কাস্ট ভূমিরূপ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা | কাস্ট অঞ্চলে ভৌমজলের কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা

চুনাপাথর অঞ্চলে ভৌমজলের কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপের বর্ণনা দাও।


কাস্ট ভূমিরূপ

জলের দ্রবণ ক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠীয় ও উপপৃষ্ঠীয় শিলা দ্রবীভূত হয়ে শিলার রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মের পরিবর্তন ঘটিয়ে যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ ও জলনির্গম প্রণালী গঠিত হয় তাকে কাস্ট ভূমিরূপ বলে। দ্রবণ প্রক্রিয়ায় কাস্ট অঞ্চলে যেসব ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়, তাদের অবস্থান ও প্রকৃতি অনুযায়ী এটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়-


(ক) পৃষ্ঠীয় ভূমিরূপ


(১) ল্যাপিস বা কারেন : অধিক ঢালযুক্ত চুনাপাথর অঞ্চলে দ্রবণ কার্যের ফলে শিলাপৃষ্ঠে অসংখ্য অগভীর রৈখিক খাতের সৃষ্টি হয়। পরস্পর সমান্তরালে বিন্যস্ত খাতগুলি তীক্ষ্ণ শীর্ষদেশ দ্বারা বিভক্ত হয়ে যে খাতবিশিষ্ট ভূমিরূপ গঠিত হয়, ফরাসি ভাষায় তাকে ল্যাপিস এবং জার্মান ভাষায় কারেন বলে।


(২) গ্রাইক ও ক্লিন্ট : দ্রবণ কার্যের ফলে চুনাপাথরে দারণ বা সন্ধিস্থল বরাবর গভীর রৈখিক ও দীর্ঘ গর্ত সৃষ্টি হলে তাকে গ্রাইক বলে। গ্রাইক জালিকার মতাে পরস্পরের সমকোণে বিস্তৃত হয়। গ্রাইকের মধ্যবর্তী প্রায় সমতল পৃষ্ঠবিশিষ্ট আয়তাকার উঁচু শিলাখণ্ডকে ক্লিন্ট বলে। বড়াে আকারের গ্রাইককে বােগাজ বলে। মধ্যপ্রদেশের নন্দিনী খনি অঞ্চলে গ্রাইক ও ক্লিন্ট দেখা যায়।


(৩) টেরা রােসা : কার্বন ডাইঅক্সাইড যুক্ত জল বিশুদ্ধ চুনাপাথরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে দ্রবণ প্রক্রিয়ায় চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়ে অপসারিত হয়। কিন্তু ভূপৃষ্ঠে অদ্রাব্য লােহাযৌগ সঞ্চিত হয়ে লাল কর্মযুক্ত যে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয় তাকে টেরা রােসা বলে। টেরা রােসা (Terra শব্দের অর্থ মৃত্তিকা এবং Rossa শব্দের অর্থ লাল) এক-দু মিটার থেকে কয়েক মিটার পর্যন্ত পুরু হতে পারে।


(খ) অবনমিত ভূমিরূপ


(১) সােয়ালাে হােল : কাস্ট অঞ্চলে দ্রবণ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য ছােটো ছােটো গর্তের সৃষ্টি হয়। এর মধ্য দিয়ে জল সহজেই সিঙ্কহােলে প্রবেশ করে। এই ধরনের উন্মুক্ত গহবর মুখকে সােয়ালাে হােল বলে।


(২) পােনর : সােয়ালাে হােল থেকে ভূ-অভ্যন্তরে বিস্তৃত সুড়ঙ্গপথটি পােনর বলে পরিচিত।


(৩) সিঙ্কহােল : কাস্স্ট অঞ্চলে দ্রবণ কার্যের ফলে যে ফাঁদল আকৃতির অবনমিত ভূভাগ সৃষ্টি হয় তাকে সিঙ্কহােল বলে। এই অঞ্চলে একাধিক সিঙ্কহােল প্রসারিত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌগিক সিঙ্কহােল সৃষ্টি হয়।


