রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক রচনার পরিচয় | সাহিত্য-মীমাংসা ও রবীন্দ্রনাথ

বাঙলা সাহিত্যের সর্বঘটেই সিদ্ধিদাতা-রূপে বিরাজমান রবীন্দ্রনাথ প্রধানতঃ কবি-রূপেই বিশ্বখ্যাতি অর্জন করলেও বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি যথার্থ অর্থেই ছিলেন 'সব্যসাচী'—গদ্যে-পদ্যে উভয়দিকেই ছিল তাঁর পারদর্শিতা, অথবা আরো বিশদভাবে বলা যায় যে তিনি ছিলেন 'সব্যসাচী' অর্থাৎ সাহিত্যের সর্ববিভাগেই ছিল তাঁর অবাধ সঞ্চরণ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রারম্ভকালেই কাব্য-নাটকাদি রচনার সঙ্গে গদ্যসাহিত্যেও তাঁর সমান আগ্রহের পরিচয় দান করেন। গদ্যসাহিত্যের প্রধান ধারা দুটি—একটি 'রসসাহিত্য' তথা গল্প উপন্যাস-আদি প্রাণধর্মী ভাবের সাহিত্য, এবং অপরটি ‘প্রবন্ধ সাহিত্য'—যেটিকে সাধারণভাবে মনোধর্মী বা জ্ঞানের সাহিত্য বলে অভিহিত করা হয়। সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ যেমন অনায়াস দক্ষতায় কাব্য রচনা করে গেছেন, তেমনি বিভিন্ন বর্গীয় গদ্যসাহিত্য রচনাতেও তিনি ছিলেন অক্লিষ্টকর্মা। তিনি সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন, এটি ছিল তাঁর ঋষি-ধর্ম; আবার সাহিত্য-বিশ্লেষণেও তিনি যে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তাঁর মননশীলতা, তথা মুনিধর্মেরও পরিচয় পাওয়া যায়। সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যতত্ত্ব-বিশ্লেষণে কিংবা সাহিত্য-মীমাংসায় রবীন্দ্রনাথ যে সিদ্ধি অর্জন করেছেন বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। তিনি যে সকল প্রবন্ধ রচনা করেছেন, জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ 'রবীন্দ্র রচনাবলী'র সম্পাদকমণ্ডলী সাধারণের সুবিধার্থে তাকে নয়টি বর্গে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন : (১) আত্মপরিচয়, (২) বিশ্বযাত্রী, (৩) পত্রাবলী, (৪) চারিত্রপূজা, (৫) শিক্ষা, (৬) ধর্ম, (৭) স্বদেশ ও সমাজ, (৮) ভাষা ও সাহিত্য এবং (৯) বিবিধ। উপযুক্ত তালিকা থেকেই বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং পরিমাণের বিপুলতা—বিষয়ে সামান্য আভা, পাওয়া যেতে পারে। আমাদের আলোচ্য বিষয় রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্যতত্ত্ব' পূর্বোল্লেখিত ‘ভাষা ও সাহিত্য' বর্গের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।


‘ভাষা ও সাহিত্য’-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে 'সমালোচনা' (১৮৮৮ খ্রিঃ), 'প্রাচীন সাহিত্য' (১৯০৭), 'লোকসাহিত্য' (১৯০৭), 'সাহিত্য' (১৯০৭), 'আধুনিক সাহিত্য' (১৯০৭), “শব্দতত্ত্ব' (১৯০১), 'ছন্দ' (১৯৩৬), 'সাহিত্যের পথে' (১৯৩৬), 'বাংলা ভাষা পরিচয়' (১৯৩৮) এবং 'সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩ খ্রিঃ—রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রকাশিত)। এদের মধ্যে ভাষা, ছন্দ এবং শব্দতত্ত্ব বাদে অপর গ্রন্থগুলি প্রধানতঃ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত—এক শ্রেণিতে পড়ছে সাহিত্য সমালোচনা জাতীয় গ্রন্থ এবং অপর শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা ও সাহিত্যভাবনার ফসল—'সাহিত্য', 'সাহিত্যের পথে’ ও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’—এগুলিকেই আমরা '‘সাহিত্যতত্ত্ব' তথা 'সাহিত্যমীমাংসা' বলে গ্রহণ করতে পারি।


