স্কটের জীবন ও সাহিত্যকৃতির পরিচয় দাও | ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতা হিসাবে স্কটের কৃতিত্ব কতদূর তা বুঝিয়ে দাও।

ঐতিহাসিক উপন্যাসের রচয়িতা স্কটের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো। বাংলা উপন্যাস ক্ষেত্রে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কি?


রোমান্টিক যুগের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসাবে স্কটের সাহিত্যিক কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো। বাংলা উপন্যাসে তাঁর কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কিনা বুঝিয়ে দাও।


অষ্টাদশ শতক যুক্তিবাদ ও বুদ্ধিবাদের যুগ, প্রধানত গদ্যের যুগ। বাস্তবানুগ ও জীবনমুখী যথার্থ উপন্যাসের সূচনাও হল এই যুগেই। ডিফোর (Daniel Defoe) 'রবিনসন ক্রুসো'-কে (১৭১৯ খ্রিঃ) এক্ষেত্রে প্রথম উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া হয়। তারপর রিচার্ডসন (Samuel Richardson), ফীল্ডিং (Henry Fielding). স্মলেট (Tobias Smollett) এবং স্টার্ন (Lawrence Sterne)-এর বিভিন্ন দিকের বিকাশ সাধন করেছেন


অবশ্য এই আঠারো শতকের শেষদিকে কাব্যের মতোই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও কয়েকজন ঔপন্যাসিকের রচনায় রোমান্টিক কল্পনার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এদের মধ্যে হোরেস ওয়ালপোল (Horace Walpole),‌ মিস্ ক্লারা রীভ (Miss Clara Reeve), মিসেস্ অ্যান্ র‍্যাডক্লিফ্ (Mrs Ann Radcliffe) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁদেরই প্রচেষ্টা যেন সার্থক রূপ নিয়েছিল উনিশ শতকে স্কটের অতীতচারী রহস্য-রোমাণ্টিকময় উপন্যাসে।


