'কাদম্বরী কথা' গ্রন্থের রচয়িতা বাণভট্টের রচনাবৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে আলোচনা | কাদম্বরী ও হর্ষচরিত অবলম্বনে বাণভট্টের কৃতিত্ব বিচার করো।

'কাদম্বরী' গ্রন্থ অবলম্বনে বাণভট্টের রচনারীতির বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করো এবং এই গ্রন্থটিকে ‘একটি চিত্রশালা' বলার কারণ

'কাদম্বরী কথা' আর 'হর্ষচরিত' আখ্যায়িকার লেখক ‘কথা’ ও ‘আখ্যায়িকা' শব্দ দুটি কী অর্থে প্রয়োগ করেছিলেন? 'কাদম্বরীকথা'র মূল ঘটনাগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করে লেখকের রচনারীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

“বাণভট্টের 'কাদম্বরী' এবং 'হর্ষচরিত' – দুই-ই গদ্যে রচিত হলেও এই দুই সৃষ্টি তাঁর কবি প্রতিভার আলোকে সমুজ্জল।” —আলোচনা করো।

কল্পনাভিত্তিক 'কাদম্বরী কথা' এবং ইতিহাস-ভিত্তিক আখ্যায়িকা 'হর্ষচরিত'—গদ্যে রচিত হলেও কাব্যধর্মী আলোচনা করো।

'কথা' ও 'আখ্যায়িকা'র পার্থক্য নির্দেশ করো।


'কথাকাব্য' ও 'আখ্যায়িকা কাব্যে'র পার্থক্য:

প্রাচীন আলঙ্কারিকগণ সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেণীবিভাগ করে 'শ্রব্যকাব্যে'র একটি শাখাকে 'গদ্যকাব্য' নামে আখ্যায়িত করেছেন। 'বৃত্তগন্ধোঙ্খিত কাব্য’ অর্থাৎ ছন্দোবিবর্জিত কাব্যকেই ‘গদ্যকাব্য' বলা হয়। এই গদ্যকাব্যের আবার দুই শ্রেণী—‘কথা' এবং 'আখ্যায়িকা'। রচনারীতির দিক থেকে এতদুভয়ের মধ্যে এমন কিছু পার্থক্য নেই। যা’ কিছু পার্থক্য আছে, তা রয়েছে বিষয়বস্তুতে। 'কথা'র বিষয়বস্তু কাল্পনিক, প্রধানত কবির স্ব-কল্পিত। কাল্পনিক বলেই কবি ‘কথাকাব্যে’ আপন প্রতিভাকে স্বচ্ছন্দে প্রবাহিত হবার সুযোগ করে নিতে পারেন, ফলে তার রচনাকে অনেক সরস এবং হৃদয়গ্রাহী করে তোলবার অবকাশ থাকে। এ জাতীয় ‘কথা’ গদ্যে রচিত হলেও নানা ছন্দে রচিত শ্লোকের সন্নিবেশ তাতে সম্ভবপর। বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’, দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত' এবং সুবন্ধু-রচিত ‘বাসবদত্তা' কথা-জাতীয় গদ্যকাব্যের নিদর্শন। পক্ষান্তরে কোনো ঐতিহাসিক কাহিনী কিংবা সত্যঘটনা অবলম্বনে ‘আখ্যায়িকা’ কাব্য রচিত হয়ে থাকে। এ জাতীয় কাব্যে কবি আত্মজীবনীও বিস্তৃতভাবে পরিবেশন করতে পারেন কিংবা অপরাপর কবিদের পরিচয়ও দান করতে পারেন। এ জাতীয় কাব্য কয়েক ‘আশ্বাসে' (অধ্যায়ে) বিভক্ত হয় এবং আশ্বাসের আরম্ভে ছন্দোবদ্ধ শ্লোকের সাহায্যে বর্ণিতব্য বিষয়ের সূচনা করা হয়। বাণভট্ট-রচিত 'হর্ষচরিত’ এরূপ ‘আখ্যায়িকা কাব্য'। বাণভট্টের সমকালীন নরপতি হর্ষবর্ধনের কাহিনী অবলম্বনে কাব্যটি রচিত হয়েছে এবং গ্রন্থারম্ভে কবি বিস্তৃতভাবে আত্মপরিচয়ও দান করেছেন। বস্তুত সংস্কৃত সাহিত্যে খাঁটি ‘আখ্যায়িকা কাব্য’ বলতে এই একটিকেই বুঝিয়ে থাকে। তবে 'কথা' এবং 'আখ্যায়িকা'র এই বিভেদের গুরুত্ব অনেকেই স্বীকার করেন না। 'কাব্যাদর্শ' প্রণেতা দণ্ডী বলেন— ‘কথাখ্যায়িকেত্যেকা জাতিঃ, সংজ্ঞাদ্বয়াঙ্কিতা।' অর্থাৎ 'কথা' এবং 'আখ্যায়িকা’ একই জাতি, শুধু এদের সংজ্ঞাই পৃথক। তবে ‘আখ্যায়িকা’ ঐতিহাসিক তথা বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত বলে তাতে কবির কিছুটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকায় সমকালীন সমাজ-জীবনের একটা বিশ্বাসযোগ্য চিত্র এতে পাওয়া যায়, পক্ষান্তরে একেবারেই কল্পনাশ্রয়ী ‘কথাকাব্যে' সমাজচিত্রের যথার্থ প্রতিফলন না-ও থাকতে পারে।


