রাওলাট আইনবিরােধী আন্দোলনে সরকার কীরূপ দমনপীড়ন চালিয়েছিল?

সূচনা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবী কার্যকলাপও গণআন্দোলনগুলি দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাট-এর সভাপতিত্বে পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন (১৯১৭ খ্রি.) করে। এটি 'রাওলাট কমিশন' বা 'সিডিশন কমিশন' নামে পরিচিত। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে (১৮ মার্চ) এক তীব্র দমনমূলক আইন পাস করে। এই আইনটির আসল নাম ছিল 'দ্য অ্যানার্চিক্যাল অ্যান্ড রেভল্যুশনারি অ্যাক্ট। এটি সাধারণভাবে 'রাওলাট আইন' নামে পরিচিত।


রাওলাট আইনবিরােধী আন্দোলনে দমনপীড়ন

[1] পুলিশি দমনপীড়ন: দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পাঞ্জাব এবং দিল্লিতে এই সংঘর্ষ ভয়ানক আকার ধারণ করে। গান্ধিজির ডাকে ধমর্ঘটে (৬ এপ্রিল) যােগ দেওয়া আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ৮ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হয়। কলকাতায় কংগ্রেস এবং খিলাফৎপন্থীদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়।


[2] গান্ধিজি গ্রেপ্তার: দিল্লি ও পাঞ্জাবের পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গান্ধিজি ৭ এপ্রিল দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে পুলিশ ১০ এপ্রিল দিল্লির নিকটবর্তী পালওয়াল স্টেশনে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বােম্বাই পাঠিয়ে দেয়। এই ঘটনায় বােম্বাই, আমেদাবাদ, বিরামগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আমেদাবাদে সামরিক আইন জারি করা হয়। গান্ধিজি এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে সামনের সারিতে চলে আসেন। এই সময় থেকেই গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগ শুরু হয়। অবশ্য রাওলাট সত্যাগ্রহে হিংসার প্রবেশ ঘটলে গান্ধিজি প্রচণ্ড মর্মাহত হয়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।


[3] পাঞ্জাবের পরিস্থিতি: রাওলাট-বিরােধী আন্দোলনে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার মাইকলে ও ডায়ার এখানে নির্মম অত্যাচার শুরু করেন। তিনি পাঞ্জাবে ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার ও সভাসমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। রাওলাট আইনের প্রতিবাদ করা এবং হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযােগে সরকার ১০ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রি.) অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে গ্রেপ্তার করে এবং বিনা বিচারে তাদের অজ্ঞাতস্থানে অন্তরীণ করে রাখে।


[4] অমৃতসরে গুলিবর্ষণ: পুলিশের নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে অমৃতসরে শান্তিপূর্ণ মিছিল হলে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ২০ জন নিহত এবং প্রায় ১৫০ জন আহত হয়। এরপর ক্ষুব্ধ জনতা সরকারি অফিস, রেল স্টেশন, ইংরেজদের বাসস্থান প্রভৃতির ওপর আক্রমণ চালায়।


[5] জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড: কুখ্যাত রাওলাট আইন বিরােধী আন্দোলনে সবচেয়ে নির্মম দমনপীড়নের ঘটনাটি ঘটে পাঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে।রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ ১৩ এপ্রিল (১৯১৯ খ্রি.) এই মাঠের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যােগ দেয়। পাঞ্জাবের সামরিক শাসক মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সেনা ও পুলিশের এক বিশাল বাহিনী সমাবেশের জনতার ওপর নির্বিচারে পঞ্চাশটি রাইফেল থেকে অন্তত দশ মিনিট ধরে ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালালে শিশু, নারীসহ অন্তত ১০০০ মানুষের মৃত্যু হয়।


[6] সামরিক আইন জারি: জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল এক মিটিং-এ ডায়ার-সহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার যে বিবৃতি দেন প্রকৃতপক্ষে তা ছিল ভারতীয়দের প্রতি হুমকি। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর সরকার অমৃতসর-সহ পাঞ্জাবের পাঁচটি জেলায় সামরিক আইন জারি করে। শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ ও জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভারতীয় আইনজীবীরা হরতালে অংশ নেওয়ায় সামরিক আইনের দ্বারা তাদের নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। বিশেষ আদালত গঠন করে অন্তত ৫১ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বহু মানুষকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া মার্শাল ল কমিশন (১৫১৯ খ্রি.) গঠন করে প্রকাশ্য রাজপথে বেত্রাঘাত, হাত ও কোমরে শেকল বা দড়ি বেঁধে ঘােরানাে প্রভৃতি অত্যাচার চলতে থাকে।


উপসংহার: পুলিশের সীমাহীন বর্বর দমনপীড়নের ফলে রাওলাট- বিরােধী আন্দোলন দুর্বল হতে বাধ্য হয়। তবে এই বর্বর দমনপীড়ন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে নতুন করে সজাগ করে। রাওলাট আইনের রম পরিণতি ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন।