মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট' মহাকাব্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

ইংরেজি সাহিত্যের অবিস্মরণীয় মহাকাব্য 'প্যারাডাইস লস্ট'-এর প্রকাশকাল ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ। ‘প্যারাডাইস লস্ট', 'প্যারাডাইস রিগেইণ্ড' এবং 'স্যামসন অ্যাগোনিস্টস্,— এই তিনটি শ্রেষ্ঠ কাব্য মিল্টনের জীবনের শেষভাগে অন্ধ অবস্থায় রচিত। মিল্টন বলে যেতেন, লিখে নিতেন মেয়েরা কেউ।


‘প্যারাডাইস লস্ট' কাব্যের কল্পনা ও রচনায় রয়েছে মহাকাব্যিক সমুন্নতি ও মহিমা এবং কাব্যটি মহাকাব্যরূপেই স্বীকৃত। কাব্যটির ভাবগৌরব, গম্ভীর ধ্বনি-মাধুর্য, অভিনব চিত্রকল্প অমিত্রাক্ষরে রচিত এর ছন্দ স্পন্দ শতাব্দীর পথ পেরিয়ে আজও রসিকজনচিত্তনন্দিত। কাব্যটি প্রথমে দশটি সর্গে পরিকল্পিত হয়েছিল, পরে মিস্টন একে দ্বাদশ সর্গে নতুন করে সাজান।


বাইবেলের পরিচিত আদম ও ঈভের স্বর্গচ্যুতির কাহিনী নিয়ে মহাকাব্যটি পরিকল্পিত। আদম (Adam) হচ্ছেন আদিপুরুষ এবং ঈভ (Eve) হচ্ছেন আদি নারী। প্রথম সর্গে রয়েছে বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত আভাস, দৈবী প্রেরণা প্রার্থনা। তারপর বিদ্রোহী দেবদূতগণ ও তাদের দলপতি শয়তানের স্বর্গ থেকে নির্বাসন। দ্বিতীয় সর্গে, নরকে শয়তানের প্রাসাদ 'প্যান্ডিমোনিয়ম' (Pandemonium)-এ বিদ্রোহী দেবগণের মন্ত্রণাসঙ্গী এবং শয়তান কর্তৃক আদম ও ঈভকে প্রলুদ্ধ করবার দায়িত্ব গ্রহণ। তৃতীয় সর্গে, শয়তানকে আসতে দেখে আদম ও ঈভের পতনের আশঙ্কায় তাদের সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর কর্তৃক রাফায়েলকে প্রেরণ মানুষের পাপ-ভার নিজে বহন করবেন ঈশ্বর-পুত্রের এই সংকল্প আলোকদূতরূপে শয়তানের পৃথিবী সন্নিকটে আগমন এবং এই পৃথিবী ভবিষ্যতে মূর্খের স্বর্গে পরিণত হবে, কল্পনায় হৃষ্টতাবোধ। চতুর্থ সর্গে, নন্দনবনে (Garden of Eden) নিষ্পাপ নরনারী, আদম ঈভের চিত্র; ঈভকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাবার জন্য স্বপ্নে প্রলুদ্ধ করতে গিয়ে দেবদূত রাফায়েল কর্তৃক শয়তানের বন্দীত্ব এবং পরে মুক্তি। পঞ্চম সর্গে, ঈভ কর্তৃক আদমকে স্বপ্নবৃত্তান্ত কথন; ঈশ্বর-প্রেরিত দৃত রাফায়েলও নন্দনকাননে এসে উপস্থিত হন এবং শয়তান সম্পর্কে আদমকে অবহিত করেন, তাঁকে ঈশ্বরের আনুগত্য সম্পর্কে উপদেশ দেন। আদমের অনুরোধে রাফায়েল তাকে বলেন কেন এবং কীভাবে শয়তান তার সাঙ্গপাঙ্গদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও চক্রান্তে উৎসাহিত করেছেন। ষষ্ঠ সর্গে, শয়তান কর্তৃক ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহে ঈশ্বর কর্তৃক সাঙ্গপাঙ্গ শয়তানের পরাজয় ও বিতাড়িত হওয়ার কাহিনী রাফায়েল কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম স্বর্গে, ঈশ্বর ছয়দিনে কীভাবে এই নতুন জগৎ, পৃথিবী সৃষ্টি করলেন রাফায়েল কর্তৃক আদম ও ঈভকে সেই সৃষ্টি-পুরাণ কথা এখানে বর্ণিত হয়েছে। অষ্টম স্বর্গে, আদমের সঙ্গে রাফায়েলের আলোচনা প্রসঙ্গে এই বিশ্বজগৎ তথা সৌরজগতের কথা, মানবসৃষ্টির কথা, মানব-মানবীর পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে কথা প্রভৃতি আছে। নবম স্বর্গে, সর্পরূপী শয়তান ঈভকে জ্ঞানবৃদ্ধের ফল খেতে প্রলুব্ধ করলেন এবং তাতে শয়তান সফল হলেন, ঈভ আদমকে এই ঘটনার কথা জানালেন। পরিণাম জেনেও ঈভের প্রতি অত্যধিক ভালবাসার জন্য একই পরিণতি লাভের উদ্দেশ্যে আদম কর্তৃক ঈভের আনা জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলেন। ফলের মধ্যে স্বর্গীয় নিষ্পাপ সরলতার অবসান ঘটল। এল লজ্জাবোধ, এল বিভেদ ও বিচারবোধ। দশম স্বর্গে, এই দৈবনির্দেশভঙ্গকারীদের বিচারার্থে ভগবান তাঁর পুত্রকে প্রেরণ করলেন। এই আদি মানব-মানবীর সম্পর্কে ঈশ্বরের নির্দেশ বিঘোষিত হল। পাপ ও মৃত্যু চলল পৃথিবীর দিকে। নরক থেকে পৃথিবী পর্যন্ত রাস্তা তৈরি হল।


