জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দাও | জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

[1] ডায়ারের নগ্ন শাসন: ১১ এপ্রিলের (১৯১৯ খ্রি.) পূর্বে কয়েকদিন পাঞ্জাবের অমৃতসর মােটামুটি শান্ত ছিল। কিন্তু সামরিক শাসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ার অমৃতসরের শাসনভার গ্রহণের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তিনি ১২ এপ্রিল অমৃতসরে নির্বিচারে গ্রেপ্তার শুরু করেন এবং সভাসমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।


[2] সমাবেশ: ডায়ার কর্তৃক সভাসমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞার খবর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সর্বত্র প্রচারিত হয়নি। এই অবস্থায় কুখ্যাত রাওলাট আইন, ব্রিটিশ সরকারের তীব্র দমনপীড়ন প্রভৃতির প্রতিবাদে অমৃতসরের পূর্বদিকে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে পূর্বনির্ধারিত একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ যােগ দেয়।


[3] গুলিবর্ষণ: জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে সভা শুরু হওয়ার পর জেনারেল ডায়ার বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং আগে থেকে কোনাে সতর্কবার্তা না দিয়ে সেনাবাহিনীকে সমাবেশের জনতার ওপর গুলি চালানাের নির্দেশ দেন। পঞ্চাশটি রাইফেল থেকে অন্তত ১০ মিনিট ধরে প্রায় ১৬০০ রাউন্ড গুলি চলে।


[4] হত্যালীলা: জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশ স্থলটি চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সভাস্থলে প্রবেশের জন্য মাত্র একটি এবং সভাস্থল থেকে বেরােনাের চারটি সরু গলিপথ ছিল। ফলে অধিকাংশ মানুষ মাঠ থেকে দ্রুত পালাতে ব্যর্থ হয় এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। সরু গলিপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে বহু লােকের মৃত্যু হয়। গুলিবর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু মানুষ প্রাচীর অতিক্রম করে কুয়ােয় ঝাঁপ দেয় এবং সেখানেই মারা যায়। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ১২০০ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিশু, নারীসহ অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষ ঘটনাস্থলে মারা গিয়েছিল। এই ঘটনা 'জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড' নামে পরিচিত।


[5] সান্ধ্য আইন: জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর সরকার 'সান্ধ্য আইন' জারি করে। ফলে শহরের কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিকটজনের মৃতদেহ বাড়ি নিতে বা আহতের সেবা করতে পারেনি।


[6] পাঞ্জাবের অন্যত্র নিষ্ঠুরতা: সামরিক বাহিনী অমৃতসরের বাইরে পাঞ্জাবের অন্যত্রও চূড়ান্ত অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। 'মার্শাল ল কমিশন' (১৯১৯ খ্রি.) গঠন করে মৃত্যুদণ্ড, বেত্রাঘাত, হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে অত্যাচার প্রভৃতি নির্যাতন ব্যাপক মাত্রায় চলতে থাকে।


জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া


জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতবাসীর কাছে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্নরূপটি প্রকাশে বেরিয়ে পড়ে। সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায় গুলি চালানাের ঘটনাকে সমর্থন করে। ভারত-সচিব মন্টেগু এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে 'নিবারণমূলক হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারতীয়রা এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। যেমন一


[1] ক্ষোভ-বিক্ষোভ: জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে সারা ভারত ক্ষোভ, ক্রোধ ও ঘৃণায় ফেটে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, "এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।"


[2] উপাধি ত্যাগ: জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন। গান্ধিজিও ব্রিটিশদের দেওয়া 'কাইজার-ই-হিন্দ' উপাধি ত্যাগ করেন। একসময় ব্রিটিশ শাসনকে 'ঈশ্বরের আশীর্বাদ' মনে করা গান্ধিজি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ তার ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, "এই শয়তান সরকারের সংশােধন অসম্ভব, একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।"


[3] কংগ্রেসের প্রতিবাদ: জাতীয় কংগ্রেস জালিয়ানওয়ালা-বাগের হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে। কংগ্রেস নেতা সি.এফ. এন্ড্রুজ এই ঘটনাকে 'কসাইখানার গণহত্যার’ (It was a massacre, a butchery) সমতুল্য বলে নিন্দা করেছেন। ব্রিটিশ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে কংগ্রেস নিজের উদ্যোগে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ তার রিপাের্টে হত্যাকাণ্ডের জন্য ডায়ারকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে শাস্তিদানের সুপারিশ করে।