(৪) ডােলাইন : সার্বিয়ান শব্দ Dolina থেকে ডােলাইন শব্দটি এসেছে। এর অর্থ ভূভাগের অবনমন। তাই বলা যায়, ডােলাইন সিঙ্কহােলের নামান্তর। বিশুদ্ধ চুনাপাথর অঞ্চলে এবং শুষ্ক নদী-উপত্যকায় অসংখ্য ডােলাইন দেখা যায়। অধিকাংশ ডােলাইনের ব্যাস 50-100 মিটার এবং গভীরতা 2-10 মিটার হয়ে থাকে। উৎপত্তি অনুসারে ডােলাইনকে 5 ভাগে ভাগ করা যায়- (i) দ্রবণ ডােলাইন, (ii) ধস ডােলাইন, (iii) দ্রবণ-পাইপ ডােলাইন, (iv) অবনমিত ডােলাইন এবং (v) ককৃপিট ডােলাইন। অন্ধ্রপ্রদেশের বােরাগুহালু স্টেশনের বিপরীত পাশে ফানেলের আকারে সৃষ্ট গর্তটি একটি আদর্শ ডােলাইন।


(৫) দ্রবণ প্যান : দ্রবণ প্যান হল ডােলাইনের পরিবর্তিত রূপ। এটি ডােলাইনের তুলনায় অগভীর কিন্তু অধিক বিস্তৃত।


(৬) কাস্ট হ্রদ : চারদিক থেকে ধুয়ে আনা অতি সূক্ষ্ম কর্দমকণা ডােলাইনে সঞ্চিত হয়ে ডােলাইনের তলদেশের ছিদ্রগুলিকে বন্ধ করে দেয়। ফলে ডােলাইনে জল সঞ্চিত হয়ে যে হ্রদ সৃষ্টি হয়, তাকে কাস্ট হ্রদ বলে। এই ধরনের হ্রদগুলি সবসময় আঞ্চলিক ভৌমজলতলের ওপরে অবস্থান করে।


(৭) উভালা ও পােলজি : একাধিক সিঙ্কহােল বা ডােলাইন পরস্পর মিলিত হয়ে যে বৃহদাকৃতির গর্ত সৃষ্টি হয় তাকে উভালা বলে। উভালা অপেক্ষা বড়াে উপবৃত্তাকার অবনত ভূভাগকে পােলজি বলে। পােলজির তলদেশ সমতল প্রকৃতির। এগুলি খাড়া ঢাল দ্বারা আবদ্ধ। যুগােস্লাভিয়ার লিভেনাে পােলজি প্রায় 65 কিমি দীর্ঘ এবং 5-11 কিমি প্রশস্ত। পােলজির ভেতরে চুনাপাথরের অবশিষ্ট টিলাগুলিকে হামস বা হেস্ট্যাক পাহাড় বা পেপিনাে পাহাড় বলে। ছত্তিশগড়ের রায়পুর জেলায় শেল দ্বারা গঠিত হামগুলিকে স্থানীয় ভাষায় রাবণভাটা বলে।


(গ) নদী দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ


(১) গিরিখাত : চুনাপাথর অঞ্চলে প্রবহমান নদীর দ্রবণ কার্যের ফলে যে গভীর খাড়া পাড়যুক্ত নদী-উপত্যকা সৃষ্টি হয় তাকে গিরিখাত বলে। সুড়ঙ্গের ছাদ ধসে গিয়েও গিরিখাত সৃষ্টি হতে পারে। ফ্রান্সের লট, টার্ন ও জন্টি নদীর গিরিখাত 300-500 মিটার গভীর।


(২) অন্ধ ও শুষ্ক উপত্যকা : কাস্ট অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী সিঙ্কহােলের মধ্যে প্রবেশ করলে নদী-উপত্যকা সিঙ্কহােল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। কাস্ট অঞ্চলের এইরূপ উপত্যকাকে অন্ধ উপত্যকা বলে। পূর্বেকার নদী-উপত্যকার কোনাে অংশে নদীর সব জল সিঙ্কহােলের মধ্যে প্রবেশ করলে সিঙ্কহােলের পরে নদী-উপত্যকার অংশ শুষ্ক উপত্যকা রূপে অবস্থান করে।


