মিল্টনের সনেট জাতীয় কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করো।

মিল্টন মুখ্যত মহাকবি এবং ‘প্যারাডাইস লস্ট' প্রভৃতি মহাকাব্যের রচয়িতা হিসেবেই আমাদের কাছে পরিচিত। কিন্তু তিনি তাঁর মহাকাব্যের সাধনার সঙ্গে সঙ্গে যেমন নাটক রচনা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, তেমনি কবিতা রচনাতেও তিনি কম উল্লেখ্য নন।


ছাত্রাবস্থাতেই একটি ছোট্ট শিশুর মৃত্যুতে তিনি 'ইনফ্যান্ট নাইস্' (Infant Niece) নামে একটি কবিতা লেখেন। প্রায় ঐ সময়েই ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'অন দ্য মর্নিং অব ক্রাইস্টস্ নেটিভিটি' (On the Morning of Christ's Nativity) নামে একটি সুন্দর গীতিকবিতা লেখেন। এ ছাড়া তাঁর প্রথম যৌবনে লেখা “লা’ লেখো” (L' Allegro) এবং ইল পেনসেরোসো' (Il Penseroso) বিখ্যাত কবিতা।


এই কবিতার অঙ্গনের মধ্যেও আরও একটি ছোট্ট অঙ্গন হচ্ছে সনেট (Sonnet) বা চতুর্দশপদী কবিতার অজ্ঞান। এই চতুর্দশপদী বা সনেট রচনাতেও কবি সমান পারষ্কাম ছিলেন। এবং জীবনের প্রথম প্রভাত থেকে তাঁর জীবনের অন্তদিগন্ত পর্যন্ত অন্যান্য রচনার ফাঁকে ফাঁকেই তিনি সনেট রচনা করে গেছেন। নাট্যকার শেক্সপীয়রের সনেট সম্পর্কে যেমন বলা হয়ে থাকে যে মহাকবি শেক্সপীয়র তাঁর সনেটগুলির মধ্যে আপনার হৃদয়কে উন্মোচিত করেছেন, তেমনি মহাকবি মিল্টনও তাঁর সনেটগুলির মধ্যে আপনাকে উন্মোচিত করেছেন। নিজেকে পাঠকের মুখোমুখি নিয়ে এসেছেন।


সাধারণভাবে বলা হয় যে ইতালীর কবি পেত্রার্ক (Petrach) ১৪ অক্ষরের ১৪ টি চরণে একটিমাত্র অখণ্ড ভাব-কল্পনাকে প্রকাশিত করে যে গীতি-কবিতা রচনা করেন তাই সনেট (Sonnet) নামে প্রচলিত। ইংল্যাণ্ডে ওয়াট (Wyart) এবং সারে (Surrey) কাব্যে এই সনেট রীতির আমদানি করেন এবং সাহিত্যে এই রীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কবিতার এই চোদ্দটি পদ বা চরণ দুটি স্তবকে বিন্যস্ত। প্রথম আটটি চরণ নিয়ে একটি এবং পরবর্তী ছয়টি চরণ নিয়ে আর একটি। প্রথম ভাগের নাম অষ্টক (Octave), আর দ্বিতীয় ভাগটির নাম ষটক (Sestet)। প্রথম ভাগে অখণ্ড একটি ভাবকল্পনার ইঙ্গিত; দ্বিতীয় ভাগে তারই বিস্তৃতিসাধন বা ব্যাখ্যা। অষ্টকের আটটি চরণ আবার চারটি করে চরণ নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত। এর প্রত্যেকটি ভাগকে বলা হয় চতুষ্ক (Quatrain) ষটক-এর ছয়টি চরণও তেমনি তিনটি করে চরণের দুটো ভাগ। প্রত্যেক ভাগের নাম ত্রিপদিকা (Tercet)। সনেট রচনার এই প্রতিষ্ঠিত রীতি থেকে শেক্সপীয়র কিছুটা সরে এলেন। সরে এলেন স্তবক বিন্যাস ও মিলের রীতির দিক থেকে। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে শেকসপীয়রের সনেট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্বাতন্ত্র্যবিশিষ্ট ইংল্যান্ডীয় সনেটের চরম বিকাশ দেখা গেল।


কিন্তু মনে প্রাণে খাঁটি ক্লাসিক কবি মিল্টন সনেট রচনার ক্ষেত্রে শেক্‌সপীয়রকে অনুসরণ না করে কঠিনতর ইতালীর আদর্শই গ্রহণ করেন। রেনেসাঁসের যুগে প্রেমই ছিল সনেটের প্রধান বিষয়বস্তু। কিন্তু মিল্টন এর ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করলেন। রাজনৈতিক এবং নৈতিক বিষয় নিয়েও তিনি সনেট রচনা করেছিলেন। আঙ্গিক সৌষ্ঠবে মিল্টনের সনেটগুলি উৎকৃষ্ট।


‘অন রিচিং দ্য এজ অব্ টুয়েনটি থ্রি' (On Reaching the Age of Twentythree) কবির একটি উল্লেখ্য সনেট। কবিতার নামেই প্রকাশ, কবিতাটি কবির তেইশ বছর বয়সে লেখা। এরপরেই আর একটি উল্লেখ্য সনেট ‘ও নাইটিঙ্গেল' (O Nightingale)। কবিতা দুটিতে ঐ প্রথম বয়সেই কবির পবিত্রতা ও ধর্মনিষ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মহাকবি শেক্সপীয়রের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়েছে 'টু শেক্‌সপীয়র' (To Shakespeare) সনেটের মধ্য দিয়ে। এক মহাকবির উদ্দেশ্যে আর এক মহাকবির সশ্রদ্ধ স্বাক্ষর এই কবিতাটি।


নীতিবোধ ও দেশপ্রেমই কবি মিল্টনকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্দীপিত করে। তারপর পিউরিটান যুগে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঝড়ের দিনগুলিতে মিল্টনকে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে। মিল্টন হয়ে ওঠেন পিউরিটানপন্থীদের একজন প্রধান প্রবক্তা। এই রাজনৈতিক বিষয়কে নিয়েও মিল্টনের বেশ কিছু সনেট আছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য 'অন দ্য লেট ম্যাসাকার ইন পিমণ্ট' (On the Late Massacre in Piedmont), ‘ফেয়ারফ্যাক্স' (Fairfax), 'লজ' (Laws), 'দ্য অ্যাড্রেস টু ক্রমওয়েল' (The Address to Cromwell) প্রভৃতি কবিতা। শেষ কবিতাটিতে ইংল্যান্ডের সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যিনি পুরোধা ছিলেন সেই দেশনেতা ক্রমওয়েলকে স্মরণ এবং তাঁর প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়েছে। এই সঙ্গে সঙ্গে ধার্মিক এবং নিষ্ঠাবান মানুষের প্রতি যে অবর্ণনীয় নিষ্পেষণ ও অত্যাচার পিউরিটান যুগ অন্তে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে (Restoration period) আরম্ভ হয়েছিল, তার জন্য ব্যথিত কবি-হৃদয়ের অনুযোগ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়েছে কবির শেষ বয়সে লেখা 'অ্যাডেও ও লর্ড, দাই স্লন্টারড সেন্টস্' (Avenge, O Lord. Thy Slaughtered Saints) সনেট কবিতায়।


কবির ব্যক্তিগত মনের ছাপ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর 'অন হিজ ব্লাইন্ডনেস' (On his Blindness) সনেটটিতে। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি অন্ধ হয়ে যান। দৃষ্টিহারা হয়েও তিনি সান্ত্বনা দিয়েছেন মনকে হয়তো মনের চোখ খুলে দেবার জন্যই বাইরের চোখ বন্ধ করে দিয়েছেন ভগবান। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের 'সুরদাসের প্রার্থনা' কবিতাটির কথা আমাদের মনে পড়বে। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে লেখা আর একটি চমৎকার ব্যক্তিগত সনেট 'অন হিজ ডিসিড ওয়াইফ' (On his Deceased Wife)। কবি অন্ধ হয়ে যাবার পর তাঁর পত্নী বিয়োগে অসহায় কবি-মন, তাঁর পত্নীপ্রেম এবং ভগবান-নির্ভরতা কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে।


এই সনেটগুলিতে কবির ধর্মনিষ্ঠা ও অন্তরের পবিত্রতা ভাষা পেয়েছে। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এ জগতে মহৎ কর্তব্য সাধনের জন্য ভগবান তাঁকে পাঠিয়েছেন। তাঁর দেওয়া কাজের ভার সম্পূর্ণ করবার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। সাফল্য দূরাগত হলেও হতাশ হওয়া উচিত নয়। ভগবানে যাঁরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল তারাও তাঁর সেবক। কবি মিল্টনের সনেটগুলি তার কবি-প্রতিভার উজ্জ্বল সৃষ্টি।