স্যার ওয়াল্টার স্কট (Sir Walter Scott) ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে এডিনবরায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ঘটনাবহুল উপন্যাসের মতোই স্কটের নিজের জীবনও কম ঘটনাবহুল নয়। স্কুল ও কলেজে ছাত্রজীবন শেষ করে ব্যারিস্টার বাবার নির্দেশে ওকালতি শুরু করলেন। পসার জমল না। কোর্টেই একটি চাকরি নিলেন বেশ উঁচু পদেই। কিন্তু মন দিয়ে তাই করতে পারলেন কই? মন তো পড়ে আছে সাহিত্যচর্চায়, সাহিত্য রচনায়। ছোটোকালেই কল্প কাহিনী, গল্প কথা তাঁকে টানত। ঠাকুরমার কাছে শুনতেন পুরানো দিনের গল্প, অতীত বীরত্বের কাহিনী আর কল্পনার জাল বুনে চলতেন। স্কটল্যান্ডের এই অতীত যুগ, অতীত জীবন এবং অতীত গৌরবগাথাকে পশরা করেই গড়ে উঠল তাঁর সাহিত্যসম্ভার। তাঁর সাহিত্যের অঙ্গনে লক্ষ্মী ও সরস্বতী উভয়েরই আবির্ভাব হয়েছিল। খ্যাতি তিনি পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন বিপুল অর্থও। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিবাহ হয়। এই বছরেই হন শেলকাকশায়ারের সহকারী শেরিফ। সাহিত্যের দাক্ষিণ্যে অ্যাবটফোর্ডে বিরাট জমিদারী ও বিশাল বাড়ি করে স্কট প্রাচীন জমিদারদের মতোই বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে জীবন কাটাতে শুরু করলেন। অবশ্য এর কয়েক বছর আগে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে জনৈক বন্ধুর সঙ্গে ছাপাখানা ও পুস্তক প্রকাশনাও আরম্ভ করেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত 'পোয়েট লরিয়েট’-এর প্রস্তাব তিনি কবি সাদের (Southey) অনুকূলে প্রত্যাখ্যান করেন। গ্রন্থ রচনা ও ব্যবসা প্রভৃতি থেকে তিনি প্রচুর অর্থের মালিক হলেও তাঁর বেহিসেবী খরচার জন্য ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বন্ধুর সঙ্গে অংশীদারী হিসেবে করা তাঁর প্রকাশনা ব্যবসাও ঠিকমতো দেখাশুনোর অভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ল। এর ফলে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে দেখা গেল তিনি সাংঘাতিকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঋণের ব্যাপারে হয়তো একটা মিটমাট করে ফেলা যেত। কিন্তু পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত অসাধারণ আত্মসম্মানবোধ সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। তাঁর নিজের লেখার ছিল প্রচণ্ড কাটতি। আপন লেখাকে সম্বল করে দিনরাত তিনি লিখে চললেন। এইভাবে দেনার যখন প্রায় তিনভাগ সত্তর হাজার পাউন্ড শোধ করে আনলেন, তিনি হয়ে পড়লেন অসুস্থ। ছোটোবেলা থেকেই একটু খুঁড়িয়ে চলতেন, এবার হল পক্ষাঘাত। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি মুখে মুখে কাহিনী বলেছেন, তাঁর হয়ে লিখেছেন তাঁর করণিকরা। বিপুল ঐশ্বর্য থেকে শেষজীবনে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লেও তাঁর আত্মসম্মানবোধই তাঁর মাথা উঁচু করে রেখেছিল। সেই সঙ্গে ছিল তার আদর্শবোধ, সংযম ও সাহিত্যপ্রীতি। শেষ জীবনে ডায়েরীর পাতায় তিনি লিখে গেছেন, 'God knows I am at sea in the dark and the vessel leaky."। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে টুইড নদীর ধারে তাঁর নিজের বাড়িতেই এই ঘটনাবহুল জীবনের পরিসমাপ্তি হয়।


কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ থেকে এক বছরের ছোটো স্কট যখন লেখনী ধারণ করেন তখন ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগ। রোমান্টিক যুগ প্রধান গীতিকবিতার যুগ। স্কটও তাঁর সাহিত্যের আসরে প্রথম আসেন কবি স্কট হিসেবেই (বঙ্কিমচন্দ্রেরও সাহিত্য জীবন কবিতা লিখেই শুরু হয়)। তিনি রোমান্টিক যুগের প্রথম সারির কবি নন, কিন্তু সেই যুগে কবি হিসেবে তাঁর একটা স্বতন্ত্র ভূমিকা ছিল। জার্মান কবিতার অনুবাদ দিয়ে কবি জীবন শুরু হয়েছিল, এর পরেই স্বদেশ স্কটল্যান্ড হল তার কবিতার বিষয়, জনপ্রিয়তায় একমাত্র কবি বায়রন ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর কবিতার মধ্যে মধ্যযুগীয় হাওয়া, বীরত্বগাথা এবং সেই সঙ্গে কল্পনাবিলাস সার্থকভাবেই এসে হাজির হয়েছে। ১৮০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর তিন খণ্ডে 'মিনসট্রেলসি অব দি স্কটিশ বর্ডার' (Minstrelsy of the Scottish Border)। এর পরেই প্রকাশিত 'দ্য লে অব দ্য লাস্ট মিন্‌সট্রেল' (The Lay of the Last Minstrel) কাব্যটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। আর দুটি জনপ্রিয় কাব্য 'মারমিয়ন' (Marmion), 'দ্য লেডি অব দ্য লেক’ (The Lady of the Lake)। তাঁর কবিতার গীতিময়তা ও ব্যালাডধর্মী আবহ আজও ইংরেজি কবিতার স্মরণীয় ঐশ্বর্য।