(৩) প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ ও প্রাকৃতিক সেতু : কাস্ট অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে দ্রবণ কার্যের মাধ্যমে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গপথ সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদী অন্তর্হিত হলে সুড়ঙ্গপথটি প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গরূপে অবস্থান করে। এই সুড়ঙ্গপথের কিছু অংশ ধসে পড়লে সুড়ঙ্গটি সেতুর আকারে অবস্থান করে। একে প্রাকৃতিক সেতু বলে।


(৪) কাস্ট বাতায়ন : চুনাপাথর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ নদী সুড়ঙ্গপথের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুড়ঙ্গের ছাদ যে-অংশে ধসে পড়ে সেখানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূগর্ভস্থ নদীকে দেখা যায়। জানালার মতাে এরূপ অংশকে কাস্ট বাতায়ন বলে। বােরাগুহার ওপর থেকে গােস্থানী নদীর প্রবাহকে দেখা যায়। এটি কাস্স্ট বাতায়নের উদাহরণ।


(ঘ) ভূগর্ডে গঠিত ভূমিরূপ


(১) ক্ষয়জাত ভূমিরূপ : ভূ-অভ্যন্তরের স্বাভাবিক শূন্যস্থানকে গুহা বলে। কাস্ট অঞ্চলে দ্রবণীয় শিলাস্তরের ফাটল ও সন্ধিস্থল দিয়ে অ্যাসিড মিশ্রিত জল ভূগর্ভে প্রবেশ করলে ভূ-অভ্যন্তরে গুহার সৃষ্টি হয়। এই গুহা আয়তনে বড়াে হলে তাকে ভূগহ্বর বলে। গুহা অনুভূমিক বা উল্লম্বভাবে বিস্তৃত হতে পারে। গুহা উল্লম্বভাবে বিস্তৃত হলে গুহা বহুতল বিশিষ্ট হয়। এইরূপ গুহাকে গ্যালারি গুহা বলে।


(২) সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ : গুহা অভ্যন্তরে সাধারণত তিন ধরনের সঞ্চয় বা অবক্ষেপ লক্ষ করা যায়। এগুলি হল—(i) পাতন প্রস্তর, (ii) প্রবাহ প্রস্তর এবং (iii) প্রান্ত প্রস্তর। প্রবহমান জলের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপকে প্রবাহ প্রস্তর এবং জলপ্রবাহের ফলে গুহাপ্রান্তে যে ভূমিরূপ গঠিত হয় তাকে প্রান্ত প্রস্তর বলে। গুহার ছাদ থেকে জলের সঙ্গে দ্রবীভূত চুনাপাথর ফোঁটা ফোঁটা রূপে পড়ে যে ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় তাকে পাতন প্রস্তর বলে। পাতন প্রস্তর প্রধানত 4 প্রকার-

  • স্ট্যালাকটাইট : গুহার ছাদ থেকে দ্রবীভূত চুনাপাথরমিশ্রিত জল ফোটার আকারে মেঝেতে পড়ার আগেই জল বাষ্পীভূত হয় ও ক্যালশিয়াম দণ্ড হিসেবে। ঝুলতে থাকলে তাকে স্ট্যালাকটাইট বলে।
  • স্ট্যালাগমাইট : গুহার ছাদ থেকে দ্রবীভূত চুনাপাথর মিশ্রিত জল গুহার মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটারূপে সঞ্চিত হয়ে ক্রমশ স্তম্ভের আকারে ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। একে স্ট্যালাগমাইট বলে।
  • স্তম্ভ : স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট বর্ধিত হয়ে উভয়ে সংযুক্ত হলে স্তম্ভের সৃষ্টি হয়। এরূপ স্তম্ভ গুহার ছাদকে ধসের হাত থেকে রক্ষা করে।
  • হেলিকটাইট : চুনাপাথর অঞ্চলে গুহার ছাদে নানা আকৃতির ভূমিরূপ গঠিত হয়। যেগুলি তির্যক বা বক্রাকারে বৃদ্ধি পায়, একে হেলিকটাইট বলে।