'বিভাজন ও শাসননীতি' বলতে কী বােঝায়? ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি প্রসারের পরিচয় দাও।

বিভাজন ও শাসননীতি

সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকলেও ব্রিটিশ শাসনকালে সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সুকৌশলে এই সম্প্রীতি ধ্বংস করে এবং হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তােলে। মূলত ভারতে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দুর্বল করে এদেশে ব্রিটিশ শাসনকে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সরকার ভারতের জাতি, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতির মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। স্যার জন স্ট্রাচে একসময় লেখেন যে, "ভারতে পরস্পরবিরােধী বিভিন্ন ধর্মীয় গােষ্ঠীর অস্তিত্ব আমাদের পক্ষে একটি দারুণ সুবিধা।" সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতে এক জাতির বিরুদ্ধে অন্য জাতিকে এবং এক ধর্মের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। ভারতে ব্রিটিশদের এই শাসন পদ্ধতি 'বিভাজন ও শাসননীতি' (Divide and Rule Policy) নামে পরিচিত।


সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির প্রসার


ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর থেকে শুরু করে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি প্রয়ােগ করে। ১৮৭০-এর দশক থেকে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা দূর করতে সরকার মুসলিম সম্প্রদায়কে তােষণ করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়। এই সময়কালে সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত বিভেদনীতিকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়।


প্রথম পর্যায়: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মােটামুটিভাবে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক গৃহীত সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি প্রথম পর্বভুক্ত করা যায়। জন লরেন্স (১৮৬৪-৬৯ খ্রি.) এদেশে সর্বপ্রথম পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীতে 'বিভাজন ও শাসননীতি' কার্যকরী করেন। এই পর্বে ব্রিটিশ বিভেদনীতি হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থে এবং মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রয়ােগ করা হত। ব্রিটিশরা প্রথমে মুসলিমদের আধিপত্য ধ্বংস করে ভারতে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটিয়েছিল। প্রথমদিকে ব্রিটিশ প্রশাসনের নিম্নস্তরের বিভিন্ন পদে কাজের জন্য শিক্ষিত হিন্দু ব্রাহ্মণরা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই পর্যায়ে ব্রিটিশরা হিন্দুদের প্রতি সদয় ছিল। এই সময় হিন্দুদের প্রতি তােষণনীতি গ্রহণ করা হয়। তখন লর্ড এলেনবরা বলেন যে, "মুসলিম জনসমাজ মৌলিকভাবে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, তাই আমাদের আসল লক্ষ্য হবে হিন্দুদের সঙ্গে যােগাযােগ বাড়ানাে।"


দ্বিতীয় পর্ব: ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ব্রিটিশ সরকারের বিভেদনীতির প্রকৃতি বদলাতে থাকে। সরকার হিন্দু তােষণের পরিবর্তে মুসলিমদের তােষণের নীতি গ্রহণ করে। স্যার উইলিয়াম লি নামে জনৈক উচ্চপদস্থ ব্রিটিশকর্তা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ করেন যে, ১৮৬৯ থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনে। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময় ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তাঁর 'দি ইন্ডিয়ান মুসলমান' (১৮৭১ খ্রি.) গ্রন্থে মুসলিমদের প্রতি সরকারের নীতি পরিবর্তনের দাবি জানান। বিভেদনীতির প্রতি মুসলিমদের উৎসাহী করে তােলার উদ্দেশ্যে লর্ড মেয়াে (১৮৬৯- ১৮৭২ খ্রি.) ভারতকে 'দার-উল-ইসলাম বা ইসলামের দেশের পরিবর্তে দার-উল-হারব' বা শত্রুর দেশ বলে প্রচারে উসকানি দেন। লর্ড রিপন এক আইন প্রণয়নের (১৮৮২ খ্রি.) মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন এবং স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনে মুসলিমদের আরও বেশি করে সুযােগ দেওয়ার সুপারিশ করেন। লর্ড ডাফরিন মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে বলেন যে, পাঁচ কোটি মানুষ নিয়ে মুসলিমরা নিজেরাই একটি জাতি, খুব শক্তিশালী একটি জাতি।


তৃতীয় পর্ব: তৃতীয় পর্যায়ে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সরকার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিম তােষণের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিকেও তােষণ করতে শুরু করে। লর্ড কার্জনের আমলে সরকারের সাম্প্রদায়িক বিভেদ তীব্র আকার ধারণ করে। পরবর্তীকালে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা (১৯০৬ খ্রি.) হলে সরকার বিভেদনীতি প্রয়ােগ করে বারংবার মুসলিম লিগ তথা মুসলিম সম্প্রদায়কে তােষণ করে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। এর দ্বারা ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনকে যথেষ্ট দুর্বল করতে সরকার বেশ কয়েকবার সফল হয়।


রাওলাট সত্যাগ্রহ কী? জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পটভূমি উল্লেখ করাে।


জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দাও। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া


মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাটির পরিণতি কী হয়েছিল?