কীভাবে স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয় | ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে কী প্রভাব ফেলেছিল?

স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

[1] জিওনবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে: ইজরায়েলের রাজা সলােমনের মৃত্যুর বহুদিন পর হিব্রু রাজ্যটি জুদাহ ও ইজরায়েল এই দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রােমানরা ইহুদিদের এখান থেকে বিতাড়িত করলে ইহুদিরা ইউরােপের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মনে নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা সুপ্ত থাকে। উনিশ শতকে এই ইচ্ছা মাথাচাড়া দেয়, যা জিওনবাদ নামে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ড. ওয়েইজম্যানের প্রচেষ্টায় জিওনবাদী আন্দোলনের তীব্রতা চরমে পৌছােয়।


[2] আরব লিগ গঠনের দ্বারা: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সাতটি আরব রাষ্ট্র (মিশর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, ট্রান্স-জর্ডন, সৌদি আরব) একত্রিত হয়ে কায়রােতে আরব লিগ গঠন করে প্যালেস্টাইনের ওপর ব্রিটিশ অছি উচ্ছেদের দাবি জানায়।


[3] জাতিপুঞ্জের প্রস্তাব মেনে: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জাতিপুঞ্জের সাধারণসভা প্যালেস্টাইন সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ১১টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে এক বিশেষ কমিটি গঠন (UNSCOP বা United Nations Special Committee on Palestine) করে। কমিটির অধিকাংশ সদস্য প্যালেস্টাইনকে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করার পক্ষে মত দিলে জাতিপুঞ্জের সাধারণসভায় তা গৃহীত হয় (২৯ নভেম্বর, ১৯৪৭ খ্রি.)।


[4] আফ্রিকা ও এশিয়াবাসীর সমর্থনের সূত্রে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইহুদি নেতৃবৃন্দ প্যালেস্টাইন বিভাজনের প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। কিন্তু আরব দেশগুলির সঙ্গে একযােগে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অধিবাসীরা এর বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়। নানা স্থানে সংঘর্ষ শুরু হয়। অন্য দিকে দলে দলে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করতে থাকে। ক্রমেই অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।


[5] স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠা: ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে আন্তর্জাতিক ইহুদি সংস্থার সভাপতি ডেভিড বেন গুরিয়ন স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেন, যার রাজধানী করা হয় তেল আভিভকে। ড. ওয়েইজম্যান ও বেন গুরিয়ন যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।


মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলের জন্মের প্রভাব


[1] ফিলিস্তিনিদের দুর্দশায়: প্রতিষ্ঠা লগ্নেই আরব শক্তিজোটের সঙ্গে ইজরায়েলের যে যুদ্ধ বাধে, তাতে সকলকে অবাক করে দিয়ে ইজরায়েল জয়লাভ করে। লােহিত সাগরের ওপর মিশরের এইলাট বন্দর-সহ প্যালেস্টাইনের তিন-চতুর্থাংশ এলাকায় ইজরায়েল তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনি গৃহহারা হয়ে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ফিলিস্তিনিদের এই দুর্দশা ইজরায়েনের প্রতি মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব দুনিয়ার বিদ্বেষ আরও বাড়িয়ে তােলে।


[2] আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট গঠনে: জর্ডনে শরণার্থী ডা. জর্জ হাবাশ সফলভাবে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তােলেন আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট নামে এক সংস্থা।


[3] আল ফাতাহ প্রতিষ্ঠায়: ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে কায়রাে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন ছাত্র ফিলিস্থিনি যুবক ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে কুয়েতে আল ফাতাহ্ নামে এক সংগঠন গড়ে তােলেন। আরবি শব্দ ফাতাহ র অর্থ সাফল্য। প্যালেস্টাইনের মুক্তি আনাই ছিল এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য।


[4] প্যালেস্টাইন মুক্তিমােরচা গঠনে: ১৯৬৪ খ্রি. প্যালেস্টাইনের আরব জাতীয়তাবাদীরা প্যালেস্টাইন মুক্তিমাের্চা বা পি. এল. ও. (Palestine Liberation Organization) গঠন করেন। এই সংগঠনেরও উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের হাত থেকে প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করা। উল্লেখ্য ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে আল ফাতাহ্ সংগঠনটি এটির সঙ্গে মিশে যায় এবং ১৯৬৯ খ্রি. আল ফাতাহ্ নেতা ইয়াসের আরাফত পি. এল. ও.র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।


[5] আল সাইকা ও আরব লিবারেশন ফ্রন্ট গঠনে: বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ সংগঠনের মাধ্যমে ইজরায়েল-বিরােধী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। সিরিয়া গড়ে তােলে আল সাইকা সংগঠন এবং ইরাক গঠন করে আরব লিবারেশন ফ্রন্ট।


[6] সুয়েজ সংকট: প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর ইজরায়েল ও তার সহযােগী পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে মিশরের নেতৃত্বাধীন আরব রাষ্ট্রগুলির সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটায় সুয়েজ খাল বিতর্ক। এই সুয়েজ সংকটেরই পরিণতি দ্বিতীয় আরব ইজরায়েল যুদ্ধ।