ইংরেজদের সঙ্গে টিপু সুলতানের সম্পর্ক লেখাে।

সূচনা: টিপু সুলতান ছিলেন মহীশুরের স্বাধীন সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা হায়দার আলির পুত্র। মহীশূরের বাঘ' নামে পরিচিত এই শাসকটি জন্মভূমি রক্ষার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতাে প্রাণ দিয়েছিলেন।


ইংরেজদের সঙ্গে টিপু সুলতানের সম্পর্ক

[1] বৈরিতার মনােভাব: টিপু ছিলেন ইংরেজের ঘােরতর শত্রু। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ শক্তিকে বিলুপ্ত করতে কেবল নিজ শক্তির ওপর নির্ভর না করে তিনি ইংরেজের শত্রু ফ্রান্সের সম্রাট ও তুরস্কের সুলতানের কাছেও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।


[2] ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ: ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি ছিল নতুন এক যুদ্ধ শুরুর মাঝে সাময়িক বিরতি মাত্র। টিপু সুলতান বুঝেছিলেন যে, ক্ষমতার লােভেই ইংরেজরা মহীশূর দখল করার চেষ্টা করবে। তাই তিনি গােপনে কনস্টান্টিনােপল, কাবুল, মরিশাস প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সামরিক সাহায্যের জন্য যােগাযােগ রাখেন এবং ফরাসি সম্রাট ও তুরস্কের সুলতানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন।


  • তৃতীয় যুদ্ধ: ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের সময় ইংরেজরা নিজামের কাছে যে শক্তিসংঘ গঠনের প্রস্তাব পাঠায় তা থেকে টিপুকে বাদ রাখে। এই ঘটনায় টিপু অত্যন্ত মর্মাহত এবং ক্ষুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ অধীনস্থ রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করেন (১৭৯০ খ্রি.)। কর্নওয়ালিশ নিজাম ও মারাঠাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ত্রিশক্তি জোট গঠন করেন। এই শক্তি জোটের সঙ্গে টিপুর তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে টিপু ইংরেজদের সঙ্গে শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি (১৭৯২ খ্রি.) স্বাক্ষর করেন। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ টিপু ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ও তার দুই পুত্রকে কোম্পানির কাছে জামিন হিসেবে রাখতে বাধ্য হন।


  • সন্ধির শর্তসমূহ: শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধির মাধ্যমে তৃতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধের অবদান ঘটে। এই সন্ধি অনুযায়ী - (i) মারাঠারা ওয়ার্ধা থেকে কৃয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল লাভ করে। (ii) গুটি ও ফুদাপ্পা-সহ পেনার নদী থেকে কৃয়া নদী পর্যন্ত অঞ্চল নিজাম পায়। (iii) দিন্দিগুল, বরাহমহল, কুর্গ, মালাবার, মাদুরা ও সালেম ইংরেজদের হস্তগত হয়। (vi) এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে টিপুকে নগদ ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ইংরেজদের দিতে হয়। (v) সর্বোপরি, সন্ধির শর্ত পালনের নিশ্চয়তাস্বরূপ তার দুই পুত্রকে ইংরেজদের হাতে অর্পণ করতে টিপু বাধ্য হন। (iv) উভয়পক্ষ একে অপরকে যুদ্ধবন্দি প্রত্যর্পণ করে।


  • গুরুত্ব: শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি স্বাক্ষরের ফলে টিপুর পতন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও মহীশূরের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়। রাহমহল, কুর্গ, মালাবার প্রভৃতি অঞ্চলগুলি ব্রিটিশের অধীনে চলে যাওয়ায় মহীশূরের পূর্ব ও পশ্চিম দিক অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দিন্দিগুল, দোয়াব-সহ কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় রাজ্যের আর্থিক বিকাশ রুদ্ধ হয়। তাই মহিবুল হাসান বলেছেন- "শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি বাস্তবে ওয়েলেসলি কর্তৃক টিপুর চূড়ান্ত পতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।"


  • চতুর্থ যুদ্ধ: ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়েলেসলি টিপুকে এক চরমপত্র পাঠিয়ে অধীনতমূলক মিত্রতা নীতির চুক্তিতে স্বাক্ষরের নির্দেশ : দেন। টিপু এই চুক্তি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে ওয়েলেসলির নেতৃত্বে ইংরেজ, মারাঠা ও নিজামের জোট মহীশূর আক্রমণ করে, শুরু হয় চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ। সদাশির ও মলভেরির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে টিপু তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে আশ্রয় নেন। শত্রুপক্ষ রাজধানী অবরােধ করলে সংঘর্ষে টিপু নিহত হন।


উপসংহার: টিপু সুলতান আজীবন বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও শেষপর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, তবুও তার ব্রিটিশবিরােধী সংগ্রাম দেশবাসীকে বিশেষত পরবর্তী প্রজন মকে জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল।