গঠন অনুসারে প্রস্রবণের শ্রেণিবিভাগ করাে।

গঠন অনুসারে প্রস্রবণের শ্রেণিবিভাগ


গঠনগত পার্থক্য অনুযায়ী প্রস্রবণগুলিকে প্রধানত 9টি ভাগে ভাগ করা হয়। ভূতত্ত্ববিদ ব্রায়ান এই প্রস্রবণগুলিকে- [1] অভিকর্ষজ ও [2] অ-অভিকর্ষজ এই দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। যে প্রস্রবণ থেকে ভূগর্ভস্থ জল পৃথিবীর অভিকর্ষীয় টানের অনুকূলে নির্গত হয় তাকে অভিকর্ষজ প্রস্রবণ এবং যে প্রস্রবণগুলি পৃথিবীর অভিকর্ষীয় টানের প্রতিকূলে সৃষ্টি হয় তাদের অ-অভিকর্ষজ প্রস্রবণ বলে।


অভিকর্ষজ প্রস্রবণ

[1] অবনত জলগীঠ প্রস্রবণ : জলপীঠ অবনত হয়ে ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত হলে ভূগর্ভস্থ জলের নির্গমন ঘটিয়ে যে প্রস্রবণ গঠিত হয় তাকে অবনত জলপীঠ প্রস্রবণ বলে। একই প্রকার প্রবেশ্য শিলার ভূমিরূপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জলপীঠ বিস্তৃত হয়। উচ্চভূমি বা পর্বতের পাদদেশে জলপীঠ উন্মুক্ত হলেই এই প্রকার প্রস্রবণ সৃষ্টি হয়।


[2] সংযােগ প্রস্রবণ বা নতি প্রস্রবণ : অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের ওপর প্রবেশ্য শিলাস্তর অনুভূমিকভাবে অবস্থান করলে ওই দুই শিলাস্তরের সংযােগস্থল কখনাে কখনাে ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত হয়। শিলাস্তরের সংযােগস্থলে জলপীঠ উন্মুক্ত হলে ভূগর্ভস্থ জল প্রক্রবণের আকারে নির্গত হয়। এরূপ প্রস্রবণকে সংযােগ প্রস্রবণ বলে। নতি বরাবর অপ্রবেশ্য ও প্রবেশ্য শিলাস্তরের সংযােগস্থলে জলপীঠ উন্মুক্ত হয়ে প্রস্রবণ সৃষ্টি হয় বলে একে নতি প্রস্রবণও বলে।


[3] ডাইক প্রস্রবণ : প্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্যে ডাইক বা সিল জাতীয় আগ্নেয় উদ্ভেদ ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত উথিত হলে এর পেছনে জলবাহী স্তরে জল আটকে পড়ে। এই জলবাহী স্তরের জলপীঠ ডাইকের উচ্চতাকে অতিক্রম করলে ভূগর্ভস্থ জল প্রক্রবণের আকারে নির্গত হয়। এইরূপ প্রস্রবণকে ডাইক প্রস্রবণ বলে।


[4] বিদার ও সন্ধি প্রস্রবণ : ব্যাসল্ট ও গ্রানাইট জাতীয় অপ্রবেশ্য শিলার মধ্যে সৃষ্ট বিদার ও সন্ধিতল দিয়ে বৃষ্টির জল ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পরে তা আবার ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত বিদার ও সন্ধিপ্রান্ত দিয়ে প্রস্রবণের আকারে বেরিয়ে আসে। একে বিদার ও সন্ধি, প্রস্রবণ বলে। ছত্তিশগড়ের অমরকন্টকে ব্যাসল্ট শিলায় সৃষ্ট দারণপ্রান্ত দিয়ে নির্গত শােনমুড়া প্রস্রবণ বিদার ও সন্ধি প্রস্রবণের উদাহরণ।


