স্ত্রীশিক্ষা প্রসার, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা লেখো। সংস্কৃত শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর অভিমত কী ছিল?

স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে যেসব মনীষী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। বিদ্যাসাগরের সহায়তায় বেথুন সাহেব 1849 খ্রিস্টাব্দের 7 মে বিনা বেতনের একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 1850 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর ওই বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর পরিচিতদের কাছে ওই বিদ্যালয়ে নিজেদের কন্যাসন্তানদের ভরতি করতে অনুরােধ জানান।


বিদ্যাসাগরের অনুরােধে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁদের কন্যাদের ওই বিদ্যালয়ে ভরতি করেন। বিদ্যালয়ের গাড়িতে মেয়েরা যাতায়াত করত। বিদ্যালয়ের গাড়ির দুই দিকে লেখা থাকত 'কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ।'—যার অর্থ হল কন্যাকেও পুত্রের মতাে পালন করবে এবং শিক্ষাদান করবে।


বিদ্যাসাগর যে কেবল শহরের মধ্যবিত্ত সমাজের নারীশিক্ষার বিকাশে আগ্রহী ছিলেন তা নয়, তিনি গ্রামবাংলায় স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্যেও সচেষ্ট ছিলেন। 1857 খ্রিস্টাব্দে তিনি জৌগ্রামে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এফ. হ্যালিডের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি পরিকল্পনা করেন, যেসব গ্রামে গ্রামবাসীরা বিদ্যালয়ের ঘর দিতে পারবেন, সেখানে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি করা হবে। তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য মেদিনীপুর জেলায় 3টি, বর্ধমান জেলায় 11টি, হুগলি জেলায় 23টি এবং নদিয়া জেলায় 1টি, মােট 38টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যাসাগরের আশা ছিল ভারত সরকার ওইসব বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আর্থিক সাহায্য দেবে।কিন্তু প্রথমবার কিছু টাকা মঞ্জুর করা হলেও সরকার আর কোনাে সাহায্য দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। এই অবস্থায় বিদ্যাসাগর ওইসব বিদ্যালয়ের খরচ চালানাের জন্য নারীশিক্ষা-ভাণ্ডার নামে একটি তহবিল গঠন করেন।


বিদ্যাসাগরের এই ধরনের দৃঢ় মানসিকতা রক্ষণশীল হিন্দুদেরও তাদের পরিবারের মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।


বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারে বিদ্যাসাগরের অবদান


বাংলা ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির সূচনাপর্বে বিদ্যাসাগর যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তার জন্য তিনি চিরস্মরণীয়। অনেকে বিদ্যাসাগরকেই বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ বিষয়ে কিছু মতভেদ থাকলেও তিনিই যে শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যরীতির উদ্ভাবক—সে বিষয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। উপযুক্ত যতিবিন্যাস এবং সুনির্বাচিত শব্দবিন্যাস করে বাংলা গদ্যভাষাকে সরস করে তোলার চেষ্টা বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম করেছিলেন।


সেযুগে আমাদের পূর্বপুরুষদের পাণ্ডিত্য, জ্ঞান প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যেই লিপিবদ্ধ থাকত। বিদ্যাসাগর সেই মূল্যবান সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে সাবলীল বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যাই বেশি। এগুলি সংস্কৃত, ইংরেজি এবং হিন্দি থেকে অনূদিত। 'বেতাল পঞ্চবিংশতি হিন্দি বেতালপচ্চিশি থেকে অনূদিত। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'-এর স্বচ্ছন্দ অনুবাদ হল শকুন্তলা', শেকসপিয়রের 'কমেডি অব এররস-এর অনুবাদ হল 'ভ্রান্তিবিলাস'। তাঁর লেখা 'বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' প্রভৃতির মতাে মৌলিক রচনার সংখ্যাও কম নয়।


বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলন এবং বহুবিবাহ প্রথার বিলােপের জন্য কতকগুলি ব্যঙ্গরসাত্মক পুস্তক রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর লেখা 'প্রভাবতী সম্ভাষণ’ এবং 'বিদ্যাসাগরচরিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়। ভাষাশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর রচনা করেন কথামালা ও বােধােদয়। গণশিক্ষার প্রসারে এবং জনমত গঠনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিদ্যাসাগর তৎকালীন বহু পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল তত্ত্ববােধিনী', সর্বশুভকরী, 'সােমপ্রকাশ, 'Hindu Patriot' ইত্যাদি।


বর্ণপরিচয়' বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় কীর্তি। বাংলা ভাষা বলা ও লেখার পদ্ধতিপ্রকরণ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের সুচিন্তিত ফলই হল 'বর্ণপরিচয়| তিনি 'বর্ণপরিচয়'-এর প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি ভাগ প্রকাশ করেন। প্রথম ভাগে আছে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার এবং দ্বিতীয় ভাগে আছে সংযুক্ত বর্গের ব্যবহার।


বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রসারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। আজকের দিনের বাংলা সাহিত্য তাঁর সাহিত্যকীর্তির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।


সংস্কৃত শিক্ষা সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের অভিমত


নবজাগরণের দ্বিতীয় পর্যায়ে শিক্ষাচেতনায় যে নতুনত্ব দেখা যায় তার পুরােধাদের মধ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন অন্যতম।


বিদ্যাসাগর লক্ষ করেন, বাংলা ভাষার লৌকিক ব্যবহার এবং কথােপকথন বেশ অনুন্নত। যদি সংস্কৃত শব্দভান্ডার থেকে কিছু শব্দ বাংলা ভাষার মধ্যে প্রয়ােগ করা যায়, তাহলে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃত শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কারের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সম্ভব। সংস্কৃত শিক্ষাকে আরও সহজ করার জন্য তিনি নানা চেষ্টা করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচিতে সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিবর্তে বাংলা ব্যাকরণের ওপর গুরুত্ব দেন।


তিন-চার বছরের মধ্যে শিক্ষার্থীরা যাতে সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যে মােটামুটি জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তার জন্য তিনি কয়েকটি বই লেখেন। এই বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ এবং ব্যাকরণ কৌমুদী। বিদ্যাসাগরের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সংস্কৃত সাহিত্যের অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়ে নতুন যুগের উপযোগী বাংলা সাহিত্যের বুনিয়াদ রচনা করা।


বিদ্যাসাগর পণ্ডিতদের জন্য উন্নতমানের সংস্কৃত শিক্ষা বহাল রেখে, সাধারণ লােকের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে সংস্কৃত পড়ানাের কথা বলেন। কারণ বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন, সাধারণ লােকের কাছে দর্শন এবং সংস্কৃত সাহিত্যের তুলনায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বেশি আকর্ষণীয়।


ওপরের আলােচনার পেরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন মাতৃভাষার বিকাশ সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। এই কারণে তিনি সর্বসাধারণের জন্য সংস্কৃত শিক্ষাকে কেবলমাত্র ব্যাকরণ এবং দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রয়ােজনভিত্তিক এবং যুগােপযােগী করে তুলতে চেয়েছিলেন।


শারীরশিক্ষা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা বিষয়ে সার্জেন্ট কমিটির সুপারিশগুলি উল্লেখ করাে।


শিক্ষা প্রশাসন সম্পর্কে সার্জেন্ট কমিটির সুপারিশসমূহ উল্লেখ করাে। সার্জেন্ট পরিকল্পনার মূল্যায়ন করাে।


ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে রাজা রামমােহন রায় আধুনিকতার অগ্রদূত- উক্তিটি আলােচনা করাে। 

অথবা, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান সংক্ষিপ্তভাবে আলােচনা করাে।


সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কারে রামমােহনের অবদান আলােচনা করাে।


রামমােহনের শিক্ষাচিন্তা কীরূপ ছিল তা লেখাে। পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদান লেখাে।


প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান কী? এই প্রসঙ্গে তাঁর বর্ণপরিচয় পুস্তকটির গুরুত্ব আলােচনা করাে।


উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান বিস্তারিতভাবে লেখাে।