(ক) কাদম্বরী :

কথা কাব্য : বাণভট্ট রচিত ‘কাদম্বরী’ কথাকাব্য, কবি এটিকে স্বকল্পিত বলে দাবি করলেও অনেকে অনুমান করেন, গুণাঢ্য-রচিত 'বৃহৎকথা' ('বড্ডকহা') নামক পৈশাচী প্রাকৃতে রচিত গ্রন্থ থেকে বাণভট্ট কাহিনীটির ইঙ্গিত পেয়েছেন। কিন্তু বাণভট্ট কোথাও গুণাঢ্যের নিকট ঋণ স্বীকার করেন নি, কিংবা এমন কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণও এর সমর্থনে পাওয়া যায় না। অতএব শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে বাণভট্টকে মৌলিক কাহিনী রচয়িতার মর্যাদা থেকে ভ্রষ্ট করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। 'কাদম্বরী' কল্পিত কাহিনীভিত্তিক বলেই কবি ইচ্ছামতো এর শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে একে এমন একটি প্রকাণ্ড মহীরুহের আকার দান করেছেন, যাতে অনেকেই আশ্রয় লাভ করবার সুযোগ পেয়েছে। এতে জন্মজন্মান্তরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, শুকপক্ষীর মুখ থেকে একটা গোটা কাহিনী শোনা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই এর ঘটনা বর্ণনা লৌকিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমারেখা মেনে চলে নি, .তৎসত্ত্বেও ‘কাদম্বরী' জীবনসম্পর্ক রহিত কাব্য নয়; একালে যাকে 'উপন্যাস' নামে অভিহিত করা হয়, 'কাদম্বরী' সেই জাতীয় জীবনধর্মী কাব্য। নিতান্ত যদি একে 'উপন্যাস' বলে আখ্যায়িত করা সম্ভবপর না হয়, তবে একে ‘রোমান্সধর্মী কাব্য' বলে অভিহিত করার পক্ষে কোনো বাধা নেই।


