকে বলা হয় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মদর্শন। বৈদিক ধর্মের বিরোধিতায় যে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব, যুগাবতার শঙ্করাচার্য বৈদান্তিক মতবাদ দ্বারা সেই বৌদ্ধধর্মের প্রায় উচ্ছেদ সাধন করেন এবং বৈদাস্তিক অদ্বৈতবাদই প্রায় সমগ্র ভারত ভূমিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং দীর্ঘকাল সুপ্রচলিত থাকে। কিন্তু ভক্ত দার্শনিকগণ অদ্বৈতবাদকে অস্বীকার করে দ্বৈততত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। এই দ্বৈতবাদীদের মধ্যে আছেন রামানুজ, মধ্বাচার্য, বল্লভাচার্য, নিম্বার্ক প্রমুখ। এই ধারারই শেষ উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা -মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। তবে চৈতন্যদেব পুরোপুরি দ্বৈতবাদকে স্বীকার করেননি, তিনি উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে প্রতিষ্ঠা করেন 'অচিস্তা ভেদাভেদ তত্ত্ব'-র। এখানে ব্রহ্মাকে সত্য এবং জগৎকেও সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু দুয়ের অভেদই যে চরম সত্য, একথাও বলা হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মূল কথা—সত্য ব্রহ্ম স্বহৃদয়ের লীলা আস্বাদন করবার জন্য জীব সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু এই দ্বৈত ভাব চিরস্থায়ী নয়– জীবের সঙ্গে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা তার - মধ্যে নিয়ত বর্তমান। ফলত অনুক্ষণ জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে মিলনের সযত্ন বেদনাঘন প্রয়াস দেখা দেয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই ব্রহ্ম আর শ্রীমতী রাধিকা জীবের স্বরূপে আবির্ভূত। শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা— যিনি নিয়ত জীবকে আকর্ষণ করেছেন, জীবাত্মার অনুকল্প রাধিকা যিনি পরমাত্মার সঙ্গে সাযুজ্য লাভের নিমিত্ত সর্বক্ষণ আরাধনায় রত।


রাধাকৃষ্ণের লীলাবৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে অনুক্ষণ পরমাত্মা ও জীবাত্মার লীলাখেলা চলছে এই আধ্যাত্মিক তত্ত্বটিকেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় বৈষ্ণব পদাবলীর মূল সুর বলে বিশ্বাস করেন। এবং তাদের মনে এই বিশ্বাসও বদ্ধমূল যে পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরাধিকার ভাবযুক্ত হয়ে (“রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত তনু') শচীনন্দন গৌরাঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, উদ্দেশ্য- রাধার কৃষ্ণপ্রেমের স্বরূপ স্বদেহ দ্বারা আস্বাদন।


‘শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীদুশো বানয়ৈবাস্বাদ্যো 

যেনাদ্ভূতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়ঃ।

সৌখ্যঞ্চস্যা মদনুভবতঃ কীদুশং বেতি লোভাত্তদ্ভাবাঢ়ঢ্যঃ 

সমজনি শচীগর্ভসিদ্ধৌ হরীন্দুঃ ।।


(শ্রীরাধিকা যে প্রেম দ্বারা আমার অদ্ভুত মধুরিমা আস্বাদন করেন, সেই প্রেমের মহিমাই বা কীরূপ, সেই প্রেম দ্বারা শ্রীরাধা কর্তৃক আস্বাদিত আমার অদ্ভুত মাধুর্য ও তার আস্বাদনই কীরূপ এবং আমাকে অনুভব করে শ্রীরাধার সুখই বা কীরূপ— এই লোভের বশীভূত হয়েই শ্রীকৃষ্ণ শচীগৰ্ভসিন্ধুতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।)


এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই বৈষ্ণব কবিগণ বৈষ্ণব পদাবলীর সহায়তা গ্রহণ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আনন্দসত্তার উৎস থেকে উদ্ভুত হ্লাদিনী শক্তিই রাধা, অতএব কৃষ্ণ থেকে পৃথক্‌ নন। তাদের এই দ্বৈত ভূমিকা লীলা আস্বাদনের জন্যই উভয়ের মিলনে সমস্ত লীলার অবসান ঘটে।


