জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণসমূহ আলােচনা করাে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণসমূহ

সৌরজগতে আমাদের পৃথিবী একটি ক্ষুদ্র গ্রহ মাত্র। অত্যন্ত দ্রুতভাবে এ পৃথিবীর জলবায়ু ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। আশঙ্কার কারণও ঠিক সেটাই। 1988 খ্রিস্টাব্দে কানাডার টরেন্টোতে পরিবর্তনশীল জলবায়ু শীর্ষক আর্ন্তজাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে। এসব প্রমাণ সম্পর্কে নীচে আলােচনা করা হল一


[1] অতীতে হিমবাহের অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের চিহ্ন : হিমবাহের পর্যায় ক্রমিক অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের চিহ্ন থেকে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা করা যায়। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা গেছে যে খ্রিষ্টের জন্মের 3000 বছর পূর্বে পৃথিবীতে বরফাবৃত অঞ্চল কমে গিয়েছিল। এখনকার তুলনায় হিমরেখা 300 মিটার ওপরে অবস্থান করছিল। আবার 500 খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ হিমরেখা অনেকটা নেমে এসেছিল। পরবর্তীকালে তার আবার পশ্চাদপসরণ ঘটে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে হিমরেখার পুনরায় অবনমন ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে হিমরেখার আবার পশ্চাদপসরণ ঘটে। কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিমবাহের অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের চিহ্ন রয়ে গেছে।


[2] বরফের আবরণের গভীরতা : পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান হল দুটি মেরু অঞ্চল। এ দুটি অঞ্চলেই (গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকা) পৃথিবীর অধিকাংশ বরফ সঞ্চিত রয়েছে। পাইপ দিয়ে ড্রিল করে বরফ স্তরের অতি গভীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা থেকে (যখন বরফ জমাট বেঁধেছিল) তখনকার বায়বীয় অবস্থা (বায়ুর তাপমাত্রা) সম্পর্কে জানা যায়। এ ছাড়া বরফের বিভিন্ন স্তরে আবদ্ধ বায়ুর বুদবুদকে বিশ্লেষণ করে অতীতের বিভিন্ন সময়ের বায়ুমণ্ডলীয় Co২ এর পরিমাণ সম্পর্কে জানা যায়।


[3] পললের আস্তরণ : ভূপৃষ্ঠে ভূতাত্ত্ীয়কালে যেসব পলল সঞ্চিত হয়েছে তা থেকে অতীতের জলবায়ু সম্পর্কে জানা যায়। যেমন- আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমির উপরিভাগে কোথাও কোথাও বিস্তীর্ণ লবণ খনি দেখা যায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভূতাত্ত্বীয়কালে এসব অঞ্চলে আর্দ্র জলবায়ু বিরাজ করছিল। বর্তমানে যেসব অঞ্চল লবণের স্তর দিয়ে আবৃত যেসব অঞ্চলে পূর্বে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তী সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত বাষ্পীভবন ঘটে ফলে হ্রদগুলাের জল শুকিয়ে যায় এবং লবণের আস্তরণ জমে এসব লবণ খনির উৎপত্তি হয়।


[4] সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন : বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে স্থায়ী বরফাবৃত অঞ্চলের (মেরু অঞ্চল ও পর্বতচূড়াস্থ বরফাবৃত অংশ) হিমবাহ বেশি হারে গলতে শুরু করলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব জলবায়ু সম্পর্কিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের (IPCC) এক হিসেবে দেখা যায় বিগত কয়েক শতকে পৃথিবীর সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা 10-20 সেমি, বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমলে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের ওঠা-নামার কারণে পৃথিবীব্যাপী সমুদ্র উপকূলের বেশ কিছু অংশ সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। প্লাইস্টোসিন যুগে সমুদ্র সমতলের উঠা-নামা থেকে জানা যায় যে, ঐ সময়ে হিমবাহের আবরণ বেড়েছিল না কমেছিল।


[5] প্রাণীর জীবাশ্ম : প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে অতীতের জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন—অমেরুদণ্ডী প্রাণী ‘প্ল্যাঙ্কটন’ (Plankton) মারা যাবার পর সমুদ্রের তলদেশে সঞ্চিত হয়। এই প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় অতি সূক্ষ্ম প্রাণীগুলাে বিশেষ বিশেষ তাপমাত্রায় বাস করে। ফলে সমুদ্রের যেসব অঞ্চলে এসব প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেসব অঞ্চলের সমুদ্রের এবং তার উপরস্থ বায়ুর তাপমাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।


[6] উদ্ভিদের জীবাশ্ম : উদ্ভিদের অস্তিত্ব রক্ষায় জলবায়ুর প্রভাব সর্বাধিক। একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতির উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্ট জলবায়ুতেই গড়ে ওঠে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে যে ধরনের বড়াে পাতার উদ্ভিদ জন্মায়, তা মরুভূমিতে স্বাভাবিকভাবে জন্মাতে পারে না। আবার নাতিশীতােয় অঞ্চলের সরলবর্গীয় উদ্ভিদ পূর্ববর্তী কোনাে অঞ্চলেই স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে পারে না। জয়শলমীরের মরু জলবায়ুতে সরলবর্গীয় দেওদর গাছের উপস্থিতি একেবারেই অসম্ভব। কারণ দেওদর গাছ অন্য উচ্চ অক্ষাংশীয় শীতল জলবায়ুতে অথবা উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে জন্মায়। তথাপি এই অঞ্চলের উড ফসিল পার্কে স্থানিক দেওদর গাছের (1 কোটি 80 লক্ষ বছর পূর্বের) জীবাশ্ম ওই অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনেরই আভাস দেয়। অতীতের জলবায়ুর প্রকৃতি সম্পর্কে উদ্ভিজ্জের পরাগরেণু বিশ্লেষণের মাধ্যমেও জানা যায়। পুরাতন হ্রদ ও ডােবা থেকে সংগৃহীত মাটিতে যেসব পরাগরেণু পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করে গাছের প্রকারভেদ ও তাদের জীবদ্দশাকালের জলবায়ু সম্পর্কে জানা যায়।