কাহিনী বিশ্লেষণ : 'কাদম্বরী'তে কাহিনী একটি নয়, কয়েকটি; এমনকি একটা মূল কাহিনীকে কয়েকটি পার্শ্বকাহিনী পরিপুষ্ট করেছে এমন কথাও বলা যায় না। বরং বলা চলে যে নায়িকা কাদম্বরী নামে গ্রন্থনাম 'কাদম্বরী' কল্পিত হয়েছে, মনোহারিত্বে তাকেও অতিক্রম করে যাবার মতো কাহিনীও এতে রয়েছে। এতে কাহিনীর ভিতরে কাহিনী, তার ভিতর আবার কাহিনী— এইভাবে কাহিনীর যেন লহর চলেছে। সংক্ষেপে মূল গল্পটি এই – বিদিশার রাজা শূদ্রকের ভোগ-সুখে মন নেই, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদে দিন কাটান। একদিন এক চণ্ডালকন্যা তাঁর রাজসভায় একটি কথা বলা শুকপাখি নিয়ে এলো, নাম তার বৈশম্পায়ন। রাজার ইচ্ছায় পাখিটি তার আত্মকাহিনী বলতে আরম্ভ করলো। বিদ্ধাপর্বতে পম্পাসরোবর-তীরে এক শিমুলগাছে শুরুপাখিটি তার পরিবারের সঙ্গে থাকতো। এক শবরবাহিনীর অত্যাচারে সবাই মারা পড়লো, মৃতপ্রায় এই শুকপাখিটিকে হারীত মুনি আশ্রমে নিয়ে গেলে তাঁর পিতা ত্রিকালদর্শী জাবালি মুনি বলেছেন যে, শুকপাখিটি নিজের অবিনয়ের ফল ভোগ করছে। আশ্রমের সকলে তখন সেই কাহিনী জানতে চাইলে জাবালি শুকের পূর্ব-পূর্ব জীবনের কাহিনী বলতে লাগলেন। উজ্জয়িনীর রাজা তারাপীড়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু এবং মন্ত্রী ছিলেন শুকনাস। একই দিনে তারাপীড় ও শুকনাসের ছেলে হল, নাম যথাক্রমে চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়ন। দু'জনেই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। যথাসময়ে তাদের বিদ্যাভ্যাসাদি সমাপ্ত হল। তারাপীড় কুলুতরাজ্য জয় করে রাজকন্যা পত্রলেখাকে নিয়ে এসে কুমার চন্দ্রাপীড়ের তাম্বুলকরস্কবাহিনী করে দিলেন, ক্রমে সে কুমারের সখী হয়ে উঠলো। চন্দ্রাপীড় যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে দিগ্বিজয়ে বেরুলেন, সঙ্গে আছেন বৈশম্পায়ন ও পত্রলেখা। তিন বৎসর পর কৈলাসের কাছে কিরাতনগর জয় করে কুমার একজোড়া কিন্নর দেখতে পেয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে এক শিবমন্দিরে দেখতে পেলেন শ্বেতবর্ণা তপঃক্লিষ্টা দিব্যদর্শনা সুন্দরীকে। চন্দ্রাপীড়ের আগ্রহে সুন্দরী তাঁর পরিচয় জানালেন—তিনি গন্ধর্বরাজ হংস ও তাঁর রানি অপ্সরা গৌরীর একমাত্র কন্যা মহাশ্বেতা। তিনি তাঁর দুঃখের কাহিনী বলতে লাগলেন। একদিন তিনি মহর্ষি শ্বেতকেতুর পুত্র পুণ্ডরীকের দর্শনে বিহ্বল হয়ে পড়লে পুণ্ড্ররীক তাঁকে তাঁর কর্ণমঞ্জরী পরিয়ে দিলেন, এই সময় তাঁর জপমালার সঙ্গে মহাশ্বেতার গলার হারটিও বদল হল। পরে পুণ্ডরীকের আমন্ত্রণে অচ্ছোদসরোবর তীরে মহাশ্বেতা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখেন মহাশ্বেতার হারটি বুকে নিয়ে পুণ্ডরীক মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়েছেন। তারপর থেকেই মহাশ্বেতার এই তপস্বিনীর বেশ, তাঁর সঙ্গে আছে শুধু তরলিকা। এদিকে গন্ধর্বরাজ চক্রবর্তী চিত্ররথ ও মদিরার একমাত্র কন্যা কাদম্বরী তার প্রিয় সখী মহাশ্বেতার প্রতি সহানুভূতির বশে নিজেও ‘বিবাহবদ্ধ হবে না' বলে স্থির করায় কাদম্বরী নিজেই তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিবাহে সম্মত করতে যাবেন সংকল্প করে চন্দ্রাপীড়কেও তাঁর সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলেন। চন্দ্রাপীড় ও কাদম্বরী প্রথম দর্শনেই পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। পরদিন কাদম্বরীর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চন্দ্ৰাপীড় অচ্ছোদসরোবরতীরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, তাঁর সঙ্গীসাথীরাও সেখানে উপনীত হয়েছে। পরদিনই কাদম্বরীর নিকট থেকে সংবাদ এলো তিনি অতিশয় উৎকণ্ঠিত ও অসুস্থ—চন্দ্রাপীড় পত্রলেখাকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ হেমকূট যাত্রা করলেন। কাদম্বরীর সেবা-যত্নের কোনো ত্রুটি হচ্ছে না, কিন্তু রোগের উপশম হচ্ছে না। এটি যে প্রেমের অসুস্থতা, এটি মনে বুঝেও নিঃসংশয় হতে না পেরে চন্দ্রাপীড় কাদম্বরীর প্রতি তাঁর প্রকৃত মনোভাব প্রকাশ করতে পারলেন না। অতঃপর পত্রলেখাকে কাদম্বরীর কাছে রেখে চন্দ্রাপীড় শিবিরে ফিরে এসে পিতা তারাপীড়ের আহ্বান লিপি পেলেন। তদনুসারে তিনি একাই রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বৈশম্পায়নকে সসৈন্যে তাঁর অনুসরণ করতে বললেন এবং সৈন্যাধ্যক্ষকে জানিয়ে দিলেন, পত্রলেখাকে যে পৌঁছে দিতে আসবে, তার কাছে সমস্ত ব্যাপারে জানিয়ে যেন কাদম্বরীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। তারপর চণ্ডীবন অতিক্রম করে চন্দ্রাপীড় রাজধানীতে উপনীত হলেন। কিছুদিন পর পত্রলেখা ফিরে এলে তার কাছে কাদম্বরীর প্রেম-বিহ্বলতার সংবাদ পেলেন চন্দ্ৰাপীড়। (এ পর্যন্ত বাণভট্ট-রচিত পরবর্তী অংশ ভূষণবাণ-রচিত)।


