'সাহিত্যের তাৎপর্য' প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।

বহির্জগতের রঙ, ধ্বনি, আকৃতি প্রভৃতি আমাদের জগতে ভালোলাগা, মন্দলাগা কিংবা সুখদুঃখ, ভয়, বিস্ময়াদির সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের হৃদয়বৃত্তির জারকরসে জারিত হয়ে এক নোতুন জগতের আভাস বহন করে আনছে। ভাবুকের মনের এই জগৎটি বাইরের জগতের চেয়ে মানুষের অনেক বেশি আপন। বাইরের জগতের বড়ো-ছোটো সাদা-কালোর সঙ্গে আমাদের মনের জগতের ভালোমন্দ, প্রিয়-অপ্রিয় সব সংবাদই পেয়ে যাই এই জগৎ থেকে। এক মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে অপর মানুষের হৃদয়ের যোগ সাধিত হচ্ছে, এই মানুষের জগতের সাহায্যেই। যুগে যুগে চিরপুরাতন এই প্রবাহ নিত্য নোতুন আকার ধারণ করছে। এই অপরূপ মানস-জগৎকে বারবার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে না পারলেই তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একে নষ্ট হতে দেওয়া চলে না—হৃদয়ের এই জগৎ প্রকাশ-ব্যাকুল বলেই চিরকাল মানুষ তাকে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে রূপায়িত করে তুলে চলছে।


সাহিত্যের বিচারকালে দেখতে হয়, বিশ্বজগতের উপর সাহিত্যের হৃদয়ের অধিকার রয়েছে কতখানি এবং তা কতখানি স্থায়ী আকারে ব্যক্ত হতে পেরেছে—এ দুটিতে সামস্য-বিধান কষ্টকর হলেও যদি তা হয়ে উঠতে পারে, তবে সোনায় সোহাগা। কবি-হৃদয়ের কল্পনা-সচেতনতা যত বেশি ব্যাপ্তি লাভ করে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তাঁর রচনার গভীরতাও ততই বৃদ্ধি লাভ করে এবং তাতে পাঠকেরও তৃপ্তির পরিমাণ হয় সমধিক। এইভাবেই মানব-বিশ্বের সীমা বিস্মৃতি লাভ করে যাচ্ছে আর তার সঙ্গে মানুষের হৃদয়েরও সাযুজ্য লাভ ঘটছে।


বিশ্বজগৎ কিংবা অন্তর্জগতের বিষয়বস্তু অবশ্যই মূল্যবান, কিন্তু যদি মূল্যের দিক থেকে এটি তুচ্ছও বিবেচিত হয়, তবু রচনাশক্তির গুণেই এটি মহামূল্য হয়ে উঠতে পারে। ভাষার মধ্যে, সাহিত্যের মধ্যে রচনাশক্তির নৈপুণ্য সঞ্চিত থাকে এবং এই শক্তিই মানুষের প্রকাশ-ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে যে মানস-জগৎ হৃদয়ভাবের উপকরণে অন্তরের মধ্যে সৃষ্ট হয়ে উঠছে, তাকে বাইরে প্রকাশ করাটাই বড় কথা—কিন্তু উপায় কী! তাকে এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে হৃদয়-ভাব উদ্রিক্ত হতে পারে এবং তার জন্য নানাপ্রকার সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন। পুরুষের অধিকাংশ পোষাক সোজাসুজি, সাদাসিধে এবং যথাযথ হলেও চলে, কিন্তু সমস্ত সভ্যদেশেই মেয়েদের পোষাকের সঙ্গে শালীনতা সৌন্দর্যবোধ এবং সুরুচির সম্পর্ক স্বীকৃত হয়। সাহিত্যেরও তেমনি প্রকাশের জন্য অলঙ্কার, ছন্দ, ব্যানা প্রভৃতির প্রয়োজন, দর্শন বিজ্ঞানের মতো তাকে নিরলঙ্কার হলে চলে না।


অরূপকে রূপের ভিতর দিয়ে নিয়ে আসতে হলে বচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে নিয়ে আসতে হয়—এই অনির্বচনীয়তা অনুকরণ নয়, তা অলঙ্কারকে অতিক্রম করে পরম আস্বাদ্যতা দান করে। এই ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠার জন্যই সাহিত্যে চিত্র ও সঙ্গীতের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। ভাষার দ্বারা যাকে প্রকাশ করা যায় না, তাকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই চিত্রের প্রয়োজন। উপমা-তুলনা-রূপক আদির সাহায্যে মনের ভাবকে চিত্রের মতো করে হাজার রকম করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। বৈয়ব কবি বলরাম দাসের ‘দেখিবারে আঁখি-পাখি ধায়'—এই কথাটির মধ্যে মনের অব্যক্ত ব্যাকুলতা ছবির মতো উঠে কি সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি লাভ করেনি!


