ভারতে 'বিভাজন ও শাসননীতি'-র প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে।

ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহে শামিল হলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এরপর থেকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দুর্বল করার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদনীতি প্রয়ােগ করে সরকার 'বিভাজন ও শাসননীতি' (Divide and Rule Policy) গ্রহণ করে। এর ফলে পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য বৃদ্ধি পায় এবং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।


বিভাজন ও শাসননীতির প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বিভাজন ও শাসননীতি গ্রহণ করে।


[1] জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি: ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দলের শক্তি ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং কংগ্রেস জাতীয় আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকে। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি করে সরকার ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমনের প্রয়ােজনীয়তা উপলদ্ধি করে। বিলেতের সরকার ভারতের জাতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতির সুযােগ কাজে লাগানাের সিদ্ধান্ত নেয়।


[2] আলিগড় আন্দোলনের সূচনা: উনবিংশ শতকের শেষদিকে মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদের (১৮১৭-১৮৯৮ খ্রি.) নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে আলিগড় আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। স্যার সৈয়দ আহমেদ বলেন যে, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। তাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব নয়। তিনি জাতীয় কংগ্রেসকে একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান বলে অভিহিত করে মুসলিম সম্প্রদায়কে কংগ্রেস থেকে দূরে থাকতে বলেন। ব্রিটিশ সরকার আলিগড় আন্দোলনকে পরােক্ষে সমর্থন করে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উসকানি দেয়।


[3] আন্দোলন দমন: ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ বড়ােলাট লর্ড কার্জন স্পষ্ট ঘােষণা করেছিলেন যে, "যতদিন আমরা ভারত শাসন করব, ততদিন পর্যন্ত আমরা হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি।" ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ভারতে নিজেদের শাসন নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করা এবং শ্বেতাঙ্গ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমন করার পরিকল্পনা করে। সরকার মনে করে যে, আন্দোলন দমন ও দুর্বল করার একটি অন্যতম উপায় হল হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য বৃদ্ধি করা। সরকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিভেদ কাজে লাগিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে।


[4] ব্রাক্ষ্মণ্য সম্প্রদায়ের গতিরােধ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ব্রিটিশবিরােধী জাতীয় চেতনার অগ্রভাগে অবস্থান করত। এই মধ্যবিত্তশ্রেণিতে সর্বাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও চিন্তাধারায় অগ্রণী ব্রাত্মণ্য সম্প্রদায়ের গতিরােধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতের মুসলিম ও অন্যান্য অব্রাত্মণ সম্প্রদায়গুলিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে। সরকার ব্রাক্ষ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টিতে পরােক্ষে উৎসাহ দেয়। এভাবে সরকার হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে, এমনকি বর্ণহিন্দু ও পিছিয়ে পড়া হিন্দুদের মধ্যে বিরােধ ও বিভেদ বৃদ্ধি করে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালায়।


উপসংহার: মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে নির্বাচক মণ্ডলীকে অন্তত দশটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা দশ থেকে বেড়ে সতেরাে হয়েছিল এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে আরও দুর্বল করার উদ্দেশ্যে তপশিলি জাতিকেও পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। পণ্ডিত লালবাহাদুর শাস্ত্রী সরকারের এই বিভেদনীতিকে 'ভারতের জাতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি নির্লজ্জ ঘটনা' বলে অভিহিত করেছেন।


জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দাও। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া


মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাটির পরিণতি কী হয়েছিল?


'বিভাজন ও শাসননীতি' বলতে কী বােঝায়? ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি প্রসারের পরিচয় দাও।