জীববৈচিত্র্য বলতে কী বােঝ? এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলােচনা করাে।

জীববৈচিত্র্য

প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ, প্রাণী ও আণুবীক্ষণিক জীব সমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে, সেই বাস্তুতন্ত্রে অগনিত নানা ধরনের জীব প্রজাতির সমাহার বা সমাবেশকে জীববৈচিত্র্য বলে। 1986 খ্রিস্টাব্দে W. G. Rosen স্কিসােমিয়ান ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফোরামে সর্বপ্রথম জীববৈচিত্র্য তথা 'Biodiversity শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে IUCN ও UNEP “Biodeversity” শব্দটি গ্রহণ করে জীববৈচিত্র্যের যে সংজ্ঞা প্রদান করে তা হল—কোনাে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্ত জিন, প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও সমগ্রতাকে জীববৈচিত্র্য বা Biodiversity বলে। পৃথিবীর জীবমণ্ডলে প্রায় 2.2 কোটি প্রকার জীবের বাস। এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় 16 লক্ষ 5 হাজার জীব প্রজাতিকে শনাক্ত করা হয়েছে। উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীবাণুর প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে যেমন স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়, তেমনি একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যেও গঠনগত বিভিন্নতা দেখা যায়। জীবমণ্ডলের সমগ্র জীবদের মধ্যে এই বিভিন্নতাই হল জীববৈচিত্র্য।


জীববৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ


(১) বাস্তুতন্ত্রের বহুরূপতাই হল জীববৈচিত্র্য।

(২) সময়ের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্য সর্বদাই পরিবর্তনশীল।

(৩) উষ্ণ-আর্দ্র অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য সর্বাধিক।

(৪) উচ্চ অক্ষাংশ অপেক্ষা নিম্ন অক্ষাংশে জীববৈচিত্র্য অধিক।

(৫) ঋতুপার্থক্যহীন এলাকায় জীববৈচিত্র্য বেশি হয়।

(৬) জীববৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সব প্রজাতিই গুরুত্বপূর্ণ।


জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব


একটি সমাজ তৈরি করতে গেলে বিভিন্ন পেশার লােকের দরকার হয়, যারা নিজ নিজ কাজের দ্বারা সমাজকে টিকিয়ে রাখে। তেমনি একটি বাস্তুতন্ত্রের সুস্থায়ীভাবে টিকে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়ােজন হয়, যেখানে প্রত্যেক প্রজাতি তাদের নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। যে কারণগুলির জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়ােজন হয় সেগুলি হল—


  • অর্থনৈতিক মূল্য : মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের জন্যেই মানুষ তার চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম।


  • নান্দনিক মূল্য : বিভিন্ন প্রজাতির জীব প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর করে তােলে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভােগ করতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান প্রভৃতিতে ভ্রমণ করতে যায়।


  • নৈতিক মূল্য : প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। 1982 খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কিত ঘােষণাপত্রে এই চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই মানুষের কর্তব্য প্রতিটি প্রজাতির জীবকে এই পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখা।


  • পরিবেশ রক্ষা : প্রত্যেক জীব বাস্তুতান্ত্রিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একটি জীবের বিনাশ অন্য কোনাে জীবের বিপন্নতার কারণ হতে পারে। তাই মানুষের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত হল এই জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখা।


  • আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য : বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের উল্লেখ আছে। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন উদ্ভিদ যেমন-তুলসী, বট, অশ্বত্থ ইত্যাদি পূজোর বিধান আছে। হিন্দু দেবদেবীদের অনেকেরই বাহন হল বন্যপ্রাণী। সেইসব প্রাণীদের হত্যা করা ধর্মে নিষিদ্ধ। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মেও জীবের প্রতি অহিংসা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। তাই মানুষের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের বিশেষ ভূমিকা বর্তমান।