সমকালীন উদারনীতিবাদের বিভিন্ন ধারা | সমকালীন উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য

সমকালীন উদারনীতিবাদের প্রেক্ষাপট: সমকালীন উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা এমন একটি উদারনৈতিক সমাজ গড়ে তুলতে চায়, যে সমাজে ব্যক্তিকে সব ধরনের স্বৈরাচারের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ এখানে ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিত্বের এবং তার সামাজিক গোষ্ঠী সমূহের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। সমকালীন উদারনীতিবাদ মিলটন ফ্রিডম্যান তার ‘Capitalism and Freedom’ শীর্ষক গ্রন্থে সমকালীন উদারনীতিবাদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেছেন। এই নীতিতে রাজনীতির স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজতন্ত্রবাদের কোনাে সামঞ্জস্য নেই। সমকালীন উদারনীতিবাদীরা মূলত মুক্ত বাজার সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন।


সমকালীন উদারনীতিবাদের বিভিন্ন ধারা

সমকালীন উদারনীতিবাদের ধারাগুলিকে নিয়ে বিভিন্ন উদারনীতিবিদদের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তার মধ্যেও J W Smith সমকালীন উদারনীতিবাদের যে তিনটি ধারার কথা বলেছেন, সেটিই বেশি গুরুত্ব পায়। ধারাগুলি হল—


(১) ইচ্ছা স্বাতন্ত্র্যবাদ বা নয়া উদারনীতিবাদ: নয়া উদারনীতিবাদ মূলত সনাতন উদারনীতিবাদের এমনই একটি সংস্করণ যে, এই মতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তত্ত্বে আস্থাশীল হওয়ার দরুন এই মতবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা জনকল্যাণকর রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির অর্থনৈতিক কাজকর্মে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের চরম বিরােধিতা করেছেন। বার্কলের মতে, নয়া উদারনীতিবাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, যথা(a) অবাধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথে অবস্থিত বাধাগুলিকে অপসারণ করা। (b) রাষ্ট্রের জনহিতকর কাজকর্মের অবসান ঘটিয়ে তার ক্ষমতাগুলিকে সংকুচিত করা। ইচ্ছা স্বাতন্ত্রবাদ ও নয়া উদারনীতিবাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকার দরুন নর্মান বেরি, নয়া উদারনীতিবাদ কে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, যথা

  • পরিণতিবাদী: পরিণতিবাদ মুক্ত সমাজ গঠনের তত্ত্বে বিশ্বাসী, যেখানে সামাজিক সুখ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। এই নীতির প্রবক্তারা (বুকানন, ডেসমন্ড কিং) মনে করেন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে ব্যক্তির আচরণ ও কার্যাবলির মাধ্যমে। বুকানন-এর মতে, এমন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেখানে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের কার্যাবলি যথেষ্ট সীমিত থাকবে। এর ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যক্তিগত পছন্দ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়।
  • অধিকার সংক্রান্ত বা নৈতিক নয়া উদারনীতিবাদ: এই ধারাটির প্রধান প্রবক্তা হলেন রবার্ট নজিক। তিনি সর্বাপেক্ষা কম শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। রবার্ট নজিক সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি জোরালাে বক্তব্য রেখেছেন। তার মতে, সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনাে ব্যক্তিকে সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা একটি অনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।


(২) উদারনৈতিক সমতাবাদ: সমকালীন উদারনীতিবাদের আর-একটি ধারা হল উদারনৈতিক সমতাবাদ। এই উদারনৈতিক সমতাবাদকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা

  • নয়া সমতাবাদ: নয়া সমতাবাদ-এর অন্যতম প্রবক্তা হলেন জন রলস। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, উদারনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় নীতিই একইসঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে। তার বক্তব্যের মূল বিষয় হল স্বাধীনতা, আত্মসম্মান, সুযােগ, আয় ও সম্পদের মতাে সমাজের সকল মূল্যবােধকে সকলের মধ্যে সমান ভাবে বন্টন করে দেওয়া হােক। রলসের মতে, ন্যায়ের অর্থ হল ন্যায্যতা। ন্যায্যতা হিসেবে ন্যায়ের ধারণা - 'দুটি নীতি' এবং 'দুটি অগ্রাধিকারের নিয়মের' উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
  • সম্পদের সমতাবাদ: উদারনীতিবাদকে সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য করে গড়ে তােলার জন্য রােনাল্ড ডায়াের্কিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মতে, নাগরিকদের জীবনকে উন্নত করার জন্য সরকারকে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। ডায়াের্কিন, বাজারচলতি নিলাম পদ্ধতির দ্বারা সম্পদ বণ্টনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তিনি নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পদের বন্টন ব্যবস্থার দ্বারা বােঝাতে চেয়েছিলেন যে, এই ধরনের বন্টনের ফলে প্রত্যেকে একই পরিমাণ সম্পদ না পেলেও, তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ অনুযায়ী সন্তুষ্ট থাকতে হবে।


(৩) উদারনৈতিক বহুত্ববাদ: উদারনৈতিক বহুত্ববাদকে উদারনীতিবাদের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জন গ্রে-এর 'Liberalism' গ্রন্থে উদারনৈতিক বহুত্ববাদ-এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হল一

