সাহিত্য সমালোচকগণ বাণভট্টকে 'সংযতরুচি' বলেছেন কেন | বাণভট্টের ‘কাদম্বরী' রচনাটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

বাণভট্টের বংশ পরিচয় ও কাল সম্বন্ধে কী জানা যায়?

বাণভট্ট তার 'হর্ষচরিত' গ্রন্থে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তা থেকে জানতে পারা যায় যে অসংখ্য যজ্ঞকর্মের অনুষ্ঠাতা মহাত্মা অর্থপতি ছিলেন বাণের পিতামহ। অর্থপতির বারোজন পুত্রের মধ্যে অষ্টম পুত্র চিত্রভানু হলেন বাণের পিতা। বাণের মাতার নাম ছিল রাজদেবী। শোণ নদের পশ্চিমতীরে তাঁদের আদি ভদ্রাসন ‘প্রীতিকূট', তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল 'ব্রাহ্মণবিধান' নামক গ্রাম। এখানেই বৃদ্ধপিতামাতার শেষ বয়সের সন্তান বাণভট্টের জন্ম। শৈশবে—–সম্ভবত জন্মকালেই তার মাতৃবিয়োগ হওয়ায় পিসিমা মালতী তাকে মাতৃবৎ লালনপালন করেন। বাণের মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর পিতা চিত্রভানুর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে চিত্রভানুর বয়স ছিল আশির কোঠায়। 

কান্যকুব্জাধিপতি হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের সময়কে (৬০৬-৬৪৬ খ্রিঃ) ধরে নিশ্চিতভাবে জানতে পারা যায়। যে বাণভট্ট সপ্তম শতাব্দীর কবি এবং সপ্তমশতাব্দীর প্রথমার্ধেই তিনি সাহিত্য সাধনায় নিযুক্ত ছিলেন।



সাহিত্য সমালোচকগণ বাণভট্টকে 'সংযতরুচি' বলেছেন কেন?

সংস্কৃত সাহিত্য পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই কবিরা নরনারীর প্রেম বর্ণনা করতে বা ঋতু বৈচিত্র্যের আলোচনায় শৃঙ্গার রসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু বাণভট্টের রচনায় সেই নিরঙ্কুর আদি রসাত্মক মনোভাব নেই। কাদম্বরীর একনিষ্ঠতা, মহাশ্বেতার প্রেম তপস্যা কিংবা পত্রলেখার নির্লিপ্ততা সর্বত্রই আশ্চর্য সংযমে গ্রথিত। এই সংযম সংস্কৃত সাহিত্যে তুলনারহিত। পাশাপাশি আরও লক্ষ্য করা যায় যে, বাণের নারীচরিত্রগুলি স্বাধীন। তারা পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কিন্তু তির্যক কামনার প্রশ্রয় দেয় না। পত্রলেখা বন্ধুর মতো দিবারাত্র রাজা চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গে একাঘরে অবস্থান করলেও দেহগত বাসনার আসক্তি সেই বন্ধুত্বকে খর্ব করেনি। মহাশ্বেতা রক্ষী বা সঙ্গী ছাড়াই স্বাধীনভাবে বিচরণ করেন। এই স্বাধীনতা, এই পুরুষের সঙ্গে নারীর সমমনস্কতা সংস্কৃত সাহিত্যে বিরল। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, এই সব আচার আচরণ থেকে যেন কেউ ভেবে না বসেন যে বাণের রচনা মানেই শৃঙ্গার রসমুক্ত। স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক বাণের রচনায় রতিবিবর্জিত হয়নি তবে সেখানেও যে অযথা তির্যক কামনা কখনও প্রশ্রয় লাভ করেনি একথাও স্মরণ করা জরুরী। বাণের এই সংযম দেখেই তাঁকে সাহিত্য সমালোচকগণ ‘সংযতরুচি' আখ্যা দিয়েছেন।



'আখ্যায়িকা' এবং 'কথা' শ্রেণীদুটির লক্ষণ কী? বাণের রচনা কোন্ শ্রেণীভুক্ত?

সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যকে আলঙ্কারিকগণ দুটি ভাগে ভাগ করেছেন; একটি হল 'আখ্যায়িকা' এবং অপরটি ‘কথা’। আখ্যায়িকা রচিত হয় ঐতিহাসিক ঘটনা তথা বাস্তব ঘটনাকে অবলম্বন করে। পক্ষান্তরে কথা রচিত হয়। কোনো কাল্পনিক কাহিনীকে অবলম্বন করে। এই দুই শ্রেণীভেদের প্রধান সমর্থক ভামহ বলেছেন—আখ্যায়িকা রচিত হবে সরল গদ্যে। এবং আখ্যায়িকার নায়ক নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনীই এতে বর্ণনা করবেন। গদ্যের মাঝে মাঝে বক্র ও অপরবক্র ছন্দে রচিত শ্লোক থাকবে এবং কাহিনীটি কয়েকটি ‘উচ্ছ্বাসে' বিভক্ত হবে। কন্যাহরণ, সংগ্রাম, বিরহের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত নায়ক জয়ী হবেন। আখ্যায়িকার ভাষা হবে সংস্কৃত।


পক্ষান্তরে 'কথা' গদ্যকাব্য সংস্কৃত কিংবা অপভ্রংশেও রচিত হতে পারে। এতে বক্র বা অপরবক্র ছন্দে কোনো শ্লোক থাকবে না কিংবা ‘উচ্ছ্বাস’ ভাগও থাকবে না। নায়ক এর কাহিনী বর্ণনা করবেন না এবং এর কাহিনীটি হবে কল্পিত। বাণভট্টের 'হর্ষচরিত' প্রথমোক্ত ‘আখ্যায়িকা' এবং 'কাদম্বরী’ শেষোক্ত ‘কথা’ শ্রেণীভুক্ত রচনা।



বাণভট্টের ‘কাদম্বরী' রচনাটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

'কাদম্বরী' বাণভট্ট-রচিত কথা-জাতীয় গদ্যকাব্য, এর কাহিনী কবিকল্পিত এবং গদ্যে রচিত। অতএব আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক কালের উপন্যাসের সঙ্গে এর একটা সহজ সাদৃশ্য চোখে পড়ায় কেউ কেউ ‘কাদম্বরী’কে সংস্কৃত সাহিত্যের উপন্যাসরূপে অভিহিত করতে চান।


সমস্ত 'কাদম্বরী' কাব্য একটি চিত্রশালা। 'কাদম্বরী' কাব্য-বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এটিই তার সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় প্রশংসোত্তি-রূপে বিবেচিত হয়। অথচ ‘কাদম্বরী’ একটি 'কথা'-জাতীয় গদ্যকাব্য, একালের বিচারে একটি উপন্যাস প্রতিম রচনা, প্রধান আকর্ষণ ছিল তার কাহিনী। ‘কাদম্বরী’তেও একটি কাহিনী আছে, না বলে বরং বলা চলে যে ‘কাদম্বরী’তে কাহিনীর ভিতর থেকে আবার কাহিনী—এইভাবে কাহিনী লহর চলেছে। এতে বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট এবং পরিপূর্ণ চিত্রও রয়েছে, যাদের আকর্ষণযোগ্যতা সন্দেহাতীত; এমনকি নায়িকা না হয়েও এমন পার্শ্বচরিত্র রয়েছে, যার আকর্ষণ এত দুর্বার যে, তার প্রতি সুবিচার করা হয়নি বলে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রটিকে ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ বলে অভিযোগ করেছেন।


বাণের রচনার আর একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর নারীচরিত্র। আশ্চর্যের বিষয় এই যে তাঁর কিছু কিছু নারীচরিত্রকে দেখা যায় স্বাধীনতা উপভোগ করতে; বাণের সঙ্গে বা পরে সংস্কৃত সাহিত্যে নারীপুরুষের সম্পর্কের মধ্যে এই অভিনবত্ব সুলভ নয়। চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গে পত্রলেখার বন্ধুত্ব—সেই বন্ধুত্বের মধ্যে কিন্তু দেহগত বাসনার কোনো আসক্তি নেই। নারী পুরুষের বন্ধুত্বর এ এক অভিনব উদাহরণ। মহাশ্বেতা কোনো সঙ্গী বা রক্ষী ছাড়াই স্বাধীনভাবে বিচরণ করেন। সপ্তম শতাব্দীর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এই রকম ঘটনার পরিকল্পনাই দুঃসাধ্য মনে হয়। বাণভট্ট এখানে তাঁর কবি কল্পনায় নারীর সম্ভাব্য বন্ধনমুক্তির দুঃসাহসী ছবি এঁকেছেন। অনাগত খুশির অগ্রগামী ছায়া এই নারীচরিত্র অঙ্কনে প্রতিফলিত হয়েছে।