কাদম্বরীর প্রণয়বার্তা-শ্রবণে চন্দ্রাপীড় ব্যতিব্যস্ত হয়ে বৈশম্পায়নের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। অচ্ছোদসরোবরতীরে উপনীত হয়ে সংবাদ পেলেন যে বন্ধু বৈশম্পায়ন মহাশ্বেতাকে দেখে উদ্ভ্রান্ত হয়ে তাঁকে স্পর্শ করতে গেলে ক্রুদ্ধা মহাশ্বেতা তাঁকে তির্যকযোনিতে জন্মগ্রহণের অভিসম্পাত দান করলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই সংবাদে চন্দ্রাপীড়ের প্রাণসংশয় দেখা দেয় এবং তা দর্শনে কাদম্বরীও প্রিয়তমের সঙ্গে প্রাণত্যাগে উদ্যত হলে আকাশবাণীতে তাঁকে বিরত করা হয় এবং জানানো হয় যে চন্দ্রাপীড়ের দেহরক্ষা করলে তাতে আবার জীবাত্মা সংযোজিত হবে। মূর্ছিতা চন্দ্রাপীড়ের দেহজাত জ্যোতির স্পর্শে চেতনা লাভ করে অচ্ছোদসরোবরে ঝাপিয়ে পড়লে পুণ্ডরীক-বন্ধু কপিঞ্জল আবির্ভূত হয়ে পুশুরীকের কাহিনী বর্ণনা করেন। চন্দ্রমার শাপে তিনি বৈশম্পায়ন-রূপে মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এখন তিনি চন্দ্রালোকে আছেন। চন্দ্রমাও পুশুরীকের শাপে চন্দ্রাপীড়রূপে জন্মেছিলেন। তাঁরা পুনর্বার কোথায় কীভাবে আছেন, তা' জানেন মহর্ষি শেতকেতু। অতঃপর সেই সংবাদ জানবার জন্য কপিঞ্জল মহর্ষি আশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।


মহর্ষি জাবালি প্রমুখাৎ আত্মজীবনী শ্রবণ করে শুক পূর্বস্মৃতি ফিরে পেলো, এই বৈশম্পায়ন শুকই শুকনাসপুত্র বৈশম্পায়ন এবং পুণ্ডরীক। চণ্ডালকন্যার হাত ঘুরে সে রাজা শুদ্রকের কাছে এসেছে। চণ্ডালকন্যার কথা থেকে জানা গেল যে রাজা শূদ্রকই চন্দ্রমার অবতার চন্দ্রাপীড়। সংবাদ শ্রুত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা শূদ্রক এবং শুকের মৃত্যু ঘটে এবং অচ্ছোদসরোবরতীরে চন্দ্রাপীড় জীবিত হয়ে উঠলেন, পুশুরীকও পূর্ব মূর্তিতে চন্দ্রলোক থেকে নেমে এলেন। চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গে কাদম্বরীর এবং পুণ্ড্ররীকের সঙ্গে মহাশ্বেতার মিলন সাধিত হল। পত্রলেখা-সম্বন্ধে জানা গেল, তিনি চন্দ্রপ্রিয়া রোহিণী—চন্দ্রাপীড়-রূপী চন্দ্রমার সেবার জন্যই তিনি মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।