  • বহুসংস্কৃতিবাদ: উদারনৈতিক চিন্তাধারা তথা বহু সংস্কৃতিবাদ-এর প্রধান প্রবক্তা হলেন উইল কিমলিকা, চার্লস টেলর প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। বহু সংস্কৃতিবাদ প্রধান কথা হল一 (a) সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়, কারণ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বিরাজমান, (b) সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও তা মানুষকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা প্রতিটি সংস্কৃতির নিজস্ব সত্তাকে স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য রাজনৈতিক মূল্যবােধের ক্ষেত্রকে বর্জন করেছেন।
  • সম্প্রদায় বাদ: সম্প্রদায় বাদ এমন এক রীতি বা পদ্ধতি, যার উদ্ভব ঘটেছে পাশ্চাত্যের উদারনীতিবাদকে সংকটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। বলা যেতে পারে, এই রীতিটিও বহু সংস্কৃতিবাদ তত্ত্বের সমতুল্য। স্যান্ডেল, ম্যাকিনটায়ার প্রমুখ প্রবক্তারা সম্প্রদায় এবং সম্প্রদায় জনিত সামাজিক তাৎপর্যকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার জন্যই সর্বজনীন উদ্দেশ্যকে বর্জন করেছেন। সম্প্রদায় বাদীরা মনে করেন, মানুষের মধ্যে বিরােধের পরিবর্তে পারস্পরিক সহযােগিতার ভাব ও অভিপ্রায় বর্তমান রয়েছে। এই মতবাদীরা মানুষের জীবনে ব্যক্তিস্বাধীনতা অপেক্ষা সম্প্রদায়ভিত্তিক সংঘের উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। সম্প্রদায় বাদ উদারনীতিবাদের বিপরীতপন্থী মতবাদ এই যুক্তি খণ্ডন করার জন্য সম্প্রদায় বাদীরা উদারনীতিবাদকে নস্যাৎ করার পরিবর্তে সেই মতবাদের মনুষ্যত্বপূর্ণ রূপ সর্বসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এককথায় বলা যায়, উদারনীতিবাদকে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্প্রদায়ের মূল উদ্দেশ্য।


সমকালীন উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য


[1] সমকালীন উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হল—ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্যক্তিকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়।


[2] সমকালীন উদারনীতিবাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযােগিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়।


[3] বহুজাতিক সংস্থা, সংগঠনগুলির অবাধ স্বাধীনতাকে গুরুত্ব প্রদান করা।


[4] সমকালীন উদারনীতিবাদ জনকল্যাণকর রাষ্ট্র সংক্রান্ত সংশােধনমূলক উদারনীতি ধ্যানধারণা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাকে পরিত্যাগ করেছে।


[5] সমকালীন উদারনীতিবাদ শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ভরতুকি দানের ব্যবস্থা, ন্যূনতম বেতন প্রদান, সকলপ্রকার সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি সম্পাদন করা প্রভৃতির তীব্র বিরােধিতা করেছে।


[6] সমকালীন উদারনীতিবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনীতিবাদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সমকালীন উদারনীতিবাদীরা পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসন ব্যবস্থার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের থেকে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণকে সমর্থন করেন।


সমকালীন উদারনীতিবাদের সমালােচনা


সমকালীন উদারনীতিবাদ সমালােচনার উর্ধ্বে নয়, কিছু সমালােচনা লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল一


[1] সমকালীন উদারনীতিবাদ অত্যন্ত নমনীয় হওয়ায় অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট। উদারনীতিবিদদের চিন্তা ভাবনা যেমন রাষ্ট্র ও তার ভূমিকা, নাগরিকদের আনুগত্য, স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়গুলিই উদারনীতির যথার্থ স্বরূপ অনুধাবন করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে।


[2] মার্কসবাদীদের মতে, এই মতবাদ বুর্জোয়া শ্রেণির রাষ্ট্রদর্শন বলে বিবেচিত হয়। এই মতবাদ বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনুকূল।


[3] সমকালীন উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব, স্বাধীনতা, আনুগত্য প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত ধারণাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে।


[4] এই মতবাদ রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট। কেউই সমকালীন বিশ্বাস বা ঐতিহ্যকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। হবস রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কেন্দ্রীভবন, অসীম রাজতন্ত্র বা রাজার স্বৈরী ক্ষমতাকে স্বীকার করলেও, লুথার এই রাজতন্ত্রের বিরােধিতা করেছেন।


[5] সমকালীন উদারনীতিবাদে পরস্পরবিরােধী ধারণা বর্তমান। এই মতবাদ আদর্শবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছে, অথচ আদর্শবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দর্শন পরস্পরবিরােধী দোষে দুষ্ট।


মূল্যায়ন: উপরোক্ত সমালােচনাগুলি থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলােচনায় সমকালীন উদারনৈতিক দর্শনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকাশ ও বিস্তারের ক্ষেত্রে এই মতবাদটির অবদান অনস্বীকার্য। লাস্কির মতে, সমকালীন উদারনৈতিক মতবাদ হল নতুন জগতের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মতবাদ। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অন্যায়-অবিচারের হাত থেকে অব্যাহতির উপায়কে মানুষ খুঁজে পেয়েছে এই সমকালীন উদারনৈতিক মতবাদের মাধ্যমে।


উদারনীতিবাদের মূল সূত্র | উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি | উদারনীতিবাদের ধারণাটি বিশ্লেষণ করাে


সনাতন উদারনীতিবাদের ধারা | সনাতন উদারনীতিবাদের মৌলিক নীতিগুলি কী কী?


সংশােধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য | নয়া উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য | সংশােধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল নীতিসমূহ