'বার্নার্ড শ'-এর নাট্য বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে আয়াল্যান্ড দীর্ঘকাল ইংল্যান্ডের পদানত। কিন্তু তরবারির চেয়েও ধরালো কলমের সাহায্যে আয়ার্ল্যান্ডের সাহিত্যিকগণ ইংল্যান্ডকে জয় করেন, করেন পদানত। এই খ্যাতনামা যোদ্ধাদের মধ্যে প্রখ্যাত হচ্ছেন বার্নার্ড শ' (George Bernard Shaw, ১৮৫৬-১৯৫০ খ্রিঃ) এবং ইয়েটস (William Butler Yeats, ১৮৬৫-১৯৩৯ খ্রিঃ)।


বার্নার্ড শ'-র জন্ম ডাবলিনে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। কুড়ি বছর বয়সে লণ্ডনে আসেন। প্রথমদিকের লণ্ডনের‌ জীবন তাঁর কঠোর সংগ্রামের জীবন। রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি সমাজবাদী চিন্তায় দীক্ষিত হন এবং সমাজতন্ত্রের মন্থর কিন্তু ক্রমবিস্তারের সমর্থক ইংলণ্ডের ফেবিঅ্যান (Fabian) সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য হন। জীবিকার জন্য তিনি সাংবাদিক বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। এই মতবাদের সমর্থনে তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রবন্ধও লিখেছিলেন। 'পল মল গেজেট’-এ সাংবাদিকরূপে, সঙ্গীত সমালোচকরূপে 'স্টার' পত্রিকায় এবং নাট্যসমালোচকরূপে ‘সাটারডে রিভিয়ু’ পত্রিকায় তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। এই রাজনীতি ও সাংবাদিকতা ছিল প্রায় ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত (১৮৯৮ খ্রিঃ) তাঁর প্রধান অবলম্বন। এর মধ্যেই ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি‌ খান-পাঁচেক উপন্যাস লিখে সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেন। কিন্তু পাঠকমহলে এই উপন্যাসগুলি সমাদর ও স্বীকৃতি পায় নি। এর মধ্যে 'অ্যান আনুসোস্যাল সোস্যালিস্ট' (An Unsocil Socialist) উপন্যাসটির রচনাভঙ্গি এবং কাহিনী বিন্যাস সুন্দর। শ'র প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ এখানে না ঘটলেও লেখকের ভবিষ্যৎ চিন্তা ভাবনা কোনদিকে যাবে তার ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যাবে।


এরপরই শ’ একটি নাটক রচনায় হাত দেন। দীর্ঘদিন অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে নাটকটি সম্পূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হয়। এই প্রথম নাটকটির নাম 'উইডোয়ার্স হাউসেস' (Widowers Houses ) । নাটকটি একটি কমেডি। লন্ডনের বস্তি জীবনকে ঘিরে কদাচার আবর্তিত হচ্ছিল, তাকেই তিনি নাটকের বিষয় করে তুলেছেন। এই বস্তির মালিক একজন ভূস্বামী, গরীব শ্রমিকদের সেই বস্তি ভাড়া দিয়েছে। নাটকটিতে দৃশ্যের পর দৃশ্যে একাধারে ঐশ্বর্য ও অসহ দারিদ্র্য, বিলাস বৈভব ও বঞ্চনার বৈষম্য দেখান হয়েছে। নাটকটির এই কাহিনী সমাজের বাস্তব রূপ হলেও ইংলণ্ডের নাট্যজগতে এই বিষয় অভিনব।


