লোক আদালত গুলোর উদ্দেশ্য, গঠন ও কার্যাবলি বা কার্যপদ্ধতি | লােক আদালতের ধারণা

লােক আদালতের ধারণা

ভূমিকা : ভারতের বিচার ব্যবস্থায় বিরােধ নিষ্পত্তির এক অভিনব বিকল্প রূপ (an innovative form of alternative Disputes Resolution) এবং সাম্প্রতিক সংযােজন হল লোক আদালত। লােক আদালত বলতে আমরা সেইসব আদালতের বুঝি যেখানে দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক বিবাদ, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরােধ, পথ দুর্ঘটনা, বিমা সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন প্রভৃতি দেওয়ানি মামলার বিচার কম খরচে দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনা থাকে। তাই স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প ব্যয়ে মানুষের কাছে ন্যায়বিচার পৌছে দেওয়ার এক প্রগতিশীল পদক্ষেপ হিসেবে লােক আদালতকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জে সি জোহারি তাঁর 'The Constitution of India : A Politico Legal Study' গ্রন্থে বলেছেন যে - ন্যায়বিচার কখনােই ব্যয়সাপেক্ষ অথবা সময়সাপেক্ষ হওয়া উচিত নয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে। বিষয়টি গ্রহণীয় হওয়া উচিত ("Justice should neither be costly nor delayed. It should be within the reach of the common man and that it should be available to the aggrieved person or party within a reasonable time.")


লোক আদালত গুলোর উদ্দেশ্য: গান্ধীর মহান নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন লোক আদালত সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য গঠন করা হয়েছে। সাধারণ জনগণ যাতে দ্রুত, স্বল্প ব্যয়ে ন্যায়বিচারের পরিসেবা পেতে পারে তার জন্য লোক আদালত সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকে। এরূপ আদালত গঠনের কতকগুলি উদ্দেশ্য রয়েছে, সেগুলি হল一

  • প্রচলিত বিচারব্যবস্থার উপর থেকে কিছুটা চাপ হ্রাস করা।
  • ছোটোখাটো কম গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলির বিরােধ নিষ্পত্তি লােক আদালতের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে।
  • লােক আদালতের আর-একটি উদ্দেশ্য হল স্বল্প ব্য়ে ন্যায় বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
  • সর্বোপরি দ্রুত মামলার বিচার পাওয়ার জন্য লোক আদালত গঠন করা হয়, যাতে দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষদের মুখে একটু হাসি ফোটানাে সম্ভব হয়।

লোক আদালতের গঠন প্রক্রিয়া: ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রক দ্বারা সমাজের গরিব মানুষদের বিনামূল্যে আইনি সাহায্য ছাড়াও লােক আদালত প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি অ্যাক্ট ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে একটি আইনি স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে দিল্লি হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় যে, সমস্ত সরকারি মন্ত্রক ও দপ্তরে লােক আদালত গঠন করা বাধ্যতামূলক এবং প্রত্যেক রাজ্যের জন্য পৃথক লােক আদালত প্রতিষ্ঠা করা দরকার। পি এন ভগবতীকে লােক আদালতের জনক বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে আইনি পরিসেবা কর্তৃপক্ষ আইনটিকে সংশােধিত করে। এই সংশােধনী আইনের ১৯(১) নং ধারায় বলা হয়েছে কেন্দ্র, রাজ্য, জেলা ও তালাকের আইনগত পরিসেবা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। এই কর্তৃপক্ষের হাতে লোক আদালত গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সংবিধানের ১৯(২) নং ধারানুযায়ী একটি অঞ্চলের লোক আদালত একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং তার মনােনীত কোনাে অধস্তন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কোনাে ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে গঠিত হয়। লোক আদালতের সদস্য সংখ্যা কত হবে তা আইনগত পরিসেবা কর্তৃপক্ষ স্থির করে থাকে। সাধারণভাবে একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ও একজন সমাজসেবী কে লোক আদালতের সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়। খ্যাতনামা আইনজীবী এই লােক আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে কার্য সম্পাদন করেন।


লোক আদালতের কার্যাবলি: লোক আদালতের কার্যক্ষেত্রের পরিধি নিতান্ত কম নয়। মূলত লােক আদালত যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপের কাজগুলি সম্পন্ন করে থাকে, সেগুলি হল

  • দীর্ঘদিন যাবৎ যেসব মামলা অমীমাংসিত রয়েছে, সেইসব মামলাগুলি যদি অন্য কোনাে আদালত তাকে আদালতে হস্তান্তরিত করে, তাহলে তাকে আদালত সেই মামলার দ্রুত মীমাংসা করতে পারে।
  • কোর্টের বাইরে আপস মীমাংসার উপর গুরুত্ব আরােপ করে লােক আদালত উভয় পক্ষকে বিরােধ মিটিয়ে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে থাকে।
  • লোক আদালত কোনাে মামলার বিচার করতে গিয়ে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি চাইতে পারে কিংবা অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে এই আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
  • লােক আদালতগুলি বিবাহ সংক্রান্ত বিরােধ, বিভিন্ন ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত দাবি, বিমা ও দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি বিরােধের সুষ্ঠু মীমাংসা করতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার লােক আদালত যে রায়টি গ্রহণ করে, সেই রায়টিই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। এই কারণেই এই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোনাে ধরনের আপিল করা যায় না।
  • সাধারণভাবে ক্ষতিপূরণ দাবি, বন্টন সংক্রান্ত কোনাে মামলা, পারিবারিক মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে লোক আদালত গুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দিল্লিতে সর্বপ্রথম লােক আদালত বসে।


লােক আদালতের কার্যপদ্ধতি: লােক আদালতের কার্যপদ্ধতি অন্যান্য সাধারণ বিচারবিভাগীয় কার্যপদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। লােক আদালতের কার্যপদ্ধতিগুলি হল—

  • পরস্পর বিবদমান যে-কোনো এক পক্ষকে সংশ্লিষ্ট বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য লিখিতভাবে আবেদন জানাতে হয়। এরূপ আবেদনপত্র পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষা করার পর আবেদনটি যদি গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিরােধটির নিষ্পত্তির দায়িত্ব লােক আদালতের উপর ন্যস্ত করা হয়।
  • যে-কোনাে বিবাদ মীমাংসার জন্য লোক আদালতে ন্যায় (Justice), সততা (fairplay), সমদর্শিতা (equality) এবং অন্যান্য আইনগত নীতি অনুসরণ করতে হয়।
  • লােক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না, অপরদিকে সাধারণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। এক্ষেত্রে কোনাে বিবাদ নিষ্পত্তি করতে লোক আদালত ব্যর্থ হলে বিবদমান পক্ষ সাধারণ আদালতের কাছে বিচারের জন্য প্রার্থনা জানাতে পারে।


লোক আদালত উপরােক্ত শর্তসাপেক্ষে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে। অন্যান্য সাধারণ বিচার বিভাগের ন্যায় লােক আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ থেকে শুরু করে, সরকারি সকল নথিপত্র তলব করে থাকে। এরূপ আদালতগুলি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে কঠিন মামলাগুলির সুষ্ঠু মীমাংসা করে নিজের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে।


বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা/অতি সক্রিয়তা কাকে বলে? বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তার প্রকৃতি পর্যালােচনা করাে।


ভারতের বিভিন্ন ধরনের আদালতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।


পশ্চিমবঙ্গের বিচারব্যবস্থায় উচ্চ আদালতের অন্তর্ভুক্ত আদালত সমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।