এর পাশাপাশি খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও নাট্যকার স্কট বা স্কটের রচিত নাটকের কথা স্মরণ করা যায়। এই রোমান্টিক যুগে গীতি-কবি শেলি, কীটস প্রমুখ কবিগণও নাটক লিখেছিলেন। শেলির 'প্রমিথিয়ুস আনবাউণ্ড’, ‘চেখি’; কীটসের 'ওথো দ্য গ্রেট’, ‘কিং স্টীফেন' তাঁদের নাট্যচর্চারই উদাহরণ। স্কটও লিখেছিলেন 'হ্যালিংডন হিল' (Halindon 1822), 'ম্যাকডাক্স ব্রুস' (Macduff's Cross, 1822) দ্য ডুম অব ডেফরগোল' (The Doom of Devorgoil, 1830)। শেষেরটিই সবচেয়ে ভাল।


স্কট কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন নাটক, প্রবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু স্কটের বিশ্বখ্যাতি তাঁর উপন্যাসের জন্য। রোমান্টিক যুগের উপন্যাসের প্রধান দুটি নাম জেন অস্টেন এবং ওয়াল্টার স্কট। জেন অস্টেনের উপন্যাসে রয়েছে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত জীবনের ঘরোয়া পরিবেশ, আর স্কটের উপন্যাসে রয়েছে মধ্যযুগের বীরত্ব, উদ্দীপনা, যুদ্ধ বিগ্রহ, দুঃসাহসী প্রেম। রয়েছে দুর্গ, প্রাসাদ, পরিখা, রণক্ষেত্র। রয়েছে রোমান্টিক কল্পনার উজ্জ্বল বর্ণবিলাস, ইতিহাসের ঘেরাটোপে মধ্যযুগের শৌর্যবীর্যময় জীবনের উল্লাস। তাঁর কাব্য, নাটক, উপন্যাসের মধ্যে আমরা একই মানসিকতার পরিচয় পাই। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কবিতার জগৎ থেকে নেমে আসেন উপন্যাসের জগতে।


ঔপন্যাসিক হিসেবে স্কটের আত্মপ্রকাশ ঘটল ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে 'ওয়েভারলি' (Waverley) উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে। তিনি প্রায় তিরিশটি উপন্যাস লিখেছিলেন। তাঁর শেষ উপন্যাস 'ক্যাসল ডেন্জারাস' (Castle Dangerous), রচনাকাল ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর সব উপন্যাস অবশ্য সমান উল্লেখ্য নয়। স্কট তাঁর প্রথম প্রকাশিত 'দ্য ওয়েভারলি' (The Waverley) উপন্যাসে অসাধারণ খ্যাতিলাভ করেন। জানা যায়, আট-ন' বছর আগে লেখা একটি পাণ্ডুলিপির অংশ তিনি হঠাৎ পুরানো আলমারির মধ্যে পেয়ে যান এবং নিজের পুরানো লেখাতে নিজেই বিস্ময় বোধ করেন। এই লেখাটিকেই তিনি নতুন করে মেজে ঘসে সমাপ্ত করেন। এটিই বিখ্যাত 'দ্য ওয়েভারলি'। তারপর তার লেখা চলল এগিয়ে। পাঁচ বছরের মধ্যে পর পর কয়েকখানি উপন্যাস তিনি লিখে ফেললেন, এবং সবগুলিই পাঠক সমাজে সাদরে গৃহীত হয়েছিল। উপন্যাসগুলি হচ্ছে ‘গাই ম্যানারিং' (Gay Mannering), 'দ্য আন্টিকোয়েরি' (The Antiquary), 'ওল্ড মর্টালিটি' (Old Mortality), 'রব রয়' (Rob Roy). 'দ্য হার্ট অব মিডলোথিয়ান্' (The Heart of Middlothian), 'দ্য ব্রাইড অব লামারমুর' (The Bride of Lammermoor), 'এ লিজেন্ট অব মন্‌ট্রোজ' (A Legend of Montrose)। স্কটল্যান্ড হচ্ছে এই উপন্যাসগুলির বিষয়বস্তু। এর পরের উল্লেখ্য উপন্যাস 'আইভানহো' (Ivanhoe) এবং দ্য অ্যাবোট' (The Abbot)-এর পটভূমিকা হচ্ছে ইংল্যান্ড। এক সময়ে 'আইভান-হো'-র সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের 'দুর্গেশনন্দিনী’র তুলনা করা হত। উভয়ের মধ্যে বহির্ঘটনার সাদৃশ্য আছে। এর পর তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসটির নাম ‘কেনিলওয়ার্থ’ (Kenilworth)। সমস্ত ইউরোপের মানুষের কাছেই গ্রন্থকারকে সুপরিচিত করে তোলে। রানী এলিজাবেথের রাজত্বকালে এক ভালোবাসা ও ষড়যন্ত্রের কাহিনী নিয়ে ট্রাজিক পরিণতিময় নাটক হল ‘কেনিলওয়ার্থ'। এর পর 'দ্য ফরচুনস অব নাইজেল' (The Fortunes of Nigel) এবং 'দ্য বিট্রোড' (The Betrothed) নামে দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা স্কটের আর একটি উল্লেখ্য উপন্যাস 'দ্য ট্যালিম্যান' (The Talisman)। এই উপন্যাসের ঘটনাকাল ধর্মযুদ্ধের যুগ, রিচার্ডের রাজত্বকাল।