এরপর থেকে একে একে শ'-র নাটক রচনা ও অভিনয় চলতে থাকে। তিনি প্রায় ৫০টির মত নাটক লিখেছেন। তাঁর নাটকগুলিতে যেমন কোথাও সামাজিক সমস্যাবলী প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে, তেমনি আবার কোথাও ধর্মচিন্তা, সামাজিক অনুশাসন তথা মানব সংসারে প্রায় সমস্ত পরিধিতেই তাঁর ভাবনা চিন্তার স্বাক্ষর রয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর স্পষ্ট বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। ফলে শ’য়ের নাটকগুলি হয়েছে বক্তব্যপ্রধান (drama of ideas)। শ'র মানসিক পরিমণ্ডল গঠনে একদিকে শেলির মানবপ্রেমের আদর্শ এবং সিডনী ওয়েবের ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি তিনি নাটক রচনায় ছিলেন ইব্‌সেন-এর অনুরাগী। নরওয়ের নাট্যকার ইবসেন ছিলেন আধুনিক নাট্য আন্দোলনের গুরু। তিনি সামাজিক সমস্যাসমূহ নাটকের মধ্য দিয়ে সুন্দর রূপ দিয়েছেন। ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসাধারণ ব্যাকনৈপুণ্য শ'র বৈশিষ্ট্য।


নাটকেই শ’-এর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ এবং ইংরেজী সাহিত্যের উল্লেখ্য নাট্যকারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। অথচ দেখতে গেলে তাঁর নাটকে ত্রুটি কম নয়। তাঁর অনেক নাটকেই নাটকের কুশীলব রক্ত মাংসের সঞ্জীব নরনারী হয়ে ওঠে নি। হয়েছে ঝল্‌মলানো কথার তুবড়ি। সামান্য ঘটনা যা আছে তা ঐ কথাকে সুযোগ করে দেবার জন্যই। চরিত্রগুলিও সর্বত্র স্বাভাবিক হয়নি, হয়েছে মত প্রচারের বাহন। তবুও উজ্জ্বল সংলাপ রচনায়, পাত্র পাত্রীদের কথার চমক এবং বিন্যাসের গুণে আর সব ভুলে যেতে হয়, শ্রোতাগণ অভিভূত হয়। শ'-এর নাটকের চরিত্র-সমূহ-যতখানি আমাদের মস্তিষ্কে আঘাত করে ততখানি আমাদের হৃদয় অধিকার করে না। কারণ কথাই তো সব নয়, জীবনে ভাঙাগড়া, হাসি-অশ্রুও তো রয়েছে। এ সত্ত্বেও বার্নার্ড শ'য়ের প্রতিভাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।


এরপর 'দ্য ফিলান্ডেরার' (The Philanderer), 'মিসেস ওয়ারেন্স প্রফেস' (Mrs Warren's Profession), 'আর্মস এন্ড দ্য ম্যান' (Arms and the Man). 'ক্যানডিডা' (Candida), 'দ্য মেন অব ডেষ্টিনি (The Men of Destiny), এবং ইউ নেভার ক্যান টেল্‌' (You Never Can Tell)—এই নাটক ছয়টির মধ্যে প্রথম তিনটি 'Unpleasant' এবং পরের তিনটি 'Pleasant' রূপে চিহ্নিত হয়ে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘প্লেজ় প্লেজেন্ট‌ এন্ড আনপ্লেজেন্ট' (Plays Pleasant and Unpleasant) নামে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে মিসেস ওয়ারেনস্ প্রফেসস' নাটকের বিষয়বস্তু ছিল পতিতা সমস্যার স্বরূপ নির্ধারণ। অর্থনীতিগত কারণেই যে নারীদেহ বিক্রয়ে বাধ্য হয়—এই দিকটাই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। 'আর্মস এন্ড দা ম্যান'-এ তুলে ধরা হয়েছে যুদ্ধ ও প্রেমের যথার্থ স্বরূপ। যুদ্ধ প্রয়োজনীয়, কিন্তু ভয়ঙ্কর। তার মধ্যে আদর্শের সন্ধান মৃঢ়তারই নামান্তর। এই সময়ে শা রীতিমত নাট্যকার।


