বিপ্লব সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি আলােচনা করাে।

বিপ্লব সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্ব

ভূমিকা: মার্কসবাদে বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজের ক্রমবিকাশ ঘটে এবং একটি শাসক শ্রেণির পতনের ফলে নতুন এক শাসক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীন এই নতুন শাসক শ্রেণি অধিকতর উন্নতিশীলই শুধু নয়, এরা উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরােনাে শাসকশ্রেণি অপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ ও প্রগতিবাদী শক্তি হিসেবে গণ্য হয়।


বিপ্লবের সংজ্ঞা: মার্কসের ভাষায় বিপ্লব হল ইতিহাসের চালিকাশক্তি ("Revolutions are the locomotives of history") বলাবাহুল্য, বিপ্লবের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য মার্কসীয় দর্শনে বিপ্লব তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। হার্বার্ট আপথেকারের মতে, বিপ্লব একটি ইতিহাসগত পদ্ধতি। এই পদ্ধতি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে শাসক শ্রেণি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সুতরাং বিপ্লব হল পুরােনাে একটি শ্রেণির হাত থেকে নতুন এক শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর।


মার্কসীয় ব্যাখ্যা: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী এই বিপ্লব হল সমাজ সম্পর্কিত ব্যবস্থা। বিপ্লব সমাজ জীবনের অংশ বলেই পুরনো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লবের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য মার্কসীয় দর্শনে বিপ্লব তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও শ্রেণি সম্পর্কের বদল ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানধারণা এমনকি অভ্যাস ও বিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে। বলা যেতে পারে যে, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সামগ্রিকরূপে পরিবর্তন ঘটেছে। এই ঐতিহাসিক পদ্ধতির মধ্য দিয়েই আদিম সাম্যবাদী সমাজ ক্রমে দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ এবং সবশেষে সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে। বিপ্লব সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হয়।


বিপ্লবের উদ্দেশ্য: মার্কসীয় দর্শন তত্ত্ব অনুসারে সর্বহারা বিপ্লবের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক সংগ্রামে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। সর্বহারা শ্রেণি এই রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা বুর্জোয়া শ্রেণির হাত থেকে যাবতীয় মূলধন কেড়ে নিয়ে উৎপাদনের সকল উপাদান রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত করে ও উৎপাদন শক্তির উন্নতি ঘটাবে।


সামাজিক বিপ্লবের কারণ: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে অসংগতি ও দ্বন্দ্বই হল সামাজিক বিপ্লবের অর্থনৈতিক ভিত্তি। এই দ্বন্দ্বের ফলেই শ্রেণিসংগ্রামের সৃষ্টি হয়। সমাজ বিকাশের নির্দিষ্ট একটি স্তরে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে পুরােনাে সমাজ ব্যবস্থার বিনাশ ঘটে এবং এর ফলস্বরূপ নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজ বিপ্লব সংঘটিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত যত বিপ্লব সংঘটিত হয় তাদের প্রতিটির মাধ্যমে একটি শােষক শ্রেণির পরিবর্তে আর-একটি শােষক শ্রেণি ক্ষমতাসীন হয়। কেবল শােষণের ধারা নতুন রূপ ধারণ করে। তবে প্রত্যেক বিপ্লবের ফলে সমাজ এক ধাপ করে উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত হয়। কেবল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলেই শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটে।


বিপ্লবের প্রকৃতি: মার্কস কথিত বিপ্লব হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। মার্কসের মতে, বিপ্লব এমন একটি সামাজিক অবস্থা যার মাধ্যমে পুরােনাে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও শ্রেণি সম্পর্কের পূর্বে যে-সমস্ত বিপ্লব হয়েছে, সেগুলির মাধ্যমে একটি শোষক শ্রেণির পরিবর্তে অন্য একটি শােষক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে শােষণের কাজ চালিয়েছে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরেই শ্রেণিশােষণের সমাপ্তি ঘটবে বলে মনে করা হয়।


বিপ্লবের চালিকাশক্তি: মার্কসের মতে, বিপ্লব হল ইতিহাসের চালিকাশক্তি কিন্তু এই বিপ্লব কখনােই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চালিত হয় না। এই বিপ্লবের চালিকাশক্তি হল সমাজ বিপ্লব পরিচালনাকারী শ্রেণি বা গােষ্ঠী। বিপ্লবের চালিকাশক্তি হিসেবে যে শ্রেণি কাজ করে তার মাধ্যমে বিপ্লবের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। যেমন -পুঁজিবাদী বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি বুর্জোয়া শ্রেণি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি শ্রমিক শ্রেণি।


লেনিনের মত: লেনিনের মতানুসারে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে আবার বাহ্যিক দ্বন্দ্বের দ্বারা এই বিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত হয়। বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় উন্নতির বৈষম্যর কারণে বাহ্যিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। লেনিনের মতানুসারে বিপ্লবের জন্য দু-ধরনের পূর্বশর্ত থাকা প্রয়ােজন