[5] চ্যুতি প্রস্রবণ : চ্যুতির ফলে জলবাহী প্রবেশ্য শিলাস্তর অপ্রবেশ্য শিলাস্তর দ্বারা আবদ্ধ হয়ে জলবাহী প্রবেশ্য শিলাস্তরের জল চ্যুতি বরাবর ভূপৃষ্ঠের ওপরে উঠে এলে তাকে চ্যুতি প্রস্রবণ বলে।


[6] ভ্যকুসিয়ান প্রস্রবণ বা দ্রবণ প্রস্রবণ : চুনাপাথর প্রকৃতিগতভাবে ভীষণ দারণযুক্ত হয়। বৃষ্টির জল দারণের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করলে ওই দারণ বা ফাটল বরাবর চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়। ফলে ফাটল বা দারণ ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে। ভূ-অভ্যন্তরের জল প্রসারিত ফাটলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চুনাপাথর স্তরের পাদদেশ থেকে প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। একে ভ্যকুসিয়ান বা দ্রবণ প্রস্রবণ বলে। ফ্রান্সের রােন উপত্যকায় ফনটেন দ্য ভ্যস নামক প্রস্রবণ থেকে দ্রবণ প্রস্রবণের নামকরণ হয়েছে ভ্যকুসিয়ান প্রস্রবণ।


অ-অভিকর্ষজ প্রস্রবণ


অভিকর্ষজ টান ছাড়াই ভূগর্ভস্থ জলের চাপ বৃদ্ধি পেলে ভূত্বকের দুর্বল অংশ দিয়ে জল প্রবল বেগে ভূপৃষ্ঠে নির্গত হয়। এরূপ প্রত্রবণকে অ-অভিকর্ষজ প্রস্রবণ বলে। অ-অভিকর্ষজ প্রস্রবণগুলি হল-


[1] আর্তেজীয় প্রস্রবণ : ভাঁজপ্রাপ্ত শিলার অধােভঙ্গে দুটি অপ্রবেশ্য শিলার মধ্যে প্রবেশ্য শিলা অবস্থান করলে এবং এদের প্রান্ত দুটি ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত হলে বৃষ্টির জল ভূপৃষ্ঠের উন্মুক্ত অংশ দিয়ে প্রবেশ্য শিলা স্তরের নীচের অংশে সঞ্চিত হয়। একে আবদ্ধ জলবাহী স্তর বলে। এই অবস্থায় ভৌমজল প্রচণ্ড চাপের মধ্যে অবস্থান করে। জলবাহী স্তরের এইরূপ অবস্থাকে আর্তেজীয় অবস্থা এবং স্তরটিকে আর্তেজীয় স্তর বলে। এই অবস্থায় ওপরের অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের ফাটল বা দুর্বল অংশ দিয়ে জল ফোয়ারার মতাে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে। একে আর্তেজীয় প্রস্রবণ বলে। ফ্রান্সের আর্ত্তায়েস প্রদেশে এইরূপ আর্তেজীয় স্তরে প্রথম কূপ খনন করা হয় বলে এই জাতীয় কূপের নাম আর্তেজীয় কূপ এবং প্রস্রবণের নাম আর্তেজীয় প্রস্রবণ।


[2] আগ্নেয় প্রস্রবণ : উত্তপ্ত আগ্নেয় শিলার মধ্য দিয়ে জল প্রবাহিত হয়ে আগ্নেয়গিরির প্রধান বা গৌণ জ্বালামুখ দিয়ে ভূগর্ভের জল অত্যন্ত গরম অবস্থায় বেরিয়ে এলে তাকে আগ্নেয় প্রস্রবণ বলে।


[3] গিজার : যে প্রস্রবণ দিয়ে ভূগর্ভের সঞ্চিত অত্যুয় জল ও বাষ্প নিয়মিতভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর গর্জন করতে করতে প্রবল বেগে ভূপৃষ্ঠের সংকীর্ণ পথ ধরে ভূপৃষ্ঠে উৎক্ষিপ্ত হয় তাকে গিজার বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম অংশে মন্টানা প্রদেশের ইয়েলােস্টোন জাতীয় উদ্যানের ওল্ড ফেথফুল গিজার পৃথিবী বিখ্যাত।