‘থ্রিপ্লেজ ফর পিউরিটানস্' (Three Plays for Puritans) সিরিজ-এ ছিল তিনখানি নাটক–‘দ্য ডেভিলস ডিসাইপল' (The Devil's Disciple), 'সিজার এন্ড ক্লিওপেট্রা' (Caesar and Cleopatra) এবং ক্যাপ্টেন ব্রাসবাউণ্ডস কনভার্সন' (Captain Brussbounds Conversion)। শুচিতাপন্থীদের (Puritans) উদ্দেশ্যে লিখিত নাটক তিনটিতে তিনি ধর্ম, কামনা, প্রতিহিংসা প্রভৃতি নিয়ে কাহিনীকে রূপ দিয়েছেন। বেশীর ভাগ দর্শকের কাছেই নাটকগুলি অপ্রিয় হয়ে উঠল, ফলে নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আর্থিক দিক দিয়ে কৃচ্ছ্রতা তাঁর চলতেই থাকল।


১৯০৩ সাল থেকেই ইংল্যান্ডের নাট্যমোদী মহলে শ' প্রিয় নাট্যকার হয়ে উঠলেন। তাঁর উল্লেখ্য নাটক ‘ম্যান এণ্ড সুপারম্যান' (Man and Superman)। নাটকটি অভিনীত হয় ১৯০৫ সালে। মননধর্মী এই নাটকটি শ'-র থিসিসস্বরূপ। গতানুগতিক ধর্মাচরণে তাঁর আস্থা ছিল না। তাই বলে তিনি নাস্তিকও নন। তাঁর বিশ্বাস, জীবনীশক্তি (Life Force) মানুষকে ক্রমবিকাশের পথে নিয়ে যেতে চায়। মানুষেরও তাতে সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যক। এই ইচ্ছা ও জীবনীশক্তি— উভয়ের যোগে পৃথিবীতে একদিন অতিমানবের (Superman) আবির্ভাব ঘটবে। নিশ্চেষ্ট দুর্বল মানুষ পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তাকে মানসিক ও নৈতিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। প্রকৃত সাধনা শাস্ত্রবিধি পালনে নয়, জগতের মঙ্গলের জন্য কাজ এবং সেবাই হচ্ছে প্রকৃত মানুষের সাধনা। শ’ নাটকটিকে বলেছেন, a comedy and a philosophy।


এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে 'জন বুলস্ আদার আইল্যান্ড' (John Bull's Other Island), 'মেজর বারবারা' (Major Barbara), 'দ্য ডক্টরস ডাইলেমা' (The Doctor's Dilemma), 'আঙুেক্লিস এন্ড দ্য লায়ন' (Androcles and the Lion) এমন কি ধ্বনিবিজ্ঞান ও সঠিক উচ্চারণ পদ্ধতি নিয়েই একটি নাটক লিখেছেন, নাম 'পিগম্যালিয়ন' (Pygmalion)।


বার্নার্ড শ'-এর সাহিত্যজীবনের শেষদিকে ১৯২৩ সালে রচিত হয় তাঁর আর একটি বিখ্যাত নাটক 'ব্যাক টু মেথুসেলা' (Back to Methuselah)। নাটকটি অতি দীর্ঘ পাঁচটি পর্বে বিভক্ত, তাই অভিনয় করা কঠিন। কিন্তু নাটকটির বক্তব্য আকর্ষণীয়। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিবর্তনবাদের (Theory of Evolution by Natural Selection) প্রতিবাদ এখানে করেছেন বার্নার্ড শ'। ডারউইন বলেছেন দুর্বলকে হত্যার মধ্য দিয়েই সক্ষমেরা টিকে থাকে। কিন্তু শ'য়ের মতে হত্যা নয়, শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন জীবেরাই বুদ্ধির উৎকর্ষে নিকৃষ্ট বুদ্ধির জীবদের মনের জোরে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। এই মনের জোরেই (will power) একদিন উৎকৃষ্ট মানুষ যুদ্ধ ও পাপহীন পরিচ্ছন্ন পৃথিবী গড়ে তুলবে।


'সেণ্ট জোয়ান' (St. Joan) বার্নার্ড শ'-র আর একখানি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। রচনাকাল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ। জোয়ান অব আর্কের (Joan of Are) কাহিনী নিয়ে রচিত একখানি উৎকৃষ্ট ট্র্যাজেডি। ধর্মান্ধতা বনাম দেশপ্রেম নাটকটির বিষয়।