বৈষ্ণব পদাবলীতে যে বিভিন্ন ইঙ্গিতের সাহায্যে এই আধ্যাত্মিক তত্ত্বই ব্যাখ্যাত হয়েছে, বিভিন্ন দিক্‌ থেকেই তা প্রমাণ করা যায়। যেমন, অভিসারের পদগুলো বিশ্লেষণ করলেই মনে হয়, নায়িকার দুর্গম পথে এই অভিসার বস্তুত পূর্ণতার প্রতি অসীমের প্রতি, জীবাত্মা যেন সমস্ত বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে চাইছে। ভণিতায় কবিরা শুধু নিজেদের নামটি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরাও যে রাধাকৃষ্ণ লীলার অংশগ্রহণকারী সহচর বা সহচরী এ তথ্য প্রায় সর্বত্র উল্লিখিত। এ লীলা নিশ্চয়ই কোনো মর্ত্যলীলা নয়, কারণ সেখানে স্বদেহে কবিদের উপস্থিতি সম্ভব নয়। অতএব তারাও আধ্যাত্মিকতাকে মেনে নিয়েই পদ রচনা করেছেন। রূপানুরাগের পদগুলোতে যে রূপের বর্ণনায় শ্রীমতীর মুগ্ধাবস্থা, তা তো কোনো দেহে সীমাবদ্ধ নয়, দেহকে অতিক্রম করে সে রূপ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রাধা বলেন, 'দিক্‌ নেহারিতে সব শ্যামময় দেখি। এতো সুস্পষ্টভাবেই লোকাতীতের ইঙ্গিত।


রূপের মধ্য দিয়েই যে অরূপের সাধনার ব্রতী ছিলেন বৈষ্ণব কবিগণ, সে কথা রবীন্দ্রনাথ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন অসীমকে সীমার মধ্যে আনিয়া ভক্ত তাহাকে উপলব্ধি করিয়াছেন। আকাশ যেমন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ হইয়াও অসীম এবং আকাশই, সেইরূপ রাধাকৃষ্ণের মধ্যে পরিচ্ছিন্ন হইয়াও অসীম ব্ৰহ্মই আছেন। মানবমনে অসীমের সার্থকতা সীমাবন্ধনে আসিয়া তাহার মধ্যে আসিলেই অসীম প্রেমের বস্তু হয়। নতুবা প্রেমাস্বাদ সম্ভবই নয়। অসীমের মধ্যে সীমাও নাই, প্রেমও নাই। সঙ্গীহারা অসীম সীমার নিবিড় সঙ্গ লাভ করিতে চায় প্রেমের জন্য প্রশ্নোর কৃষ্ণরূপ ও রাধারূপের মধ্যে এই তত্ত্বই নিহিত। অসীম ও সীমার মিলনের আনন্দই পদাবলী রূপ ধরিয়াছে সৃষ্টিতে সার্থক হইয়াছে।"


অতএব বৈষ্ণব পদাবলীর যে আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যে পদাবলী রচনার পশ্চাতে রয়েছে একটা গোষ্ঠীচেতনায় উদ্বুদ্ধ সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতাবোধ তা' এমন করে দেশ কালকে অতিক্রম করে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করলে। কী করে? বিদেশীয়রা এর অনুবাদ পাঠে মুগ্ধতা লাভ করেন, বাঙালি মুসলমান কবিরাও রাধা কৃষ্ণের অবলম্বনে পদ রচনা করেন এর এমন কী গুণ আছে?


বৈষ্ণব কবিতার লীলারস আধ্যাত্মিকতাযুক্ত হলেও নরদেহে সেই রস আস্বাদনের জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধাভাবযুক্ত শ্রীগৌরাঙ্গ রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অতএব এখানে দেববাদ এবং অলৌকিকতা বর্জিত হয়ে অপ্রাকৃত প্রেম প্রাকৃতপ্রেম তথা মানবীয় প্রেমে রূপান্তরিত হল। ভন্ডেলা দৃষ্টিতে যিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে বিচার করতে অসমর্থ, তিনিও নন্দনন্দন কৃষ্ণ ও গোপবালা রাধার প্রেমের বিচিত্র লালা থেকে রস আহরণ করতে সমর্থ। বৈষ্ণব পদাবলী মধুর রসের কাব্য প্রধানত বাৎসল্য, সখ্য এবং মধুর ভাবই এর প্রধান উপাদান, এমনকি দাস্যভাবও প্রায় অনুপস্থিত, অতএব এর মানবিক আবেদনে যে সার্বজনীনতার ভাব রয়েছে, তা কোথাও প্রচ্ছন্ন নয়। সুতরাং যে-কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষেই বৈষ্ণব পদাবলীর সর্ববিধ রস আস্বাদনে অপরাঙ্মুখ থাকাই স্বাভাবিক। চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব সাহিত্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাব একেবারে তিরোহিত, অতএব কোনো ধর্মীয় সংকীর্ণতাও একে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বৈষ্ণব পদের এই ধর্মনিরপেক্ষতাই‌ একে সর্বজনের নিকট আদরণীয় করে তুলেছে।

‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া    মরমে পশিল গিয়া

আকুল করিল মোর প্রাণ।।


প্রিয়-বিরহে নায়িকার এই যে আকুলতা, প্রিয় নামটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুচ্চুম্বকের মতোই যে কানের ভিতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে, এ বোঝবার জন্য বৈষ্ণব হবার প্রয়োজন নেই, কোনো তত্ত্বে দীক্ষা নেবার প্রয়োজন নেই, নিখিল বিশ্বের যে কোনো কালের, যে-কোনো দেশের যে-কোনো বিরহিণী নারীই এই সত্যটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করে থাকে। কাজেই এই যে প্রেমের চিত্র–পরমভক্ত বৈষ্ণব কবি এঁকে থাকলেও এ চিত্র একেবারে খাঁটি বাস্তব চিত্র–দেশকালাতিশ্রয়ী ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতাবোধসম্পন্ন এই বৈষ্ণব পদাবলীর রসে কোনো প্রকার খাদ নেই। এই কারণেই এর সর্বজনীন আবেদনে যে কোনো পাঠকই সাড়া দিয়ে থাকেন, এর জন্য ভক্ত বৈষ্ণব হবার প্রয়োজন নেই।


চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব পদাবলীর একটা তত্ত্বকে আশ্রয় করে গড়ে উঠলেও রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী নিয়ে অজস্র পদ এবং কাব্য রচিত হয়ে আসছে অতি প্রাচীনকাল থেকেই। চৈতনা পূর্ববর্তী এ সমস্ত রচনায় আধ্যাত্মিকতা কিংবা কোনো তত্ত্বকথা থাকবার সম্ভাবনা নেই। এ একান্তভাবেই ব্রজের লীলা— সম্ভবত কোনো লৌকিক বাস্তব কাহিনীর আধারেই এর উদ্ভব। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষায় বহু গ্রন্থবদ্ধ এবং প্রকীর্ণ প্রেমকবিতা রচিত হয়েছিল। চৈতনা পূর্ব বৈষ্ণব কবিতায় এরই অনুসরণ ঘটেছে। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতির অসংখ্য পদ এবং জয়দেব গোস্বামী কৃত 'গীতগোবিন্দ' নাট্যকাব্যে কিছু কিছু ঐশ্বর্যভাবের পদ পাওয়া গেলেও এদের মধ্য থেকে আধ্যাত্মিকতা টেনে বার করবার প্রয়োজন হয় না। তারও পূর্ব থেকেই সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষায় অনেক কবিই রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায় অবলম্বন করে অনেক পদ রচনা করে গেছেন—যাদের ওপর গৌড়ীয় তত্ত্ব আরোপের কোনো অবকাশ নেই। প্রাচীনকালের রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক কবিতাগুলোতে ধর্মীয় প্রেরণাই মূলকথা। অতএব বৈষ্ণব কাব্যমাত্রই যে আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এমন কথা কিছুতেই স্বীকার করা যায় না। একে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রাকৃত বাস্তব পটভূমিতে রেখে বিচার করলেও এর রসাস্বাদনে কিংবা অর্থগ্রহণে কোনো অসুবিধে হয় না। অনেকেই রাধা-কৃষ্ণলীলাকে 'রাখালিয়া গীতি' বা pastoral song নামে অভিহিত করেন। এই ক্ষেত্রে একে সম্পূর্ণভাবেই মানবিক কাব্য বলে গ্রহণ করা চলে।


আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে একদিক থেকে যেমন আধ্যাত্মিকতার পরিচয় পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি এর ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক আবেদনের পরিচয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। বৈষ্ণব পদাবলী এক ধরনের গীতিকবিতা—ব্যক্তিহাদয়ের অনুভূতি থেকেই এর উদ্ভব সম্ভবপর। অথচ গোষ্ঠীচেতনায় উদ্বুদ্ধ বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা এর রচনা কিভাবে সম্ভবপর হল? প্রশ্নটা তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ।


রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী' নামক কাব্যগ্রন্থে 'বৈষ্ণব কবিতা' নামক কবিতাটির প্রথম পক্তিতেই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছেন – শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান।—এখানে তিনি এর আধ্যাত্মিক দিক্‌টা স্বীকার করে নিয়েই প্রশ্ন করেছেন—'শুধু কি তাই, আর কিছু নয়। তবে কেন ‘শুনি সেই সুর/ সহসা দেখিতে পাই দ্বিগুণ মধুর / আমাদের ধরা' বৈকুণ্ঠের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এই বৈষ্ণব প্রেমগাথা নিয়ে ‘মধ্যপথে নরনারী / অক্ষয় যে সুধারাশি করি কাড়াকাড়ি / লইতেছে আপনার প্রিয়গৃহতরে – সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবিতায় কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছোঁয়া না থাকলে অপর ব্যক্তি-হৃদয়ে এমন করে আগুন জ্বালায় কী করে। কবিসার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের চেয়ে এ সত্যকে অনুভব করবার ক্ষমতা এ যুগে আর কারো থাকা সম্ভব নয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যক্তিগত প্রেমের অনুভূতি ছাড়া হৃদয়সংবেদ্য কাব্য রচনা কখনও সম্ভবপর নয়। তাই তিনি যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তার উত্তরও তিনি খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতি দিয়েই এমন বৈষ্ণব পদ রচনা সম্ভব নয়, যা অপর যে কোনো পাঠকের মনে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বেদনাকে স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। তাই এবার তার প্রশ্ন— বৈষ্ণবকবিগণ এই প্রেমমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেছিলেন কোথায়, কার কাছ থেকে?

‘সতা করে কহ মোরে হে বৈষ্ণবকবি,

কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি, 

কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান বিরহ-তাপিত।

হেরি কাহার নয়ান,

রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে।

বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে

কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে, 

আপনার হাদয়ের অগাধ সাগরে 

রেখেছিল মগ্ন করি!'


রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে কোনো লুকোচাপা নেই। তিনি স্পষ্টতই অনুমান করেছেন যে, ব্যক্তিগত প্রেমের অনুভূতি থেকেই বৈষ্ণব পদগুলো রচিত হয়েছে আধ্যাত্মিকতা এর ওপর আরোপিত। এবং এইজন্যই বৈষ্ণব তত্ত্বেও মানবিকতার আধারটুকু অটুট রাখা হয়েছে। বৈষ্ণবীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিচারেও বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা 'ছায়া-সহচরী মানবী নারীকে একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই কায়া ও ছায়া অবিনাবদ্ধভাবে একটা মিশ্ররূপের সৃষ্টি করিয়াছে।”


রবীন্দ্রনাথের অনুমানের সমর্থনে এবার কিছু লোকশ্রুতির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে, কারণ 'মহামূলা জনশ্রুতিঃ – লোকশ্রুতি অমূলক হয় না। বাংলার তিন শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কবি– জয়দেব, বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস। বৈষ্ণবচূড়ামণি স্বয়ং মহাপ্রভু চৈতন্যদেব এঁদের পদের রসাস্বাদন করে তৃপ্তি পেতেন। লোকশ্রুতি- এদের প্রত্যেকেরই একজন করে সাধন-সঙ্গিনী ছিলেন; জয়দেবের পদ্মাবতী বিদ্যাপতির লছমী এবং চণ্ডীদাসের রজকিনি রামী। এই সাধক-সঙ্গিনীদের সপ্রেম কামনাই উক্ত বৈষ্ণব কবিদের বর্ণিত রাধাকৃষ্ণ প্রেমকে নিষ্কাম 'নিকষিত প্রেমে' রূপান্তরিত করেছি ভাবতে পারলে সবই ব্যাখ্যাত হয়ে যায়।