রবীন্দ্রনাথের 'সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধের অনুসরণে সংযমের সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্পর্কটি বিচার করো।

প্রাচীন ভারতে প্রথম জীবনে ব্রহ্মচর্য পালন ছিল আবশ্যিক। এর যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মনে হতে পারে শিক্ষাকালের এই কঠোর সাধনা মনকে শুষ্ক করে তুলতে পারে। কিন্তু আসলে তা নয়। জীবনে পরিপূর্ণতা লাভের জন্যই প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংযম সাধনার প্রয়োজন, রসের জন্যই এই নীরসতার আয়োজন। কৃষক উপযুক্ত ফসল প্রাপ্তির আশাতেই ক্ষেতের ঘাস গুল্ম উৎপাটন করে তাকে মরুভূমির মতো করে তোলে। নিয়ম সংযমটা তাই চরম প্রাপ্তির পথে উপলক্ষ্য মাত্র, কিন্তু এটিকেই যদি লক্ষ্য বলে ধরে নেওয়া হয় তবেই নিয়ম-লোলুপতা ষড়রিপুর মতো অপর একটা রিপু হয়ে জীবনকে শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত করতে পারে। এই অবস্থাটা বলা চলে মানুষের জড়তার লক্ষণ। পরিণামহীন এই প্রচেষ্টায় নিবৃত্তিই প্রবল প্রবৃত্তির আকারে জীবন থেকে সৌন্দর্যবোধকে নিষ্পিষ্ট করে দিতে পারে।


পূর্ণতা লাভের দিকে লক্ষ্য রেখে নিয়ম সংযমকেও সংযত রেখে এগুতে পারলেই দেহে-মনে পুষ্টি আসে। দেহের মাংসপেশী প্রভৃতিকে নিয়মিত আকার দিতে হলে তার জন্য একটা শক্ত হাড়ের খাঁচা চাই। তেমনি জীবনের শক্ত ভিত্তিই হল সংযম, জ্ঞান, আনন্দ প্রভৃতিকে এমনি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হয়। সংযমের মধ্যে বিচার, বল, ত্যাগ, দৃঢ়তা সবই থাকবে। প্রবৃত্তিকে সংযত করতে না পারায় শিশু যেমন থালার ভাত ছড়িয়ে ফেলে, গায়ে মাখে, কিন্তু পেটে যায় অল্পই, তেমনি চিত্তকে সংযত করতে না পারলে পরিপূর্ণভাবে সৌন্দর্যকেও ভোগ করা যায় না। অতএব সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যও কল্পনাবৃত্তির সংযম অত্যাবশ্যক। যদি কল্পনার উদ্দামতা কিংবা প্রবৃত্তির উদ্দামতাকে নিজের আয়ত্তে না রাখা যায় তবে অবস্থাটা এমন হবে যেখানে সন্ধ্যাদীপ জ্বালানোর জন্য একটি প্রদীপশিখাই যথেষ্ট, সেখানে যেন গোটা ঘরেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল।


তবে এ কথাও সত্য যে আমাদের প্রবৃত্তির তুষ্টির সঙ্গে সৌন্দর্যেরও একটা সম্পর্ক আছে—এটা অবশ্য উপরি পাওনা। ক্ষুধা-নিবৃত্তির আয়োজন ছাড়াও ফলের স্বাদে, গন্ধে, দৃশ্যে এককথায় সৌন্দর্য—এগুলি না থাকলেও ফল খেতে হত ; কাজেই এর সৌন্দর্যটা একটা অতিরিক্ত পাওনা। ক্ষুধা তৃপ্তির সঙ্গে সৌন্দর্য যুক্ত থাকে বলেই আমরা গোগ্রাসে গিলতে বসি না, তার মধ্যেও একটা শোভনতা রক্ষা করে চলি। এই শোভনতাই আমাদের ক্ষুধার প্রবৃত্তিকে উগ্র হতে দেয় না। অতএব সৌন্দর্যবোধ আমাদের কেবলমাত্র প্রয়োজনের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে আনন্দের সম্বন্ধ পাতায় এবং এতেই আমাদের মুক্তি। অতএব দেখা যাচ্ছে, সৌন্দর্য যেমন আমাদের ক্রমশ শোভনতা ও সংযমের দিকে টানছে, ঠিক তেমনি বিপরীতক্রমে সংযমও আমাদের সৌন্দর্যভোগের গভীরতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।