চিত্রের মতোই সঙ্গীতও সাহিত্যের অপর একটি বিশিষ্ট সম্পদ। মনের যে ভাবকে সাধারণভাবে কথায় কোনক্রমে প্রকাশ করা চলে না, সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই তা পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত হয়ে উঠতে পারে। অতি যৎসামান্য কথাও সঙ্গীতের সাহায্যে অসামান্যতা লাভ করতে পারে। কারণ সঙ্গীতই কথার মধ্যে বেদনার বা অনুভূতির বোধ সঞ্চার করে দেয়। এই কারণে চিত্র এবং সঙ্গীতকেই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ বলে বিবেচনা করা হয়। চিত্রের কাজ—ভাবকে আকার দান আর সঙ্গীতের কাজ—ভাবকে গতি দান। অতএব সাহিত্যের ক্ষেত্রে চিত্রকে যদি বলা হয় রূপময় দেহ, তবে সঙ্গীতকে বলা চলে গতিময় প্রাণ।


মানুষের হৃদয়বৃত্তির প্রকাশকেই সাহিত্যের একমাত্র কাজ বলে মনে করলে ভুল করা হবে। মানব-চরিত্রও তেমনি এক সৃষ্টি, যাকে অপরাপর জড় সৃষ্টির তুল্য বলে মনে করা চলে না অথবা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তাকে আয়ত্ত করা চলে না। মানব-চরিত্র আমাদের ইচ্ছামতো পরিচালিত হয় না, কিংবা যথেচ্ছভাবে ব্যবহারও করতে পারিনে। আমাদের ধরাবাধার অতীত এই বিচিত্র মানব চরিত্রকেও অন্তরলোক থেকে বহির্জগতে প্রতিষ্ঠিত করবার কাজটাও সাহিত্যেরই। এই কাজ অত্যন্ত দুরূহ; কারণ, মানব চরিত্র অতিশয় জটিল, তার লীলা অতিশয় সূক্ষ্ম। পরিপূর্ণ আকার মানবচরিত্রকে হৃদয়ঙ্গম করা সাধারণ মানুষের কাজ নয়—ব্যাস বাল্মীকি কালিদাসের মতো মহান কবিদের পক্ষেই এ কাজ এক সময় সম্ভব হয়েছিল।


অতএব সব মিলিয়ে বলা চলে মানব-হৃদয় এবং মানব-চরিত্রই সাহিত্যের বিষয়রূপে বিবেচ্য। অবশ্য মানব-চরিত্র কথাটা বলাই যথেষ্ট নয়—মানুষের মনে মানব-চরিত্র এবং বহিঃ-প্রকৃতি মুহূর্মুহু যে রূপ থেকে রূপান্তর সৃষ্টি করে চলছে এবং প্রতিনিয়ত যে সঙ্গীত ধ্বনিত করে তুলছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্র এবং সঙ্গীতকেই বলা হয় সাহিত্য। ভগবানের আনন্দ যেমন সৃষ্টির মধ্যে আপনাকে ব্যক্ত করছে, মানুষের হৃদয়ও তেমনি সাহিত্যে আপনাকে ব্যক্ত করছে। স্ব-উৎসারিত ভগবানের আনন্দসৃষ্টির প্রতিধ্বনিই মানব-হৃদয়ে প্রতিফলিত। ভগবানের সৃষ্টির প্রতিঘাতে মানুষের অন্তরে যে সৃষ্টির আলো দেখা যায়, সাহিত্যে তারই বিকাশ ঘটে। তাই বিশ্বের নিশ্বাস আমাদের সাহিত্যেও রাগিণীর সৃষ্টি করে। এই কারণেই সাহিত্য কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, এমন কি তারও নয়, এ এক দৈববাণী।