কাব্যবিচার : বাণভট্ট-রচিত ‘কাদম্বরী' কথাজাতীয় গদ্যকাব্য হলেও এটিকে যে-কোনো সাধারণ রোমান্সের পর্যায়ভুক্ত করা যাবে না; কারণ যে-ভাবে এতে কল্পনার বিস্তার ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত এর পরিণামৌৎসুক্য বজায় রাখা হয়েছে, তাতে শুধু সংস্কৃত সাহিত্যে কেন, বিশ্বসাহিত্যেই এটি প্রায় তুলনাহীন বলে অভিহিত হতে পারে। এতে গল্পের মধ্যে গল্পের লহর চললেও আসলে দু'জোড়া কাহিনী প্রধান তথা বাইরের কাহিনীটি ‘পুণ্ডরীক মহাশ্বেতা’— প্রত্যেকটি কাহিনীতে তিন জন্মের কথা বলা হয়েছে। চন্দ্রাপীড়ের তিন জন্মে স্বয়ং চন্দ্রক, চন্দ্ৰাপীড় ও শূদ্রক; পুশুরীকেরও তিন জন্ম ও এবং তিন জন্মেই তাঁর প্রণয়নী মহাশ্বেতা। বেচারী পত্রলেখা স্বয়ং চন্দ্রপ্রিয়া রোহিণী হয়েও, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘উপেক্ষিতা' হয়ে রইলেন। তবু বাণের রচনা অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাই বলা হয় ‘বাগোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্'—জগতের সমস্ত কিছুকেই বাণ এঁটো করে দিয়েছেন, এমন কিছু নেই যা' তিনি স্পর্শ করেন নি। একজন কবি-বিষয়ে এর চেয়ে সপ্রশংস উক্তি আর কী হতে পারে।


চিত্রধর্মিতা ও অলঙ্কার-ব্যবহার নৈপুণ্য : 'কাদম্বরী' কাব্যে প্রধান সম্পদ–এর চিত্রাত্মক বর্ণনা, বর্ণনা শুধুই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়, এর বর্ণময়তাই প্রধান লক্ষণীয়। অথবা সাধারণ অর্থে বলা চলে–চিত্ররচনা এবং বর্ণনা উভয়ক্ষেত্রেই তিনিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রেখার টানেই হোক্ অথবা তুলিতে রং লাগিয়েই হোক্ বাণ যখন যেটি এঁকেছেন, সেদিক থেকে আর চোখ ফেরানো যায় না। চিত্রের প্রসঙ্গ বাদ দিলে আসে এর কাব্যত্বের কথা। কাব্য বিষয়ে কবির নিজস্ব ধ্যান-ধারণার কথা কাব্যের মধ্যেই মাঝে মাঝে বলে গেছেন, যেমন—“উৎকৃষ্ট কবির গদ্যে নানা বর্ণের মালায় ফুটে ওঠে নতুন শব্দের ঐশ্বর্য এবং সুকুমার কাব্যপ্রকৃতিকেও মানুষের ভিতরের ভাষাগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন ঢঙে দেখিয়ে দেয়'—'কাদম্বরী’তে এ সবই সুলভ। অলঙ্কারের ব্যবহারেও বাণ যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সন্তান তির্যক প্রাণীদের বিষয়েও তিনি ছিলেন সুপরিজ্ঞাত। আবার রঙ্গ রসিকতার দুর্বার লোভও সামলাতে পারেন নি বাণ, সুযোগ পেলেই যাকে খুশি ঠুকে দিয়েছেন। তবে তাঁর কাব্যের বড় দোষ ভাষার জটিলতা, যাকে কোনো কোনো সমালোচক ‘ভারতীয় অরণ্য' আখ্যা দিয়েছেন। তবে যদি সেই অরণ্যে একবার প্রবেশাধিকার লাভ করা যায়, তবে যে অপার্থিব সৌন্দর্যরাশি দ্বারা অভিভূত হতেই হবে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। অতএব, ‘কাদম্বরী’ গদ্যই হোক্‌ কিংবা 'কথা'ই হোক্, আসলে যে তা একটি রসোত্তীর্ণ কাব্য, এ কথা স্বীকার করতেই হবে।


