জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করাে | জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় উল্লেখ করাে।

জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি বা ধারণা

কোন দেশের জাতীয় স্বার্থ সেই দেশের অতীত ঐতিহ্য, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেই দেশটির ভূমিকা ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই জাতীয় স্বার্থের মুখ্য প্রয়ােগকারীরা হলেন কোনাে রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কখনাে বা শাসকগােষ্ঠী তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন।


জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ভিন্ন মত: জাতীয় স্বার্থকে নানা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পল সিবিউরি তিনটি অর্থে জাতীয় স্বার্থকে ব্যাখ্যা করেছেন一

  • প্রথমত, জাতীয় স্বার্থ হল একটি আদর্শস্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি।
  • দ্বিতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ হল সেইসকল উদ্দেশ্যের সমষ্টি, যা জাতি এবং তার নেতৃবৃন্দ অনুসরণ করে থাকেন।
  • তৃতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ বাস্তবায়নের বিষয়ে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্যের সম্ভাবনাও জড়িত থাকে।

জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল-এর মতানুসারে, জাতীয় মূল্যবোধ সমূহের সমষ্টিই হল জাতীয় স্বার্থ। এ ছাড়া জর্জ কেন্নান-এর মতে, বস্তুতপক্ষে আমরা যা জানতে এবং অনুধাবন করতে পারি, তাকেই জাতীয় স্বার্থ নামে অভিহিত করা হয়। অপরদিকে হলসটির মতে, অনেকসময় জাতির লক্ষ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমরূপে জাতীয় স্বার্থের ধারণা প্রয়ােগ করা হয়। বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা হ্যান্স জে মরগেনথাউ-এর মতে, ক্ষমতালাভ ও জাতীয় স্বার্থ অভিন্ন। মূলত, ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনেতারা তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তার মতে, কোনাে দেশের বিদেশ নীতি তত্ত্বগতভাবে জাতীয় স্বার্থ ও মতাদর্শের ভিত্তিতে স্থিরীকৃত হয়। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষাকারী ভৌগােলিক সংহতি সংরক্ষণের আবশ্যক হল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে সংরক্ষণ।


জাতীয় স্বার্থ ও ক্ষমতা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিটি রাষ্ট্র তার বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেয়। বলা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় ক্ষমতার নির্ধারক দ্বারাই জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। বস্তুত জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে কোনাে দেশের টিকে থাকার প্রশ্ন জড়িত আছে। প্রতিটি রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণে ভৌগােলিক সংহতি সর্বদা রক্ষা করতে চায়। কোনাে রাষ্ট্রের ভৌগােলিক সংহতি নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে, দেশের জনগণের গ্রহণ ও স্বীকৃতি প্রদানের উপর। এই সমস্ত বিষয়গুলিই জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি বা ধারণার মধ্যে জড়িত রয়েছে।


জাতীয় স্বার্থের প্রাসঙ্গিকতা: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। বলা যেতে পারে, জাতীয় স্বার্থ হল বিশ্ব রাজনীতির মুখ্য নির্ধারক, বিশেষণ বিদেশ নীতির যাত্রা শুরু হয় জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে। একটি দেশের বিদেশ নীতি নির্ধারণে যত মহৎ উদ্দেশ্য পালনের কথা বলা হােক-না-কেন শেষপর্যন্ত কিন্তু জাতীয় স্বার্থ সকল উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যায়। আজকের দিনে পৃথিবীতে যেসকল ঘটনাগুলি ঘটে যেমন— যুদ্ধ ও শান্তি সংক্রান্ত বিষয়, ঠান্ডা যুদ্ধ, জোটনিরপেক্ষতা, শক্তিভারসাম্য, মেরুকেন্দ্রিক রাজনীতি, প্রতিটি ধারণার পিছনে জাতীয় স্বার্থ সক্রিয়ভাবে কাজ করে।


জাতীয় স্বার্থকে অবহেলা করা কোনাে দেশের পক্ষেই সম্ভব নয়। জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতেই একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দর কষাকষির রাজনীতিতে কতটুকু লােকসান করল তার হিসাব সহজেই করা যায়। একটি দেশের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষা, দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, জাতীয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ক্ষমতা,সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা, জাতীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলি জড়িত আছে।


জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উপায়


প্রত্যেক দেশেরই নিজের ব্যবস্থার পক্ষে একটি মতবাদ থাকে, মূল্যবােধ থাকে। তাই নিজের দেশের মতবাদ ও মূল্যবােধকে রক্ষা করা এবং জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে হয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলি নিম্নলিখিতরূপে বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করা হল


(১) কূটনীতি: বর্তমানে কূটনৈতিক উদ্যোগ ও আয়ােজনকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কূটনীতিবিদরা নিজেদের দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যথা—

  • আস্থা অর্জন,
  • আপস মীমাংসা,
  • বলপ্রয়ােগের ভীতি প্রদর্শন।

কূটনীতিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পামার ও পারকিনস তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারের চক্ষু ও কর্ণ বলে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত কূটনীতির মাধ্যমেই কোনাে দেশ তার জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানগুলিকে সার্থকভাবে প্রয়ােগ করতে পারে।


(২) প্রচারকার্য পরিচালনা: জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্য হল প্রচার মাধ্যমকে হাতিয়ার করে রাষ্ট্রসমূহ বিদেশ নীতিতে সাফল্যলাভের চেষ্টা করা। প্রত্যেক দেশের সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের দেশের পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে গণমাধ্যম সমূহের সাহায্যে ব্যাপক প্রচারকার্য পরিচালনা করে। যেমন ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়ন তার রাজনৈতিক মতাদর্শকে সমগ্র বিশ্বের সামনে উপস্থিত করেছিল রেডিয়াে, টিভি ও সংবাদপত্রের নিরন্তর প্রচারের দ্বারা। প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রচারের উদ্দেশ্য হল তার নীতিসমূহকে সমগ্র বিশ্বের দরবারে গ্রহণযােগ্য করে বিশ্বজনমত গঠন করা।


(৩) জোট গঠন: নিজেদের সাধারণ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ, শক্তিবৃদ্ধি, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি জোটের মােকাবিলা প্রভৃতি চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে একাধিক রাষ্ট্র জোট গঠনে শামিল হয়। যেমন— ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের NATO জোট গঠন করা হয়েছিল, অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি গঠন করেছিল WARSAW জোট, আবার ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুলে জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করেছিল।


(৪) অর্থনৈতিক সহযােগিতা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সম্পদশালী দেশ দরিদ্র ও উন্নতিশীল দেশ গুলোর দিকে অর্থনৈতিক সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এর উদ্দেশ্য হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঋণদানকারী রাষ্ট্রের কার্যকলাপের প্রতি ঋণগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলির অকুণ্ঠ সমর্থন আদায় করা। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে আমেরিকা পূর্ব ইউরোপে আর্থিক সহায়তা দানের মাধ্যমে ওই দেশগুলির সমর্থন আদায় করেছিল।


(৫) শক্তি প্রয়ােগ: জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তিধর রাষ্ট্র গুলো শক্তি প্রয়ােগ করে বা শক্তি প্রয়ােগের ভীতি প্রদর্শন করে। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে উত্ত রাষ্ট্রগুলোর অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিকারাগুয়া, অ্যাঙ্গোলা প্রভৃতি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করা যায়।


কূটনীতি, প্রচারকার্য অর্থনৈতিক সাহায্য, ঋণদান, জোট গঠন, বলপ্রয়ােগ ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত হয়ে থাকে। গােপন ও প্রকাশ্য কূটনীতি, দ্বিপাক্ষিক আলােচনা, গ্লোবাল সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখে। এ ছাড়া নগ্ন আক্রমণ ও বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে সুনিয়ন্ত্রিত রাখে।


উপসংহার: জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থরক্ষার পদ্ধতিগুলির মধ্যে এক বা একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে। তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলি তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য ক্ষমতার জোরে পদ্ধতিগুলিকে যেভাবে নিজেদের স্বার্থের সম্প্রসারণে ব্যবহার করতে পারে, উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তবে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিটি রাষ্ট্রের উচিত বলপ্রয়ােগের পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় শান্তিপূর্ণ উপায় অনুসরণ করা।


জাতীয় শক্তির মনস্তাত্ত্বিক উপাদান | জাতীয় শক্তির মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের দিকসমূহ


আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব নির্ণয় করো। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার প্রধান সীমাসমূহ


জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি | জাতীয় স্বার্থের ধারণা বিশ্লেষণ | জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বােঝায়?