এই সময়েই স্কটের জীবনে নেমে এল আর্থিক বিপর্যয়। একাধিক কারণে তিনি অত্যধিক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। এর পরের উপন্যাসগুলি তিনি রচনা করেছেন তাঁর আনন্দের দায় থেকে নয়, বিপুল ঋণের দায় মেটানোর জন্য। এই উপন্যাসগুলি হচ্ছে উডস্টক' (Woodstock). 'দ্য ফেয়ার মেড অব পার্থ' (The Fair Maid of Perth), 'অ্যান অব গীয়ারষ্টাইন্‌' (Anne of Geirstein), 'কাউন্ট রবার্ট অব্ প্যারিস' (Count Robert of Paris), 'ক্যাসল ডেন্জারাস্' (Castle Dangerous) ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে লেখা শেষ দুটি উপন্যাস স্কটের জীবনের শেষ বৎসরের শেষ ফসল। আর্থিক অসচ্ছলতা ও শারীরিক নিদারুণ অসুস্থতার মধ্যে তাঁর করণিকদের লেখা ও স্কটের মুখে মুখে বলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে রচিত ঔপন্যাসিকের শেষ পর্বে রচিত উপন্যাসগুলি সাধারণভাবে এবং এই শেষ উপন্যাস দুটি বিশেষভাবে লেখকের মানসিক ধৈর্য ও শিল্পরচনার একাগ্রতার যে পরিচয় দেয়, তা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরাট ঘটনা।


স্কটের অধিকাংশ উপন্যাসই স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের অতীত ইতিহাস অবলম্বন করে লেখা। স্কটের প্রথম উপন্যাস 'দ্য ওয়েভারলি' এবং তারপর মাত্র চার পাঁচ বছরের মধ্যে লেখা নয়টি ঐতিহাসিক উপন্যাসের পটভূমিই স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডের রুক্ষ বন্ধুর পাহাড় পর্বতে যে দুঃসাহসিক জীবনের অভিযান, তার প্রাচীন দুর্গে প্রাসাদে যে বীর্য ও ঐশ্বর্যের স্মৃতি তাকে ভাষা দিয়েছিলেন স্কট। তাঁর প্রায় অসুস্থ অবস্থায় রচিত 'আইভানহো', 'দ্য অ্যাবোট’ এবং ‘কেনিলওয়ার্থ" উপন্যাস তিনটির পটভূমি ইংল্যান্ড। ফ্রান্সও এসে হাজির হয়েছে। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিতে দেশের প্রাচীন ইতিহাস গৌরবময় অতীত নিয়ে পাঠকের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে প্রাচীন কাহিনী বীরত্বগাথা প্রভৃতি যুক্ত হয়ে কাহিনী হয়েছে আরও আকর্ষণীয়। প্রাচীন কাহিনী ও মধ্যযুগের জীবনের প্রতি তাঁর ছিল দুর্নিবার আগ্রহ। প্রধান চরিত্রাবলীও ছিল প্রায়শ রাজা, রাজপুরুষ বা সামন্তশ্রেণির অভিজাত মানুষ। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণির নরনারীর চিত্রও তিনি সযত্নে এঁকেছেন। নিখুঁত গল্প সাজানোর কৌশল, নিটোল চরিত্র, আঁটসাঁট বাঁধুনি এবং সূক্ষ্ম মানসিক বিশ্লেষণ না থাকলেও প্রতিটি নরনারীর মনের ঘাত প্রতিঘাত সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর এইজন্যই ঘটনাপ্রধান ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং সশ্রদ্ধায় স্মরণীয়। স্কটের পরে লোকপ্রিয় ধারাটি আরও অনেকে অনুসরণ করেছিলেন।


বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে স্কটের প্রভাব:

বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ওপর স্কটের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাঁকে একসময় বাংলার স্কট' বলা হত। ঔপন্যাসিক স্কটের মতোই তিনি প্রথম জীবনে কবি। 'ললিতা ও মানস' তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। স্কটের প্রভাব প্রসঙ্গে তাঁর যে কটি গ্রন্থের নাম করা হয়, তার মধ্যে 'আইভানহো' অন্যতম। একসময় 'দুর্গেশনন্দিনী কৈ স্পষ্ট 'আইভানহো'র প্রভাবজাত বলে মনে করা হত। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, 'দুর্গেশনন্দিনী' লেখবার আগে তিনি 'আইভানহো' পড়েননি। সুতরাং এ সাদৃশ্য সম্ভবত আকস্মিক এবং এই সাদৃশ্য বহিরঙ্গ। তবু এই দুটি রচনায় রোমান্টিক পরিমণ্ডল এবং ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণে, প্রেম সম্পর্কে ধারণায় ও বিশিষ্ট রচনারীতিতে যথেষ্ট মিল লক্ষণীয়। প্রথমত, স্কটের মতোই বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক উপন্যাসরীতিতে তাঁর লেখার প্রথম পর্বে প্রধান ঐতিহাসিক চরিত্র ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠতা থেকে কল্পিত নায়ক-নায়িকারূপে মর্যাদা পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্কটের উপন্যাস অ্যাংলো (Anglo) ও স্যাক্সন (Saxon) বংশের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের কথা আছে 'দুর্গেশনন্দিনী' প্রভৃতি উপন্যাসে মোগল ও পাঠানের দ্বন্দ্ব সেই সঙ্গে তুলনীয়। তৃতীয়ত, স্কটের উপন্যাসের মতো বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিও গল্পবৃত্ত রচনায় সচেতন এবং সেই সঙ্গে ঘটনা ও দ্বন্দ্বে গভীর সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা হয়েছে। 'আইভানহো' ও 'দুর্গেশনন্দিনী' প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বলা যায় উভয় রচনা মিলনান্তক, প্রেম সম্পর্কে রেবেকা আয়েষার মধ্যে মিল আছে, জুলিয়া ও তিলোত্তমা অনেকটাই সমধর্মী। বীরযুগের প্রতিনিধি নায়ক আইভানহো এবং অন্যদিকে উদার, কর্তব্যপরায়ণ এবং সৎ জগৎসিংহ তুলনীয়। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস-আশ্রিত রচনায় ইতিহাস ও রোমান্সের শুভসংযোগ, বর্ণনা ও ঘটনাসংস্থাপনে ঔজ্জ্বল্য ও নাট্যধর্মের যে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তার সঙ্গেও স্কট তুলনীয়। স্কটের উপন্যাসে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ নয়, হিউমারের যে সজল হাস্যরস দেখা যায়, বঙ্কিমের উপন্যাসেও তা অলভ্য নয়। এই প্রসঙ্গে বিদ্যাদিগজের কথা আমাদের সহজেই মনে পড়বে।


তবু স্কটের প্রভাবকে স্বীকার করেও বঙ্কিমের মৌলিক প্রতিভাশক্তি যে স্কট অপেক্ষা বেশি ছিল, এ সত্য বলার প্রয়োজন আছে। 'দুর্গেশনন্দিনী' থেকে 'সীতারাম’ পর্যন্ত উপন্যাসসমূহে জীবনদৃষ্টির যে লোকোত্তর স্বাক্ষর এবং মানব-জীবনের যে সামগ্রিক পরিচয় বঙ্কিমের রচনায় ফুটে উঠেছে স্কটের উপন্যাসে তা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র টমাস হার্ডির সমগোত্রীয়, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে তাঁর বর্ণনায়, দক্ষতায় এবং প্রকৃতিচিত্রনে ঔপন্যাসিকের অন্তরে কবি বঙ্কিমচন্দ্র জেগে উঠেছেন। অপরদিকে তাঁর প্রতিভা 'দুর্গেশনন্দিনী' ও ‘মৃণালিনী'কে বাদ দিলে নবকুমার কপালকুণ্ডলা, চন্দ্রশেখর-শৈবলিনী প্রতাপ, শ্রী-সীতারাম, জেবুন্নিসা মোবারক প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে যে ট্র্যাজিক সমুন্নতি সৃষ্টি করেছে, স্কটের উপন্যাসে তা’ নেই। তাই নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বাংলায় স্কট' বলায় বঙ্কিম প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন হয় না। স্কটের মূল্যই বৃদ্ধি পায়।


পরবর্তীকালে রমেশচন্দ্র দত্তের 'বঙ্গবিজেতা’ ও ‘মাধবীকঙ্কণ’-এ অবশ্য স্কটের প্রভাবের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের রীতিও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে “রাজপুত জীবনসন্ধ্যা” ও “মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত'-এ রমেশচন্দ্র নিজের রীতি খুঁজে পেয়েছেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘দীপনির্বাণ', ইমামবাড়া’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে', রবীন্দ্রনাথের 'রাজর্ষি', 'বৌ-ঠাকুরাণীর হাট' প্রতি গ্রন্থনায় ঐতিহাসিক তথ্য সংযোগের ক্ষেত্রেই স্কটকে স্মরণ করা যায়, কিন্তু কোনোক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ প্রভাব অনুভব করা যায় না। বর্তমান ঔপন্যাসিকদের মধে দুঃসাহসিক ও উত্তেজনাপূর্ণ অ্যাডভোর ধর্মের সরলরেখা প্রকাশ তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। উপরন্তু বর্তমান উপন্যাস যেহেতু প্লট বা কাহিনীবৃত্তের বন্ধনমুক্তির সাধনায় নিযুক্ত, সেই কারণে বর্তমান কালে আবার নতুন করে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা শুরু হলেও স্কট বা বঙ্কিমের মতো জমকালো কাহিনীবৃত্ত রচনার প্রতি আধুনিক ঔপন্যাসিকদের আকর্ষণ কম।


বাংলা সাহিত্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থেও স্কটের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্কটের কাব্য রঙ্গ লালের বীরগাথা রচনায় প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি রাজপুত ইতিহাস ও ওড়িশার ধর্মমূলক কিংবদন্তী থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। তাঁর 'কর্মদেবী’তে নারীকে কেন্দ্র করে যে মধ্যযুগীয় দ্বন্দ্বযুদ্ধের কথা বলেছেন, সেখানে স্কটের 'দ্য লে অব দ্য লাস্ট মিসট্রেল' কাব্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়।