উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান বিস্তারিতভাবে লেখাে।

বাংলার নবজাগরণে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী অবদান

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তাতে যেসব মনীষী অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন অন্যতম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানাের কাজ তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। বিদ্যাসাগরের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। তৎকালীন সমাজজীবনে তাঁর সংস্কারমূলক ভূমিকা এক নতুন প্রেরণা জোগায়। তাঁর বহুমুখী অবদানকে নিম্নলিখিত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়一


(১) সমাজসংস্কারমূলক কাজ: সমাজসংস্কারের‌ ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের সবথেকে বড়াে ভূমিকা হল বিধবাবিবাহ প্রবর্তন। তাঁর অদম্য প্রচেষ্টার ফলে 1856 খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়। বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং কৌলিন্য প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেন। তিনি বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য সেই সময়কার গভর্নর জেনারেলের কাছে আবেদন জানান। যদিও 1857 খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ শুরু হওয়ার ফলে বহুবিবাহ প্রথাটি আইন করে বন্ধ করা যায়নি। কিন্তু বহুবিবাহের কুফল সম্পর্কে জনমত গড়ে তুলতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।


(২) শিক্ষাসংস্কারমুলক কাজ: বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাসংস্কারক। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, গণশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রভৃতির বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিক্ষাসংস্কারকে কেন্দ্র করে বিদ্যাসাগর যেসব মৌলিক শিক্ষাভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল


  • মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের উন্নতিসাধন করা;

  • সংস্কৃত এবং ইংরেজি এই দুই ভাষার ব্যুৎপত্তিলাভের ওপর গুরুত্ব দেওয়া;

  • প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয় বিদ্যাচর্চার ওপর গুরুত্ব দেওয়া;

  • জনশিক্ষা বিস্তারের জন্য উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা এবং উপযুক্ত শিক্ষকমণ্ডলী তৈরি করা ইত্যাদি।


বিদ্যাসাগর শিক্ষার যেসব দিকের প্রসার ঘটানাের জন্য কাজ করেছিলেন সেগুলি সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলােচনা করা হল-


  • প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার: বিদ্যাসাগর এদেশের প্রাথমিক শিক্ষার দুর্দশা উপলব্ধি করে তৎকালীন বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসির কাছে কতকগুলি বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন। সেই বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য। ছিল- [a] গণশিক্ষার প্রসার, [b] প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, [c] উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং [d] শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা করা।


সেই সময়ে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় কতকগুলি মডেল স্কুল স্থাপন করা হয়। এই সমস্ত স্কুলে ইতিহাস, ভূগােল, পাটিগণিত, জ্যামিতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, শারীরতত্ত্ব, জীবনবৃত্তান্ত প্রভৃতি বিষয় মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়ানাে হত। তাঁর প্রচেষ্টায় নর্মাল স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা এবং বিদ্যালয়ে পরিদর্শকের ব্যবস্থা করা হয়।



  • স্ত্রীশিক্ষার প্রসার: বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ 1858 সালে তাঁর চেষ্টায় প্রায় 38টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এগুলির মধ্যে তিনটি ছিল মেদিনীপুর জেলায়, এগারােটি বর্ধমান জেলায়, তেইশটি হ্নগলি জেলায় এবং একটি নদিয়া জেলায়| এই সমস্ত বিদ্যালয়ের আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি নারীশিক্ষা ভাণ্ডার গঠন করেছিলেন।


  • গণশিক্ষার প্রসার: গণশিক্ষা প্রসারে তিনি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। এর জন্য তিনি তত্ত্ববােধিনী, সর্বশুভকরী, সােমপ্রকাশ, Hindu Patriot প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন।


  • উচ্চশিক্ষার প্রসার: উচ্চশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন নামক বিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন বিএ (অনার্স), এমএ, আইনশাস্ত্র প্রভৃতি পড়ানাের ব্যবস্থা হয়।


  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: বিদ্যাসাগর প্রাচ্য শিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষার সমন্বয়ই সংস্কৃত এবং বাংলা সাহিত্যকে উন্নত করতে সাহায্য করবে।


(৩) সাহিত্যের উন্নতি: সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য। অনেকের মতে, বিদ্যাসাগর হলেন বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক।বাংলা গদ্যকে তিনি উপযুক্ত যতিবিন্যাস এবং উপযুক্ত শব্দবিন্যাসের দ্বারা সহজসরল ও বােধগম্য ভাষায় পরিণত করতে পেরেছিলেন। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার জন্য রচিত ‘বর্ণপরিচয়’—প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ বহুদিন ধরে শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দানের এবং বাংলা ভাষাশিক্ষার আদর্শ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ভাষাশিক্ষার জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ দুটি রচনা হল কথামালা এবং বােধােদয়। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল'বেতাল পঞ্চবিংশতি, 'শকুন্তলা', 'ভ্রান্তিবিলাস', বাঙ্গালার ইতিহাস', 'জীবনচরিত' ইত্যাদি। তিনি সংস্কৃত শিক্ষাকেও সহজসরল ও বােধগম্য করার জন্য বিশেষ। সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি বাংলায় লেখা ‘উপক্রমণিকা' ও ব্যাকরণ কৌমুদীকে সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রমে স্থান দিয়েছিলেন।


এইভাবে উনবিংশ শতকে বাংলার ইতিহাসে সমাজসংস্কার, শিক্ষাসংস্কার এবং সাহিত্যে অবদানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার নবজাগরণে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন।


শিক্ষক-শিক্ষণ প্রসঙ্গে এবং সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থার বিষয়ে সার্জেন্ট কমিটির সুপারিশ কী ছিল?


শারীরশিক্ষা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা বিষয়ে সার্জেন্ট কমিটির সুপারিশগুলি উল্লেখ করাে।


শিক্ষা প্রশাসন সম্পর্কে সার্জেন্ট কমিটির সুপারিশসমূহ উল্লেখ করাে। সার্জেন্ট পরিকল্পনার মূল্যায়ন করাে।


ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে রাজা রামমােহন রায় আধুনিকতার অগ্রদূত- উক্তিটি আলােচনা করাে। 

অথবা, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান সংক্ষিপ্তভাবে আলােচনা করাে।


সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কারে রামমােহনের অবদান আলােচনা করাে।


রামমােহনের শিক্ষাচিন্তা কীরূপ ছিল তা লেখাে। পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদান লেখাে।


প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান কী? এই প্রসঙ্গে তাঁর বর্ণপরিচয় পুস্তকটির গুরুত্ব আলােচনা করাে।