"দরদী লোকের সুকাব্যজনিত চিত্তের অনুভূতি-বিশেষের নামই ‘রস'। সুতরাং বলা যেতে পারে কাব্যরসের আধার কাব্যও নয়, কবিও নয়—সহৃদয় কাব্য পাঠকের মন।"

আদিকবি বাল্মীকি কৌস্টীর শোকে কাতর হয়ে অকস্মাৎ 'মা নিষাদ' বলে ছন্দ-তন্ত্রী-লয়যুক্ত যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন, তারপরই তাঁর মনে প্রশ্ন উদ্‌গত হয়েছিল—'কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া'? বস্তুত কাব্য-সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই কাব্যের স্বরূপ জিজ্ঞাসারও যে সৃষ্টি হয়েছিল, এখানে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে অর্থাৎ কাব্য-তত্ত্ব-বিষয়ে এর পর থেকে কাবারসিক ও তত্ত্বজ্ঞের মনে নানা প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে এবং প্রত্যেকেই তাঁদের সাধ্যমতো তার বিশ্লেষণও করেছেন। এইভাবেই প্রাচীন ভারতে গড়ে উঠেছিল বিপুল অলঙ্কারশাস্ত্র। অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রবক্তাগণ নানাভাবে কার্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে বিভিন্ন মতবাদে উপনীত হয়েছেন। তাঁদের কেউ কাব্যদেহ তথা শব্দ ও অর্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করে ‘অলঙ্কার প্রস্থানে'র ('শব্দার্থে সাহিতৌ কাব্যম্', 'কাবাং গ্রাহামলঙ্কারাৎ ) প্রবর্তন করেছেন, বা ‘রীতিবাদে'র ('রীতিরাত্মা কাব্যস্য') কথা বলেছেন, কেউ বা বাচ্যার্থ-অতিক্রমী অপর কোনো বস্তুর উপর গুরুত্ব আরোপ করে ‘বক্রোক্তিবাদ' ('বক্রোক্তিকাব্যজীবিতম্') বা ‘ধ্বনিবাদ'-এর ('ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য') মতবাদ উপস্থাপিত করেছেন। তবে আদি আলঙ্কারিক আচার্য ভরত প্রথমেই কাব্যমূল-রূপে ‘রসে'র কথা উত্থাপন করেছিলেন ('তথা মূলং রসাঃ সর্বে তেভ্যো ভাবাঃ ব্যবস্থিতাঃ)। ধ্বনিবাদিগণও 'ধ্বনি' দিয়ে সূত্রপাত করলেও শেষ পর্যন্ত 'রসধ্বনি' তথা রসকেই কাব্যের আত্মারূপে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁরাও বলেন যে রস ছাড়া কাব্যই হয় না ('নহি তাচ্ছুন্যং কাব্যং কিদিস্তি')। এ বিষয়ে চরম কথা বলেছেন রসবাদী আচার্য বিশ্বনাথ—‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্'-রসাত্মক বাক্যই কাব্য। বস্তুতঃ পরবর্তীকালেও প্রধানতঃ কাব্য-বিচারে রসের মানদণ্ডই বহাল রয়েছে। অতএব, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এখন প্রশ্ন জাগে-'রস' কী।


কাব্যের তত্ত্ব আলোচনায় কিংবা রস-বিচারে কখনো রসের সন্ধান পাওয়া যায় না। কয়েকটি দীর্ঘ শুষ্ক অস্থিখণ্ডসমন্বিত কঙ্কাল দেখে যেমন কখনো কল্পনা করা যায় না যে, এতে ছিলো ছাব্বিশ বছরের যৌবন এত লালিত্য, এত লাবণ্য, এমন কঠিন কোমল নিটোল পরিপূর্ণতা নিয়ে, তেমনি কাব্যতত্ত্বের বিচার সেই কঙ্কাল থেকেই মানুষটির স্বরূপ উপলব্ধি করা। বুদ্ধিজীবী মানুষ ভাবের বিষয়কেও বুদ্ধি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ না করলে তৃপ্তি পায় না বলেই কাব্যের রসবিচার করতে গিয়ে অলঙ্কারশাস্ত্র গড়ে তুলেছে। অথচ এভাবে কাব্যের রসবিচার থেকেও কিন্তু কাব্যরসের স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ রস এমন বস্তু যার আস্বাদ একমাত্র দরদী লোকের মন। দিয়ে অনুভাবের মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে। আলঙ্কারিকদের মতে রস হচ্ছে 'সকল সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী অর্থাৎ কাব্যরসাস্বাদী সহৃদয় ব্যক্তির হৃদয়েই শুধু রসের অবস্থান সম্ভবপর। উক্তিটি একটু বিশ্লেষ-সাপেক্ষ।


