বিশ্বে জোটনিরপেক্ষতার বিকাশে বেলগ্রেড, কায়রাে, লুসাকা ও আলজিয়ার্স সম্মেলনের ওপর সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।

ভূমিকা: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রসারে বেলগ্রেড সম্মেলন এবং তার পরবর্তী কায়রাে, লুসাকা, আলজিয়ার্স প্রভৃতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।


কায়রাে সম্মেলন

আয়ােজন: ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ৫ অক্টোবর কায়রাে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা চলে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত।


অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ: এই সম্মেলনে বিশ্বে ৪৭টি দেশ অংশ নেয়। এই কায়রাে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ইজিপ্ট বা সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের।


গৃহীত সিদ্ধান্ত: কায়রাে সম্মেলনে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেমন-

  • শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং জোটনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী দেশগুলি স্বাধীনভাবে বিদেশনীতি পরিচালনা করবে।

  • জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানাবে।

  • ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাবে গড়ে-ওঠা কোনাে ধরনের সামরিক জোটেই জোটনিরপেক্ষ কোনাে দেশ অংশ নেবে না।


গুরুত্ব: কায়রাে সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলিকে, বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবিদ্বেষমূলক নীতি, আণবিক অস্ত্র ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়গুলির অবসানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।


লুসাকা সম্মেলন


আয়ােজন: ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় তৃতীয় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন বসে, যা শেষ হয় ১০ সেপ্টেম্বর।


অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ: এই সম্মেলনে যােগ দেয় ৫৪টি দেশ। সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন জাম্বিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কেনেথ কাউন্ডা।


গৃহীত সিদ্ধান্ত: লুসাকা সম্মেলনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংকট নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন-

  • এই সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরােধিতা করে অত্যাচারীদের প্রতি সমর্থন জানানাে হয়।

  • ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে শান্তি অঞ্চল (Zone of Peace) হিসেবে ঘােষণার দাবি তােলা হয়।

  • বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামােগত পরিবর্তনের আহবান জানানাে হয়। সম্মেলনে গৃহীত ঘােষণাপত্রটির নাম ছিল 'Declaration on Non-alignment and Economic Progress.'


গুরুত্ব: এই সম্মেলনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়াও এই সমস্ত দেশের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও আর্থিক বৈষম্যকে দূরীকরণের ওপরেও অধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়।


আলজিয়ার্স সম্মেলন


আয়ােজন: চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনটি আয়ােজিত হয় আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে। এই সম্মেলন শুরু হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর আর শেষ হয় ৯ সেপ্টেম্বর।


অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ: এই সম্মেলনে ৭৬টি সদস্যরাষ্ট্র যােগ দেয়। সদস্যরাষ্ট্রগুলি ছাড়াও পর্যবেক্ষক হিসেবে ৯টি দেশ এবং অতিথি হিসেবে ৩টি দেশ এই সম্মেলনে যােগদান করেছিল। এ ছাড়াও এই সম্মেলনে রাষ্ট্রসংঘ, আফ্রিকীয় সংহতি সংস্থা, আরব লিগ এবং বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন অংশগ্রহণ করে।


গৃহীত সিদ্ধান্ত

  • এই সম্মেলনে ভারত মহাসাগরীয় অলকে শান্তির অঞ্চল (Zone of Peace) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

  • নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (NIEO)-র খসড়া তুলে ধরা হয়।

  • আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।


গুরুত্ব: এই সম্মেলনের অন্যতম এক গুরুত্ব হল যে, রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা কর্তৃক ভারতমহাসাগরীয় অঞ্চলকে 'Zone of Peace' হিসেবে ঘােষণা। এ ছাড়াও এই সম্মেলনের NIEO-র খসড়ার ভিত্তিতে নব্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রস্তাবকে স্বীকৃতি জানানাে হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিবর্তনগত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসংঘ বা জাতিপুঞ্জ (UNO) র সাধারণ সভা এক বিশেষ অধিবেশন ডাকে (১৯৭৪ খ্রি., এপ্রিল)। এই অধিবেশনে এক ইস্তাহার (Declaration and Programme of Action of the New International order) গ্রহণ করা হয়। পরে (ডিসেম্বর) সাধারণ সভার অনুমােদন মেনে আর্থিক অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ক এক সনদে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, তা হল নিজ নিজ প্রাকৃতিক সম্পদ ও আর্থিক কার্যকলাপের ওপর প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের পূর্ণ ও স্থায়ী সার্বভৌম অধিকারের স্বীকৃতি।