(খ) হর্ষচরিত :

‘হর্ষচরিত' বাণভট্ট-রচিত 'আখ্যায়িকা কাব্য'। 'আখ্যায়িকা কাব্যে'র বিশেষ লক্ষণ এই যে, এটি গদ্যভাষায় রচিত এবং এর বিষয়বস্তু ইতিহাসাশ্রিত অথবা বাস্তব ঘটনাসম্বলিত। অবশ্য এতে কবি তাঁর আত্মজীবনী অথবা অপর কবিদের কাহিনীও বর্ণনা করতে পারেন। আখ্যায়িকা কাব্য কয়েকটি ‘আশ্বাস' কিংবা 'উচ্ছ্বাসে' বিভক্ত হয়। আলোচ্য ‘হর্ষচরিত' সদ্যঃ-কথিত 'আখ্যায়িকা কাব্যে'র সব ক'টি শর্তই পালন করেছে। এতে স্থানেশ্বরাধিপতি হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং প্রথম দু'তিনটি উচ্ছ্বাসে কবি বিস্তৃতভাবে আত্মকাহিনীও বর্ণনা করেছেন। পুষ্পভৃতি থেকে এই রাজবংশের কাহিনী শুরু, হর্ষবর্ধন কাহিনীর কতকাংশ বর্ণনার পরই গ্রন্থের আকস্মিক সমাপ্তি। এতে বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে হর্ষবর্ধনের পিতা প্রভাকরবর্ধন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্ধন, ভগিনী রাজ্যশ্রী এবং স্বয়ং হর্ষবর্ধনের কাহিনী—এঁদের সকলের জন্মকথা, রাজা প্রভাকরবর্ধনের রাজ্যশাসন ও পরলোকগমন তৎসহ মাতার সহমরণ, মৌখরী বংশের রাজপুত্র গ্রহবর্মার সঙ্গে ভগিনী রাজ্যশ্রীর বিবাহ, হুণদের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য। গ্রহবর্মা প্রতিদ্বন্দ্বী মালবরাজ কর্তৃক নিহত হন এবং রাজ্যশ্রী বন্দিনী হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন – এই সংবাদ পেয়ে রাজ্যবর্ধন মালব রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি গৌড়াধিপ শশাঙ্কের হস্তে নিহত হয়েছেন—এই নিদারুণ বার্তা পেয়ে স্বয়ং হর্ষবর্ধন যুদ্ধযাত্রা করেন। পথিমধ্যে আবার সংবাদ পেলেন যে রাজ্যশ্রী কারাগার থেকে পলায়ন করে বিন্ধ্যারণ্যের দিকে যাত্রা করেছেন। হয় তখন তাঁর যাত্রাপথ পরিবর্তন করে ভগিনী রাজ্যশ্রীর অনুসন্ধানে বিন্ধ্যপর্বতে প্রবেশ করেন। তথায় এক বৌদ্ধভিক্ষু প্রমুখাৎ তিনি জানতে পারলেন যে শোকে বিবশ হয়ে রাজ্যশ্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতে কৃতসঙ্কল্প হয়েছেন। এই দুঃসংবাদ শ্রবণে হর্ষবর্ধন ত্রস্তপদে অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলেন—রাজ্যশ্রী অগ্নিপ্রবেশে সমুদ্যত। হর্ষবর্ধন তাকে সেই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনলেন এবং ভ্রাতা-ভগিনীর মিলন হল। গ্রন্থটি আকস্মিকভাবে এখানেই সমাপ্ত হয়েছে।