আচার্য অভিনব গুপ্ত তাঁর 'লোচন' টীকায় ‘রসে'র স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে বলেছেন,

‘শব্দসমর্প্যমাণহৃদয়সংবাদরসুন্দরবিভানভাবসমুদিত-প্রানিবিষ্টরত্যদিবাসনা-রাগসু-কুমার-স্বসংবিদানন্দচর্বণ ব্যাপার-রসনীয়-রূপো রস।'


অর্থাৎ 'শব্দে সমর্পিত হলে এবং হৃদয়ের সংবাদ অর্থাৎ একরূপতা দ্বারা সুন্দর হলে সামাজিকের চিত্তে বিভাব ও অনুভাব থেকে পূর্বে নির্দিষ্ট রতি প্রভৃতি বাসনা সমুদিত হয়। এই বাসনার অনুরাগ দ্বারা সুকুমার হলে স্ব-সংবিদানন্দের (চেতনার) চর্বণ-ব্যাপারের যে রসনীয় বা আস্বাদনীয় রূপ, তাই হচ্ছে ‘রস'। এই মূল কথাটি হচ্ছে—রস নিজের আনন্দময় সম্বিতের তথা চেতনার আস্বাদ-স্বরূপ। কিন্তু এই আস্বাদন ব্যাপারটি বাস্তব জগতের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো রসের স্বাদ নয়। সাহিত্যের যে রস, তার স্বাদ গ্রহণ করতে হয় অন্তরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে-সহৃদয় সামাজিকের চিত্তই সাহিত্যরসের আস্বাদক। স্থূল বাস্তবজগতের কোনো দৃষ্টান্তই এখানে প্রযোজ্য নয়, কারণ রসকে বলা হয় 'ব্রহ্মস্বাদসহোদরঃ'— তৎসত্ত্বেও নিম্নোক্ত তুলনাটি অপ্রাসঙ্গিক না-ও হতে পারে। ছানা ও চিনি-সহযোগে কড়াপাক সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, রসগোল্লা, প্রাণহরা বা আরও বহুবিধ মিষ্টদ্রব্য তৈরি হয়, তাদের প্রত্যেকটিরই পৃথক পৃথক্ স্বাদ। এ জাতীয় যাবতীয় মিষ্টান্নের উপাদান ছানা ও চিনি, এর প্রস্তুতকারক যে মোদক সে প্রতিটি মিষ্টির প্রস্তুত-বিষয়ে কুশলী, কিন্তু তার কোন্‌টির কী 'স্বাদ' তা বলতে পারে একমাত্র ভোক্তা, অপর কেউ নয়। শব্দ ও অর্থে নির্মিত কাব্যদেহ, তার নির্মাতা কাব্যকুশল কবি, কিন্তু এর রসপ্রমাতা শুধুই সহৃদয় পাঠক, অপর কেউ নয়।


অনুরূপ বিষয়ে আরিস্তোতল-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুচারও বলেছেন, “The pleasure of art are not for the artist but for those who enjoy what he creates." আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রেও বলা হয়েছে—'কাব্যের রসয়িতা সর্বো না যোদ্ধা ন নিয়োগ ভাবনূ।'


এখানে আর একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রশ্ন হতে পারে যে কোনো কাব্য-পাঠকই কি কাব্যরসের আস্বাদন লাভ করতে পারেন? না—উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কাব্য সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী—সহৃদয় ব্যক্তিই শুধু কাব্যরসপানে ধন্য হতে পারেন। সহৃদয় কে? তার উত্তরে আচার্য অভিনব গুপ্ত জানিয়েছেন, ‘যোং কাব্যানুশীলনাভ্যাসবশানবিশদীভূতে মনোমুকুরে বর্ণনীয়তন্ময়ী-ভবনযোগ্যতা তে হৃদয়সংবাদভাকঃ সহৃদয়াঃ।


অর্থাৎ কাব্যানুশীলনের অভ্যাসবশে যাদের মনোমুকুরে কাব্যের বর্ণনীয় বস্তু তন্ময়তা প্রাপ্ত হয়, তারাই হৃদয়-সংবাদভাক্ সহৃদয়। কাব্য-বিষয়ের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতে পারেন এমন যে সহৃদয় ব্যক্তি, তার সুকাব্যজনিত চিত্তের অনুভূতিবিশেষের নাম 'রস'। অতএব রসের অবস্থান কাব্যরসাস্বাদী সহৃদয় সামাজিকের চিত্তে, তার বাইরে রসের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। কাজেই যখন বলা হয়—'কাব্যরসের আধার কাব্যও নয়, কবিও নয়, সহৃদয় কাবা পাঠকের মন' তখন এর যাথার্থ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।