বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি তা আলােচনা করাে।

সূচনা: বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে নির্জোট আন্দোলন কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের ধারণায়, ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নির্জোট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ছিল, তাই তা অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রয়ােজনীয়তা ফুরিয়েছে। কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন, ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হলেও বর্তমান বিশ্বে যে সমস্ত সমস্যার উদ্ভব ঘটে চলেছে, সেগুলির সঠিক সমাধানের জন্য আজও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রয়ােজন রয়েছে।


বর্তমানে নির্জোট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা


জোটনিরপেক্ষতার পক্ষে যুক্তি


  • মানবাধিকার রক্ষা: বর্তমান বিশ্বে তথাকথিত দরিদ্র দেশগুলির মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সূচনালগ্ন থেকেই জাতিপুঞ্জের ভেতরে ও বাইরে একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে নির্জোট আন্দোলন মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। আজও তাই বিশ্বের দরিদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলির মানবাধিকার রক্ষার জন্য নির্জোট আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।


  • শান্তি-প্রতিষ্ঠা: বর্তমান বিশ্ব আণবিক মারণাস্ত্রের ভয়ে সদা ভীত ও সন্ত্রস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ কয়েকটি দেশ আণবিক অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে তথাকথিত দুর্বল দেশগুলিকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। শুধু তাই নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আমেরিকা আণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণ রােধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করানাের জন্য আর্থিক ও সামরিক বিভিন্ন দিক থেকে চাপে রেখেছে। এই মার্কিনি চাপকে উপেক্ষা করে সমগ্র বিশ্বে প্রকৃত শান্তির বাতাবরণ গড়ে তােলার জন্য আজও নির্জোট আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা ফুরােয়নি।


  • আর্থিক বৈষম্য: উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষম্যের ব্যবধান দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথম থেকেই নির্জোট আন্দোলন জাতিপুঞ্জের আর্থিক কর্মসূচিকে সর্বত্রভাবে উন্নয়নমুখী করে তােলার কাজে সচেষ্ট থেকেছে। যেহেতু এই আর্থিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান, তাই তা মােচনের জন্য নির্জোট আন্দোলন আজও প্রাসঙ্গিক।


  • মানবকল্যাণ: নির্জোট আন্দোলন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক সমস্যা, পরিবেশ সংরক্ষণ, মাদকাশক্তির প্রতিরােধ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে সার্বিক মানবকল্যাণের দাবিতে সরব হয়। সার্বিক মানবকল্যাণ আজও অধরা থেকে গেছে। তাই সার্বিক মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্জোট আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা আজও রয়েছে।


জোটনিরপেক্ষতার বিপক্ষে যুক্তি


  • মার্কিন একাধিপত্য: ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন দ্বিমেরুকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জোট সদস্য রাষ্ট্রগুলি সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় শিবিরের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক দরকষাকষির সুযােগ পেত। কিন্তু সােভিয়েতের পতনের পর এই দরকষাকষির সুযােগ নষ্ট হয়। আর্থিক, সামরিক-সহ বিভিন্ন দিক থেকে সুযােগসুবিধা লাভের প্রশ্নে মার্কিন সাহায্যই একমাত্র ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই প্রেক্ষিতে নির্জোট আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক বলা চলে।


  • নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব: একদা জওহরলাল নেহরু, আবদুল গামাল নাসের, জোশেফ ব্রোজ টিটো, সুকর্ন, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি, শ্রী রাজীব গান্ধি, শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, সিরিমাভাে বন্দরনায়েকে, কেনেথ কাউন্ডা প্রমুখ নেতৃবর্গ নির্জোট আন্দোলনকে যে স্তরে উন্নীত করেছিলেন তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন পরবর্তী নেতৃবর্গ। স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলির দ্বন্দ্ব ও অনৈক্য বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্জোট আন্দোলনকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।


  • লক্ষ্যগত ও কৌশলগত পরিবর্তনের অভাব: নির্জোট আন্দোলনের উদ্ভবকালে বিশ্বে যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব (রুশ সাম্যবাদ ও মার্কিন পুঁজিবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব), উপনিবেশ বিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামসমূহ প্রভৃতির সমাধান জরুরি ছিল সেগুলির মীমাংসা হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে পরিবর্তনশীল বিশ্বে আর্থিক দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাসবাদ, সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণ প্রভৃতি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।


উপসংহার: শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমাধানের জন্য যে লক্ষ্যগত ও কৌশলগত পরিবর্তনের দরকার ছিল তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে সাম্প্রতিক নির্জোট আন্দোলন। তাই স্বতন্ত্র মঞ হিসেবে নির্জোট আন্দোলনও তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।


বিশ্বে জোটনিরপেক্ষতার বিকাশে বেলগ্রেড, কায়রাে, লুসাকা ও আলজিয়ার্স সম্মেলনের ওপর সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।


কলম্বাে সম্মেলন (১৯৭৬ খ্রি.), হাভানা সম্মেলন (১৯৭৯ খ্রি.), নতুন দিল্লি সম্মেলন (১৯৮৩ খ্রি.) এবং হারারে সম্মেলনের (১৯৮৯ খ্রি.) ওপর সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।


বেলগ্রেড সম্মেলন (১৯৮৯ খ্রি.) থেকে পরবর্তী শারম-এল-শেখ পর্যন্ত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনগুলির প্রসার আলােচনা করাে।