এরপরেও তিনি খুব উল্লেখ্য না হলেও 'অন দ্য রকস' (On the Rocks), 'দ্য আপেল কার্ট' (The Apple Cart) প্রভৃতি কয়েকটি নাটক রচনা করেন। 'দ্য আপেল কার্ট' এর রচনাকাল ১৯২৩।


১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড শ'র প্রতিভাকে 'নোবেল প্রাইজ' দান করে সম্মানিত করা হয়। আমরণ উদ্যমশীল এই নাট্যকার জীবনের প্রায় শেষদিনেও ১৯৪৯ সালে শ' ফেষ্টিভ্যাল (Shaw Festival) হলে অভিনয়ের জন্য 'বয়েন্ট বিলিয়সন' (Buoynt Billions) নাটক রচনা করেন। এইটিই তাঁর শেষ রচনা।


বার্নার্ড শ' নাট্যকার হিসেবেই বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু তাঁর অন্যান্য গদ্য রচনার সঙ্গে প্রায় প্রতিটি নাটকের ‘ভূমিকা’ (Preface)-ৰূপে লিখিত যে আলোচনা রয়েছে তাতে গদ্যশিল্পীরূপে তাঁর বৈশিষ্ট্য কম উল্লেখ্য নয়। তার মূল নাটক ও নাটকের 'ভূমিকা' (Preface) কৌতূহলী পাঠকের কাছে সমান আকর্ষণীয়।


নিরলস পরিশ্রমী, চিন্তাশীল এই বিতর্কিত মানুষটি তাঁর সময়েই একটি প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।


শেক্সপীয়রের এবং শেক্সপীয়রের পরবর্তীকালের নাটক যে পথে চলছিল বার্নার্ড শ'-এর নাটক সেখানে এক নতুন ব্যতিক্রমের সৃষ্টি করল। প্রশ্ন তুললেন শুধু সমাজ সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়েই নয়, প্রশ্ন তুললেন নাটকের প্রচলিত আঙ্গিক নিয়েও। নাট্যক্রিয়া সৃষ্টিতে শুধু বহিরঙ্গ ক্রিয়া নয়, আলোচনাও যে মানসিক ক্রিয়া করতে পারে তিনি হাতে-কলমে তা দেখালেন, তাঁর হাতে Drama of Action হল Drama of Discussion।


সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। 'আর্ট ফর আর্টস্ সেক’ (art for arts sake) বা ‘শিল্পের জন্যই শিল্প' এ মতেরও তিনি সমর্থক ছিলেন না। 'ম্যান এণ্ড সুপারম্যান' নাটকের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, “শুধু শিল্পের খাতিরে আমি একটি লাইন লেখার কষ্টও স্বীকার করতে রাজী নই।” তাঁর মতে, সাহিত্য জীবনের জন্য, সমাজ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য, শিল্পের জন্য জীবন নয়, জীবনের জন্যই শিল্প। সমস্ত নাটক এবং প্রবন্ধাবলীর মধ্য দিয়ে এই সমাজ ও মানুষের মঙ্গলচেতনায় উদ্দীপিত মানুষটি চলিত নীতি-নিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, বুদ্ধি ও মঙ্গলচেতনার কষ্টিপাথরে তাকে যাচাই করে নিয়েছেন এবং এইভাবেই ভিক্টোরীয় যুগের অন্ত্যপর্বে ও বিশ শতকের প্রথম পাদে যে জিজ্ঞাসার যুগ ( age of interrogation) শুরু হয়েছিল তিনি সেই যুগের একজন প্রতিনিধিমূলক নাট্যকার হয়ে উঠেছিলেন।


অবশ্য এই প্রশ্ন, এই বাদ-প্রতিবাদ তাঁর নাটকে বড় হয়ে উঠলেও জীবনের চেয়ে শিল্পকে বেশী খাতির করতে না চাইলেও তিনি স্বভাবত শিল্পী এবং অনবদ্য ভাষাশিল্পী। তাই তাঁর নাটকের মস্তিষ্কতা (Intellectualism) বড় হয়ে উঠলেও তা শুধু তর্কসর্বস্বই হয়ে ওঠেনি, হয়েছে নাটক এবং আধুনিক যুগের নাটক।