পতিব্রতা সতী সাধ্বী স্ত্রীই প্রেমের যথার্থ সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে, স্বৈরিণী নারীর পক্ষে তা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। সৌন্দর্যপ্রিয়তার মধ্যে অনুরূপ সতীত্বের সংযমের প্রয়োজন। পেটুক ব্যক্তির আনন্দ ভুরি-ভোজনেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু প্রকৃত ভোজন-রসজ্ঞ সে হতে পারে না, কারণ আহার বিষয়ে তার শুচিতা বা রুচিবোধ অথবা সংযম নেই; পৌষ্যরাজ উতঙ্ককে বলেছিলেন যে অন্তঃপুরে গেলে তিনি মহিষীর দর্শন পাবেন, কিন্তু অশুচি অবস্থায় ছিলেন বলে উতঙ্ক মহিষীকে দেখতে পেলেন না। এ সমস্ত থেকেই প্রমাণিত হয়, যিনি লোভী এবং ভোগী, তিনি যথার্থ সৌন্দর্যের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন না, একমাত্র সমাহিত সাধকের নিকটই যথার্থ সৌন্দর্য প্রত্যক্ষবৎ আবির্ভূত হয়।


শুধু ধর্মনীতির দিক থেকেই নয়, আনন্দের দিক থেকে, খাঁটি আর্টের দিক থেকে বিচার করলেও সৌন্দর্যের প্রয়োজনে সংযমের উপযোগিতা স্বীকার করে নিতে হয়। শাস্ত্রেও বলেছে, সুখের জন্যও সংযমী হবে। ইচ্ছার চরিতার্থতার জন্য যেমন ইচ্ছাকে দমন করতে হয়, তেমনি সৌন্দর্য ভোগ করতে চাইলেও ভোগলালসার প্রবৃত্তিকে দমন করা প্রয়োজন। ব্রহ্মচর্য সাধনকে তাই সৌন্দর্যবোধের উদ্বোধনের নিমিত্ত অত্যাবশ্যক বিবেচনা করা হয়। তবে বাস্তব অবস্থা-বিশ্লেষণে অনেক সময় একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে কারণ, অনেক সময়, অনেক গুণী কলাকুশলীকেই অসংযত জীবন-যাপন করতে দেখা যায়। তা থেকে মনে হতে পারে যে অসংযত জীবনও সৌন্দর্যসৃষ্টি এবং ভোগ করতে পারে। কিন্তু মানুষ সম্বন্ধে বাস্তব বৃত্তান্তকে বিচার করলেই আমরা ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হব।


প্রত্যক্ষতার জন্যই আমরা বাস্তবকে বিশ্বাস করি। কিন্তু মানুষ সম্বন্ধে যা বাস্তব, তা অনেকটা অপ্রত্যক্ষ বলেই বিচারে বিভ্রান্তি ঘটে। তাই নেপোলিয়ন কারও মতে দেবতা, কারও মতে দানব। কাজেই মানুষের যে অংশ প্রত্যক্ষ, তাতেই আসল সত্যটা ভেসে বেড়ায় না, তা ডুবে থাকে অপ্রত্যক্ষের মধ্যেই। জগতের গুণী শিল্পীদের সম্বন্ধেও কথাটি সমভাবে প্রযোজ্য। তাঁরা প্রকৃতই যেখানে গুণী, সেখানে তাঁরা সাধক তপস্বী, চিত্তের সাধনা ও সংযম সেখানে অবশ্য বিদ্যমান। তাঁদের এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অন্তর্নিহিত ও অপ্রত্যক্ষ বলেই সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকে। তাদের চরিত্রের অসংযত দিকটাই প্রত্যক্ষ বলে সাদা চোখে ওটাই ধরা পড়ে। এ অবস্থায় মনে হতে পারে তাহলে চরিত্রের অসংযম এবং সৌন্দর্যবিকাশ-ক্ষমতার বুঝি সহাবস্থান সম্ভবপর। উভয়ের অপরিণত অবস্থায় এটি সম্ভবপর হলেও পরিণত অবস্থায় তা সম্ভব নয়, তখন প্রবৃত্তির বিক্ষোভ ও চিত্তের অসংযম কখনও সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে একত্র থাকতে পারে না। এই কারণেই বিশ্বামিত্রের ক্রোধ ও দত্তের সৃষ্টি নোতুন জগৎ খাপছাড়া হয়ে থেকে পরে বিনষ্ট হল। আমাদের লোভ-ক্রোধাদি অসংযত প্রবৃত্তি নিজের চারদিকে এমন-সকল বিকার উৎপাদন করে, যাতে বিধাতা-সৃষ্ট জগতের বিরুদ্ধেই শুধু তার আস্ফালন নিবদ্ধ থাকে না, যা কখনও সত্যের, সৌন্দর্যের স্বরূপকেও পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে না।" তাই সৌন্দর্যবোধ বা সৌন্দর্যের সৃষ্টির সঙ্গে সংযমকে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত বলে স্বীকার করে নিতে হয়।