বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা | বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা সংরক্ষিত | বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা রক্ষা

বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার সংজ্ঞা

বিচারবিভাগীয় সমীক্ষা বিচার বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বা কাজ। এই ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগ সংবিধানের রক্ষাকর্তা এবং অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে। সরকারের আইন বিভাগ প্রণীত কোনাে আইন এবং শাসন বিভাগের কোনাে নির্দেশ বা আদেশ সংবিধানবিরােধী কি না তা বিচার বিভাগ পর্যালােচনা করে। উক্ত আইন বা নির্দেশ সংবিধানবিরােধী হলে বিচার বিভাগ তা বাতিল করে দিতে পারে। বিচার বিভাগের এই ক্ষমতাকে বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা (Power of judicial Review) বলে। এই ক্ষমতার জোরে বিচার বিভাগ কেবলমাত্র আইন বা শাসন বিভাগের কোনাে নির্দেশের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করে শুধু তাই নয়, সেইসঙ্গে আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি (Due-process of Law) অনুসৃত হয়েছে কি না তাও সমীক্ষা করে দেখে। আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি অনুসারে বিচার করতে গিয়ে বিচার বিভাগ কেবলমাত্র আইনের পদ্ধতিগত দিকটাই বিচার করে না, আইনটি স্বাভাবিক ন্যায়নীতিবিরােধী কি না, যুক্তিসংগত কি না তারও বিচার করে দেখে।


বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা


গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা একান্তভাবেই কাম্য। (Independent judiciary is the trade mark of a  democratic State.) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় বিচারপতিগণ সকলরকম রাজনৈতিক, শাসনবিভাগীয় এবং আইন- বিভাগীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্ভীক এবং ন্যায়নিষ্ঠভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। অধ্যাপক ল্যাস্কির ভাষায়, স্বাধীনতার জন্য বিচারব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য জরুরি এই অর্থে যে, ক্ষমতা বিভাজনের মতবাদ এক পরম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। (“The Independence of the judiciary is essential to freedom in the sense that the doctrine of separation of power enshrines a paramount truth.”)। ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার, বিচার বিভাগের উপরেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। গণতন্ত্র রক্ষা করা এবং নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধান স্তম্ভ হল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ ও নির্ভীক বিচারব্যবস্থার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। অধ্যাপক ল্যাস্কি বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা রক্ষার তিনটি নীতির উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল যথাক্রমে一


প্রথমত: বিচারপতি নিয়ােগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিচার বিবেচনার সম্ভাবনা দূর করার জন্য উপযুক্ত নিয়ােগ পদ্ধতি স্থির করা।


দ্বিতীয়ত: সদাচরণ সাপেক্ষে নিযুক্ত কর্মীদের কাজের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বিধান করা।


তৃতীয়ত: সুনাম ও যােগ্যতার মানদণ্ডে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। এ ছাড়াও উপযুক্ত বেতন, অবসরকালীন অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা এবং নিরাপত্তা, সামাজিক মানমর্যাদা, ক্ষমতা বিভাজন নীতির প্রয়ােগ এবং অবসরের পর আইনজ্ঞ হিসেবে প্র্যাকটিস করার উপর নিষেধাজ্ঞা নীতি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতার জন্য বহাল রাখা প্রয়ােজন।


পর্যালােচনা: বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে বিচারপতিদের মানসিকতা বিচার করা জরুরি। সমাজের সদস্য হিসেবে বিচারপতিগণ সমাজে বিদ্যমান কোনাে-না-কোনাে মূল্যবোধ বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে। সামাজিক অবস্থানের দ্বারা সামাজিক চেতনার মান নির্ধারিত হয়। সেই কারণে বিচারপতিদের সামাজিক অবস্থান তাদের চেতনা, মানসিকতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবােধকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। ("Judiciary is essentially a part of the existing socio-economic system.")


বিচারপতি রডি এবং আন্ডারসন যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যতই উচ্চমননশীল এবং নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়ােগের চেষ্টা করা হােক-না-কেন বিচারকার্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মানবিক সম্পর্ক ও উপাদানের প্রবেশ অবশ্যম্ভাবী। গােখলে বলেছেন, “বিচারকগণ দুর্নীতিপরায়ণ ও বিকৃত মনােভাবাপন্ন হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হতে বাধ্য। তাই এই সমস্ত কারণে বিচারকগণ যাতে শাসন ও আইন বিভাগীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীন এবং নির্ভীকভাবে ন্যায়বিচার প্রদান করতে পারেন তার জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকা প্রয়ােজন।


বিচার বিভাগের স্বাধীনতার শর্তাবলি


(১) বিচারপতিদের যােগ্যতা: যােগ্যতার উপর ভিত্তি করেই বিচারপতিদের নিয়োগ করা প্রয়ােজন। কারণ, বিশেষজ্ঞ, উন্নত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিরাই নির্ভীকভাবে নিজেদের বিচার বুদ্ধি প্রয়ােগ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রের সংবিধানে বিচারপতির যােগ্যতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে বলেই তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।


(২) বিচারক নিয়ােগ: বিচারক নিয়ােগ পদ্ধতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের অন্যতম সহায়ক। বিচারপতিদের তিন ভাবে নিয়োগ করা যায়। যথা一

  • জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচন: এই পদ্ধতি গণতান্ত্রিক হলেও যুক্তিসংগত নয়। ল্যাস্কি এই পদ্ধতিকে নিকৃষ্ট পদ্ধতি বলেছেন। কারণ বিচার বিভাগের যােগ্য বিচারপতি নির্বাচনে জনগণের অজ্ঞতা অপরপক্ষে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে বিচারপতির চেষ্টা এই পদ্ধতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
  • আইনসভা কর্তৃক মনােনয়ন: সুইজারল্যান্ড, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, বলিভিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলিতে আইনসভার মাধ্যমে বিচারপতিদের নিয়ােগের ব্যবস্থা। রয়েছে। প্রথম পদ্ধতির তুলনায় ভালাে হলেও এই পদ্ধতিতে বিচারপতিদের রাষ্ট্রের শাসকদলের প্রতি আনুগত্যের সম্ভাবনা থেকে যায়। ল্যাস্কি এই নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে দুটি শর্তের উল্লেখ করেছেন, প্রথমত: আইনসভা ছােটো হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক নিয়ােগ না হওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে হবে, যা কার্যত অসম্ভব ঘটনা বলে বিবেচিত হয়।
  • শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়ােগ: ভারত, ব্রিটেন, কানাডায় নিম্নস্তরে প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এবং উচ্চস্তরে প্রধান বিচারপতির মতামতের মাধ্যমে শাসন বিভাগের দ্বারা বিচারপতি নিয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে বিচারপতিরা যােগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালাে ভূমিকা পালন করে থাকেন। কারণ এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী, যােগ্য বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারবে।

(৩) বিচারকদের কার্যকাল: বিচারকদের কার্যকালের স্থায়িত্ব না থাকলে বা কার্যকাল স্বল্পস্থায়ী হলে বিচারপতিদের ক্ষমতার অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য বিচারকদের কার্যকালের মেয়াদ নির্দিষ্টভাবে স্থির করা উচিত। মূলত নিয়ােগকর্তার ইচ্ছার উপরই বিচারপতির কার্যকাল নির্ভর করে।


(৪) বিচারকদের অপসারণ: শাসন অথবা আইন বিভাগের ইচ্ছার উপর বিচারপতির অপসারণ নির্ভর করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় আঘাত আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। এইজন্য এই বিষয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যদি কোনাে বিচারপতির বিরুদ্ধে সংবিধানের বিধিভঙ্গ, দুর্নীতি, অযােগ্যতা প্রভৃতি বিষয়ে অভিযােগ ওঠে, তবে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার বিচারের ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিতে হবে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইমপিচমেন্ট’ (Impeachment) পদ্ধতির মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।


(৫) বিচারকদের বেতন ও ভাতা: বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য উপযুক্ত বেতন ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা থাকা দরকার। বিচারপতিরা স্বল্পবেতনভােগী হলে দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রকৃত যােগ্যতাসম্পন্ন আইনজ্ঞ উকিলের বেতন কম হলে বিচারপতি হওয়ার উৎসাহ থাকে না। বিচারকদের জন্য যাবতীয় ব্যয় সরকারি তহবিলের উপর ধার্য ব্যয় হিসেবে গণ্য হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে বিচারপতিদের বদলি, পদোন্নতি, পদচ্যুতি প্রভৃতি বিষয়ে শাসন ও আইন বিভাগের প্রভাব না থাকাই বাণী।


(৬) বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আইন বিভাগ থেকে এই বিভাগের পৃথকীকরণ অপরিহার্য। তিনটি বা দুটি বিভাগের দায়িত্ব যদি একজনের উপর থাকে তাহলে সে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া শাসকের হাতে বিচারের ভার থাকলেও ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। তিনটি বিভাগ যদি আলাদা আলাদাভাবে স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে পৃথকভাবে নিজ নিজ কাজ সম্পাদন করে, তবেই ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এই বিষয়ে ভারতের সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিতে বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য কথা উল্লেখ করা হয়েছে।


(৭) বিচারপতিদের গুণাবলি: বিচারপতিদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান, চারিত্রিক গুণাবলি ও চারিত্রিক দৃঢ়তা, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট প্রভৃতিও বিচারকদের নিরপেক্ষতা ও মর্যাদারক্ষার জন্য আবশ্যক। শ্রেণিচরিত্রের দ্বারাই বিচারকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার, মানসিক গঠন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। বিচার বিভাগের বিচারপতিরা সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে সমাজব্যবস্থার প্রচলিত মূল্যবােধের প্রতি সাধারণত অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন। বিচারপতিদের এই গুণাবলির জন্যই বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হয়।


উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য এইসব ব্যবস্থা থাকলেও বিচারকগণের নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতামত আছে, যা তাদের দ্বারা প্রদত্ত রায় এবং সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়। বিচারব্যবস্থা কখনােই সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র দর্শন নিরপেক্ষ হতে পারে না। এরজন্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সদর্থক ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। অ্যালান বলের মতে, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মতাে শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা আধা-অলীক ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। এককথায় বলা যায় যে, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও বিচারকদের ভূমিকা প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।


এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।


দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি | দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়ােজনীয়তার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি


আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা | আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের কার্যাবলি