এই সাফল্যে শয়তান এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা উল্লসিত হলেও তাঁরা সাময়িকভাবে সর্পে রূপান্তরিত হলেন। অনুতপ্ত আদম ও ঈভ তাঁদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের এই পাপ থেকে উদ্ধার কামনায় ঈশ্বরপুত্রের শরণাপন্ন হলেন। একাদশ স্বর্গে, ঈশ্বর আদম ও ঈভের অনুতাপবাণী শুনলেন, কিন্তু নন্দনকাননচ্যুতির আদেশ দিলেন ; দেবদূত মাইকেল দৈব ক্ষমতায় মানবের ভবিষ্যৎ দর্শন করেন, আদমকে দর্শন করালেন। দ্বাদশ সর্গে, ভবিষ্যৎ যুগের মানুষকে এই পাপ থেকে উদ্ধার করতে ভগবৎ-প্রেরিত উদ্ধারকর্তা, ঈশ্বর-পুত্রের দ্বিতীয় আগমনের (second coming) কথা মাইকেল জানালেন। জানালেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে নানা অনাচার ও ধর্মের নাম দিয়ে ধর্মস্থানগুলির (Church) ভণ্ডামির কথাও। ভাবী মানবমুক্তির আশ্বাসে আদম ঈভ সান্ত্বনা লাভ করলেন, তাঁরা নন্দনকানন (Paradise) থেকে বের হলেন, সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।


এই হল কাহিনী বা কাহিনীর রূপরেখা। কিন্তু অস্থি বা কঙ্কাল দেখে যেমন সেই কঙ্কালধারীর জীবিত অবস্থায়, সেই রক্তমাংসের মানুষের দেহলাবণ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা করা যায় না, তেমনি এই কঙ্কালময়। কাহিনীর রূপরেখা থেকেও মিল্টনের কল্পনার চমৎকারিত্ব অনুমান করা সুকঠিন। স্বর্গ-মর্ত্য-নরক নিয়ে ত্রিভুবনবিস্তারী এই কল্পনা এবং এই ত্রিভুবনের বিচিত্র দৃশ্য ও ঘটনাবলী পাঠক-মনকে বিস্মিত করে উচ্চকিত করে। সবকিছু জড়িয়ে সমগ্র মানবভাগ্য মনোগ্রাহ্য হয়ে এই মহাকাব্যে দেখা দিয়েছিল। শান্ত অটল গাম্ভীর্য অথচ এক আশ্চর্য প্রশান্তির মধ্য দিয়ে মিল্টন মানব-মানবীর পতন এবং ট্র্যাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। শয়তানের চরিত্র অঙ্কনেও মহাকবির কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে, মহৎ না হলেও এবং এই কাব্যের নায়ক না হলেও চরিত্রটি বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বশালী এবং স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষাও দুর্বার। মধুসূদনের রাবণ চরিত্র পরিকল্পনায় এই চরিত্রটির ছায়াপাত ঘটেছে।