  • বিষয়গত অবস্থা: লেনিনের মতে, বিপ্লবের বিষয়গত অবস্থা হল বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বা অবস্থা। তার মতে, বৈপ্লবিক অবস্থার সৃষ্টি হয় যখনㅡ (1) দেশে চরম সমস্যাজনিত কারণে শাসক শ্রেণির পক্ষে কোনাে পরিবর্তন ছাড়া দেশ শাসন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, (2) শোষিত শ্রেণির দারিদ্র্য ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা অস্বাভাবিকভাবে তীব্রতর হয় এবং (3) সাধারণ মানুষ শােষণের অবসানকল্পে স্বাধীনভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হয়। অর্থাৎ বিপ্লবের বস্তুগত অবস্থার সৃষ্টি হলেই বিপ্লব সংঘটিত হয় আবার কেবলমাত্র বিপ্লবের বিষয়গত উপাদান বর্তমান থাকলেই বিপ্লবের সাফল্য সুনিশ্চিত হয় না।
  • বিষয়ীগত অবস্থা: বিপ্লবের বিষয়গত উপাদানের সঙ্গে বিষয়ীগত উপাদানের সংযুক্ত অবস্থানের মাধ্যমেই বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সফল হয়। বিপ্লবের বিষয়ীগত উপাদাসমূহ হল (1) জনগণের বিপ্লবী চেতনা, সংগ্রামী মানসিকতা ও দৃঢ়তা, (2) সকল সংগ্রামী শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য অগ্রগামী বাহিনীর সংগঠন, (3) সংগ্রামী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং নির্ভুল রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণে ও জনগণকে নেতৃত্ব দানে সক্ষম একটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব।
  • বিপ্লব কোনাে আকস্মিক ঘটনা নয়। উপযুক্ত এক বৈষয়িক পরিবেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়। অর্থনৈতিক বিচারে বিপ্লব অপরিহার্য হয়ে ওঠে তখনই যখন বাস্তব পরিবেশ উপযােগী হয়। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক বিলুপ্ত করে ধনতান্ত্রিক সম্পর্ক স্থাপনের বিপ্লব হল বুর্জোয়া বিপ্লব। বুর্জোয়া বিপ্লবের উদাহরণ হিসেবে ১৬৪৮ ও ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের ইংল্যান্ডের বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬ খ্রি.) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.)-এর উল্লেখ করা হয়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ গ্রন্থে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দ্বন্দ্ এবং সর্বহারার বিপ্লবের অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছে। মার্কসীয় বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগামী অংশ বা সাম্যবাদী দল সর্বহারার বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে। তার ফলে নতুন সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়।


বিপ্লব ও হিংসা: বুর্জোয়া লেখকগণ বিপ্লব ও হিংসাকে অভিন্ন বলে মনে করেন কিন্তু মার্কসবাদ বিপ্লব ও হিংসাকে অভিন্ন বলে মনে করে না। মার্কসের মতে, প্রতিটি পুরােনাে সমাজের মধ্যে যখন নতুন সমাজের জন্ম হয়, তখন শক্তি ধাত্রী হিসেবে কাজ করে। বিপ্লব হল এমন এক হাতিয়ার যার দ্বারা পুরােনাে মত ও ধ্যানধারণার পরিবর্তে সুস্থসবল এক নতুন সমাজ জীবনের সূচনা ঘটে। এই কারণে লেনিন বলেছেন যে, বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শােষিত মানুষের উৎস। তবে হিংসা ও বিপ্লব এক নয়- এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত হার্বাট আপথেকারের মতে, হিংসা বিপ্লবের অঙ্গ নয়।


বিপ্লব ও গণতন্ত্র: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বলা হয় যে, বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও পদ্ধতি গণতান্ত্রিক পরিবেশকে বিকশিত করে। বিপ্লবের প্রকৃতি যত বেশি মৌলিক হবে গণতন্ত্রের বিকাশ তত বেশি ব্যাপক ও গভীর হবে। বিপ্লব ষড়যন্ত্রমূলক বা গণতান্ত্রিক নয়, প্রতি বিপ্লবের চেষ্টা হল ষড়যন্ত্রমূলক এবং গণতান্ত্রিক। শােষণের অবসানকল্পে সর্বহারা শ্রেণি যে বৈপ্লবিক আন্দোলনে শামিল হয়, তাকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা হয়।


সমাজতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব: সমাজতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে।

  • সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে সংঘটিত সকল বিপ্লবের মধ্যে সংগ্রামের সমস্ত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। মানুষের দ্বারা মানুষের শােষণ এবং উৎপাদন-উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান এই সমস্ত বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্ভব। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ কর্তৃক মানুষের শােষণ ও শ্রেণিসংগ্রামের অবসান, উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বহারা শ্রেণি কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়।
  • সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। বুর্জোয়া বিপ্লব রাষ্ট্র ক্ষমতা ও শ্রেণিস্বার্থকে সম্প্রসারিত করে।


মূল্যায়ন: মার্কস ও এঙ্গেলসের বিপ্লব সংক্রান্ত তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান এক অমূল্য অবদান হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কাছে বিপ্লব সংক্রান্ত মার্কসীয় তত্ত্ব এক যুগান্তকারী অনুপ্রেরণা। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে মানুষ নিজেদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করেছে, সেখানে মার্কসের বাণী প্রেরণা দিয়েছে।


শ্রেণি কাকে বলে? মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বটি আলােচনা করাে।


মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব । রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসের তত্ত্বের আলোচনা


রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে উদারনৈতিক ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য | রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে উদারনৈতিক ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা