নির্জোট আন্দোলনের অবদান সংক্ষেপে লেখাে | জোটনিরপেক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের সম্পর্ক সংক্ষেপে লেখাে।

নির্জোট আন্দোলনের অবদান

[1] বিশ্বশান্তি রক্ষায়: বিশ্বের শান্তিরক্ষার ব্যাপারে সূচনাকাল থেকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সচেতন ভূমিকা পালন করে এসেছে। ঠান্ডা লড়াইকালে সােভিয়েত ও মার্কিন— এই দুই নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রজোটের বাইরে থেকে নির্জোট আন্দোলন ঠান্ডা লড়াইপ্রসূত উত্তেজনা হ্রাসের চেষ্টা করে গেছে। প্রকৃত অর্থে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতিকে বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে সর্বপ্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন।


[2] তৃতীয় বিশ্বের উত্থানে: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রথম বিশ্ব (First World) বলতে বােঝায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ইউরােপ এবং উত্তর আমেরিকায় শিল্পোন্নত সমৃদ্ধিশালী দেশগুলিকে, যারা মূলত গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। দ্বিতীয় বিশ্ব (Second World) বলতে বােঝায় সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিকে যারা মূলত সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। তৃতীয় বিশ্ব (Third World) বলতে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে বােঝায়। ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট বা সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোট কোনােটাতেই যােগ না দিয়ে নির্জোট আন্দোলনভুক্ত দেশগুলির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থান তৃতীয় বিশ্বের উত্থান ঘটায়।


[3] উপনিবেশবাদের অবসানে: নির্জোট আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল ঔপনিবেশিকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত দেশগুলির সার্বভৌমত্ব রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে। নির্জোট আন্দোলন বরাবর উপনিবেশবাদ বা নয়া উপনিবেশবাদের বিরােধিতা করে এসেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি নির্জোট আন্দোলনের শরিক হয়েছিল। এই সমস্ত দেশগুলি দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তাই স্বাভাবিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে থাকার যন্ত্রণা অনুভব করেছে। তাই নির্জোট রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে।


[4] বর্ণবৈষম্যের বিরােধিতায়: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন যে সমস্ত আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলির প্রতি ইতিবাচক মনােভাব দেখিয়েছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল বর্ণবৈষম্যের বিরােধিতা। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শক্তি নিজ নিজ উপনিবেশগুলির স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য জাতি ও বর্ণবিদ্বেষ প্রথার অবতারণা ঘটায়। শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা কৃয়াঙ্গদের শােষণ এবং পদে পদে শ্বেতাঙ্গদের কাছে কৃয়াঙ্গদের অবমাননা ও লাঞ্ছনা উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা জোগায়। দক্ষিণ রােডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরােধিতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নির্জোট সম্মেলনগুলিতে।


[5] নিরস্ত্রীকরণে: নির্জোট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল সর্বজনীন এবং সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণ। প্রথম নির্জোট সম্মেলন (বেলগ্রেড সম্মেলন, ১৯৬১ খ্রি.) থেকে শুরু করে পঞদশ নির্জোট সম্মেলন (শারম-এল-শেখ সম্মেলন, ২০০৯ খ্রি.) পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে এই লক্ষ্যই ঘােষিত হয়েছে। যুগােশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড-এ আয়ােজিত প্রথম নির্জোট সম্মেলন-এ নিরস্ত্রীকরণকে মানবজাতির আবশ্যিক কর্তব্য হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এই সম্মেলনে গৃহীত এক দলিলে উল্লেখ করা হয়-মানবজাতিকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখতে সর্বজনীন এবং সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণ প্রয়ােজন। পরমাণু অস্ত্র প্রসাররােধ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty, সংক্ষেপে NPT), সামগ্রিক (পরমাণু) পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার চুক্তি (Comprehensive Test Ban Treaty, সংক্ষেপে CTBT) প্রভৃতি নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিগুলি নির্জোট আন্দোলনের নিরস্ত্রীকরণ উদ্যোগেরই ফলশ্রুতি বলা চলে।


জোটনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রসংঘের সম্পর্ক


[1] আদর্শগত সম্পর্ক: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আদর্শ ও রাষ্ট্রসংঘের আদর্শের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রাষ্ট্রসংঘের সনদে উল্লিখিত বিভিন্ন নীতির প্রতি নির্জোট রাষ্ট্রগুলি শ্রদ্ধাশীল। বিশেষত আন্তর্জাতিক বিরােধগুলির মীমাংসার ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জ এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন উভয়েই শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণে বিশ্বাসী। বলা বাহুল্য, জোটনিরপেক্ষতা আদর্শের উদ্ভব ঘটে যে বান্দুং সম্মেলনে, সেই সম্মেলনে গৃহীত নীতিগুলি ছিল রাষ্ট্রসংঘের গৃহীত নীতিসমূহেরই প্রতিচ্ছবি।


[2] উদ্দেশ্যগত সম্পর্ক: রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা রক্ষা করা। নির্জোট আন্দোলনও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা রক্ষায় সবসময় সচেষ্ট। বর্তমানে রাষ্ট্রসংঘের একটি মূল উদ্দেশ্য হল নিরস্ত্রীকরণ। এই নিরস্ত্রীকরণের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে নির্জোট রাষ্ট্রগুলি রাষ্ট্রসংঘের ভেতরে ও বাইরে অবিরত প্রচার চালাচ্ছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রসংঘের সনদে বিশ্বের দুর্বল দেশগুলির উন্নয়ন ও নিরাপত্তা রক্ষার যে উদ্দেশ্য ঘােষিত হয়েছিল, তা সফল করার লক্ষ্যে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি সবসময় সক্রিয়।


[3] কার্যগত সম্পর্ক: রাষ্ট্রসংঘ যে সমস্ত জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, সেগুলির অধিকাংশে নির্জোট সদস্যরাষ্ট্রগুলির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। নির্জোট সদস্যরাষ্ট্রগুলি বর্তমানে রাষ্ট্রসংঘের সঙ্গে একজোট হয়ে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি রূপায়ণে বদ্ধপরিকর। নির্জোট সম্মেলনে ঘােষণা করা হয় রাষ্ট্রসংঘের সনদ মেনে যে সমস্ত রাষ্ট্র আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হবে, নির্জোট আন্দোলন তাদের সেই কাজে সমর্থন জানাবে।


কলম্বাে সম্মেলন (১৯৭৬ খ্রি.), হাভানা সম্মেলন (১৯৭৯ খ্রি.), নতুন দিল্লি সম্মেলন (১৯৮৩ খ্রি.) এবং হারারে সম্মেলনের (১৯৮৯ খ্রি.) ওপর সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।


বেলগ্রেড সম্মেলন (১৯৮৯ খ্রি.) থেকে পরবর্তী শারম-এল-শেখ পর্যন্ত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনগুলির প্রসার আলােচনা করাে।


বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি তা আলােচনা করাে।