প্রথম নির্জোট সম্মেলন (১৯৬১ খ্রি.) এর বর্ণনা দাও।

সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বে একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট অপরদিকে সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের বাইরে আফ্রো-এশীয় ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এই দেশগুলি উভয়জোটের প্রভাবের বাইরে থেকে বিশ্বব্যাপী এক নির্জোট আন্দোলন গড়ে তােলারও সিদ্ধান্ত নেয়।


বেলগ্রেড বা নির্জোট সম্মেলন (১৯৬১ খ্রি.)

[1] প্রস্তুতি: প্রথম জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন বেলগ্রেড-এ আয়ােজিত হওয়ার আগে এই সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ৫ থেকে ১২ জুন মিশরের রাজধানী কায়রােতে এই Preparatory Conference অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ২২টি দেশের বিদেশমন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হন।


[2] আয়ােজন: বেলগ্রেড-এর প্রস্তুতি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন বসে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগােশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে। এই সম্মেলন চলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সােভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যেই আয়ােজিত হয় এই সম্মেলন।


[3] অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ: ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের, যুগােশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ন, ঘানার রাষ্ট্রপতি নকুমা, শ্রীলঙ্কার সিরিমাভাে বন্দরনায়েক প্রমুখ নেতা বেলগ্রেডে নির্জোট সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলনে ২৬টি সদস্য রাষ্ট্র যােগ দেয়। এতে পরিদর্শক হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, বলিভিয়া ও ইকোয়েডর যােগদান করেছিল। এই সম্মেলনে উপস্থিত দেশগুলির মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলির আধিক্য ছিল।


[4] গৃহীত সিদ্ধান্ত: এই সম্মেলনের এক খসড়া প্রস্তাবে মার্কিন ও সােভিয়েত উভয় রাষ্ট্রকেই কোনাে সংঘাতে জড়িত না হওয়ার অনুরােধ জানানাে হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর তত্ত্বাবধানে রচিত এই খসড়া প্রস্তাব 'An Appeal for Peace' নামে পরিচিতি পায়। এই সম্মেলনে অন্যান্য যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেগুলি হলㅡ


  • উপনিবেশবাদের অবসান ঘটানাের লক্ষ্যে সক্রিয় থাকা।

  • বিশ্বজুড়ে নিরস্ত্রীকরণের প্রচার চালানাে এবং নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগকে সফল করার ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় ভূমিকা পালন।

  • এই সম্মেলনে আরও ২৭ দফা সিদ্ধান্ত (27 Point Declaration) গ্রহণ করা হয়। এই ২৭ দফা সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন, অ্যাঙ্গোলায় পাের্তুগিজ উপনিবেশবাদের বিরােধিতা, কঙ্গোয় বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরােধিতা প্রভৃতি।

  • এই সম্মেলন থেকে রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবগুলির অনুসরণে প্যালেস্তিনীয় জনগণের অধিকারকে সুরক্ষিত করার দাবি জানানাে হয়।

  • এ ছাড়াও এই সম্মেলন থেকে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পারমাণবিক পরীক্ষা, উপনিবেশবাদ এবং জাতিগত বৈষম্যের অবসানের দাবি ঘােষণা করা হয়।


[5] গুরুত্ব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বান্দুং সম্মেলন যদি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের জন্মদাত্রীহয়,তাহলে বেলগ্রেড সম্মেলন ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। বেলগ্রেড সম্মেলন তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল ও অনুন্নত দেশগুলিকে সংঘবদ্ধ হওয়ার একটি মঞ্চ গড়ে দেয়। তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে। এইভাবেই মার্কিন-সােভিয়েত জঙ্গি আগ্রাসনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় সফল হয়। এই সম্মেলনে যােগদানকারী রাষ্ট্রপ্রধানদের ঘােষণায় সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসান ঘটিয়ে স্থায়ী শান্তিপ্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হয়।


[6] বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের মতামত


  • ভারত: ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন। নেহরু জোটনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন—জোট-নিরপেক্ষ বলতে সেই সমস্ত জাতিকে বােঝায়, যারা আদর্শগত এবং কার্যগতভাবে যুদ্ধ, সামরিক জোট বা মাের্চা গঠন করার বিরােধী।


  • ইন্দোনেশিয়া: ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ন বলেন যে, জার্মানি, কোরিয়া বা ভিয়েতনামে ভূখণ্ডের অধিকার লাভকে কেন্দ্র করে দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়া প্রয়ােজন, নতুবা বিশ্বশান্তির প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।


  • বার্মা: বার্মার রাষ্ট্রপতি ইউসু বলেন যে, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পরমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে এবং উপনিবেশবাদ ও জাগতিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।


উপসংহার: প্রথম নির্জোট সম্মেলন বেলগ্রেড সম্মেলন (১৯৬১ খ্রি.)-এ জোটনিরপেক্ষ ধারণাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন স্পষ্ট রূপ পায়। তাই বলা যায়, বেলগ্রেড সম্মেলন-এর মধ্যে দিয়েই নির্জোট আন্দোলনের সূচনা ঘটে।