কাব্যবিচার : ‘হর্ষচরিত’ সংস্কৃত সাহিত্যের একমাত্র 'আখ্যায়িকা কাব্য'। বস্তুত কাশ্মীরী কবি কল্‌হণ-রচিত ‘রাজতরঙ্গিণী’র পূর্বে ইতিহাস অবলম্বনে কাব্যরচনা প্রচেষ্টা শুরু করেন বাণভট্টই; শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর সমকালীন ইতিহাসকেই তাঁর আখ্যায়িকা কাব্যের বিষয়রূপে গ্রহণ করেছিলেন। তৎসত্ত্বেও স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বাণভট্ট কাব্য রচনা করেছেন, ইতিহাস নয়, কাজেই কিছু কিছু কাল্পনিক বিষয়ও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবু তিনি সমকালীন এবং পূর্বকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সমাজ-জীবন চিত্রণে যথেষ্ট বিশ্বস্ততারই পরিচয় দিয়েছেন। আবার ইতিহাসের কাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানব-মানবীর হৃদয়ের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনাকে, ধর্মীয় সংস্কার এবং বিশ্বাসকেও তিনি সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। আবার প্রকৃতিচিত্রণে তিনি যে প্রবাদপ্রতিম কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর ‘কাদম্বরী তে, তাঁর অনুরূপ চিত্র ‘হর্ষচরিতে'ও দুর্লভ নয়। এতে যেমন ভারতীয় গ্রাম-জীবনের অনবদ্য চিত্র ধরা পড়েছে, তেমনি প্রকৃতির ভীষণ ভয়াল রূপও সমান হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। রাজা প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর প্রাক্কালে প্রকৃতি যে রূপ ধারণ করেছিল, তার একটি নিদর্শন – “আকাশে আবির্ভূত হল ধূমকেতু, অগ্নিবর্ণ দীর্ঘ কুটিল পুচ্ছ তার। তারা ভয়ার্তা দিগ্‌ললনাদের প্রসারিত শিখিপুচ্ছসদৃশ বিকট বিভ্রস্ত কেশপাশ। আকাশের কোনো দিকে কিছু নেই, (এমন সময়) হঠাৎ দেখা দিল লৌহকপাটের মতো ভীষণ কালো মেঘ। তারাই যেন আকাশের লোকপাল, মহারাজের মৃত্যু-সম্ভাবনায় ভীত হয়ে অকস্মাৎ বদ্ধ করে দিল দিগ্‌দ্বার। বজ্রের কী হৃদয় বিদারী গর্জন, মনে হয় যেন প্রেতপতির যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠেছে প্রেতলোকের ঘোর দুন্দুভি। সূর্যকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে সহসা সূচিত হল পাংশু বৃষ্টি, উদ্ভলোমের মতো কপিলবর্ণ সেই বৃষ্টি দেখে মনে হয় আকাশ-পথে মহিষ-পৃষ্ঠে চলেছেন যমরাজ আর সেই মহিষের ক্ষুরের ধুলোয় ছেয়ে গেছে আকাশ।” বাণভট্টের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তাঁর ভাষা ব্যবহার নিয়ে। তাঁর সমাস-বহুল দুর্বোধ্য ভাষাকে কোনো এক বিখ্যাত য়ুরোপীয় সমালোচক ‘ভারতীয় অরণ্য' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর রচনায় সমাসবাহুল্য, অর্থকৃচ্ছতা এবং দুর্বোধ্যতার অভিযোগটি মিথ্যা নয়, তবে এর জন্য দায়িত্ব সবটুকু তাঁর নিজের নয়, যুগের রুচি ও সমকালীন সাহিত্যিক পরিমণ্ডলও তার জন্য অংশত দায়ী। তবে যদি এই দুর্বোধ্যতার খোলস ভেঙে বাণভট্টের বর্ণনা ও রসসৃষ্টিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করা যায়, তবে যে পাঠক কখনও নিজেকে বঞ্চিত বোধ করবেন না, তা নিঃসন্দেহেই বলা চলে। কারণ ‘হর্ষচরিত' আসলে ইতিহাসও নয়, কিংবা ব্যাকরণ নয়, এটি একটি পরম আস্বাদনীয় গদ্যকাব্য—কাব্যের যাবতীয় লক্ষণ এবং ধর্মই এতে বর্তমান রয়েছে।