এক সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সাহিত্যবিচার' নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'বিশেষ রচনার পরিচয় দেওয়াই সাহিত্য বিচারের লক্ষ্য'—পরবর্তীকালে তাঁর রচনা থেকে এই অংশটি বর্জন করলেও এ থেকে বিশেষ মনোভঙ্গির পরিচয়টুকু ধরা চলে। বস্তুতঃ এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তাঁর সাহিত্য-বিচার'-জাতীয় প্রবন্ধ রচনার যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ের সাহিত্য-বিষয়ক গ্রন্থগুলিতে যে সকল প্রবন্ধ সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তাদের প্রায় সবই কোনও সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্যগ্রন্থ-বিষয়ক আলোচনা। 'সাহিত্য' গ্রন্থেই রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম সাহিত্যতত্ত্ব-বিচারে তথা সাহিত্য-মীমাংসায় অবতীর্ণ হলেন। নিচে ‘সাহিত্য' গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলির রচনাকালসহ নাম উল্লেখ করা হলো—এ থেকে দেখা যাবে, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার অনেক পূর্ব থেকেই এ জাতীয় প্রচেষ্টায় তিনি ব্রতী হয়েছিলেন এবং বহু প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। 'সাহিত্য' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিম্নোক্ত প্রবন্ধগুলি : ‘সাহিত্যের তাৎপর্য' (১৩১০ বঙ্গাব্দ), 'সাহিত্যের সামগ্রী' (১৩১৪ ব.), 'সাহিত্যের বিচারক' (১৩১০ ব.), ‘সৌন্দর্যবোধ’ (১৩১৩ ব.) 'বিশ্বসাহিত্য' (১৩১৩ ব.), 'সৌন্দর্য ও সাহিত্য' (১৩১৪ ব.), 'সাহিত্যসৃষ্টি' (১৩১৪ ব.). 'বাংলা জাতীয় সাহিত্য' (১৩০১ ব.), 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' (১৩০৯ ব.), 'ঐতিহাসিক উপন্যাস' (১৩০৫ ব.), এবং 'কবিজীবনী' (১৩০৮ ব.)। এরপর গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে কটি অতিরিক্ত প্রবন্ধ ‘কাব্য : স্পষ্ট ও অস্পষ্ট' (১২৯৩ ব.), 'সাহিত্যের উদ্দেশ্য' (১২৯৪ ব.), 'সাহিত্য ও সভ্যতা' (১২৯৪ ব.), ‘আলস্য ও সাহিত্য' (১২৯৪ ব.), 'আলোচনা' (১২৯৮ ব.) 'সাহিত্য' (১২৯৯ ব.), 'সাহিত্যের প্রাণ' (১২৯৯ ব.), 'মানব প্রকাশ' (১২৯৪ ব.), 'কাব্য' (১২৯৮ ব.), 'বাংলা সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা' (১২৯৯ ব.), ‘বাংলা লেখক' (১২৯৯), 'সাহিত্যের গৌরব' (১৩০১ ব.), 'সাহিত্য সম্মিলন' (১৩১৩ ব.), 'সাহিত্য পরিষৎ' (১৩১৩ ব.)। রচনা-তালিকা থেকেই স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথের রচনারীতি যথেষ্ট পরিপক্কতা লাভ করবার পরই 'সাহিত্য' গ্রন্থের মূল প্রবন্ধগুলি রচিত হলেও পরবর্তীকালে উক্ত গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন কতকগুলি রচনা, যাদের রচনাকাল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সাধনার প্রস্তুতি পর্বেই।


এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-মীমাংসা-সম্পর্কিত অপর দুটি গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট প্রবন্ধগুলির নামোল্লেখে রবীন্দ্র-মানসের পরিচয় স্পষ্টতর হয়ে উঠতে পারে, এই সম্ভাবনার নিম্নে অপর গ্রন্থদ্বয়ের অন্তর্গত প্রবন্ধগুলির নাম-পরিচয় প্রদত্ত হলো। 'সাহিত্যের পথে' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিম্নোক্ত প্রবন্ধসমূহ বাস্তব, কবির কৈফিয়ৎ, সাহিত্য তথ্য ও সত্য, সৃষ্টি, সাহিত্যধর্ম, সাহিত্যে নবত্ব, সাহিত্য বিচার, আধুনিক কাব্য, সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্যের তাৎপর্য, সভাপতির অভিভাষণ, সভাপতির শেষ বক্তব্য, সাহিত্য সম্মিলন, কবির অভিভাষণ, সাহিত্য সমালোচনা, রূপকার, পঞ্চাশোর্ধর্ম, বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ, রূপশিল্প, একখানি চিঠি'। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ক সর্বশেষ প্রবন্ধ, যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে, সেই 'সাহিত্যের স্বরূপ' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট অগ্রথিত সাহিত্য বিচারমূলক প্রবন্ধসমূহ। এই প্রবন্ধগুলি রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনে। এগুলির নাম- 'সাহিত্যের স্বরূপ, সাহিত্যের মাত্রা, সাহিত্যে আধুনিকতা, কাব্যে গদ্যরীতি, কাব্য ও ছন্দ, গদ্য কাব্য, সাহিত্য বিচার, সাহিত্যের মূল্য, সাহিত্যে চিত্রবিভাগ, সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা এবং সত্য ও বাস্তব। শেষ দুখানি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-পরিণতি এবং সমুৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয়।


সাহিত্য-মীমাংসা ও রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ সর্বার্থেই ছিলেন সাহিত্য-সাধক। তিনি একদিকে যেমন নিত্য নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করে প্রাণধর্মী সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, অপরদিকে তেমনি সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্য-বিচার এবং সাহিত্য-মীমাংসা বিষয়েও নানাভাবে তাঁর সুনিশ্চিত অভিমত ব্যক্ত করে তাঁর মননশীলতার সুস্পষ্ট পরিচয় জ্ঞাপন করেছেন। সাহিত্য বিচারে তিনি বিভিন্ন সাহিত্যিক কিংবা তাঁদের সাহিত্যগ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সাহিত্য বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনার পরিচয় দান ছাড়াও সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়েও সরাসরি বহু প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন—এগুলিকেই বলা হয়। সাহিত্য-মীমাংসা'। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তিনি এ বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে পরবর্তীকালে তাদের গ্রন্থবদ্ধ করায় ঐ প্রবন্ধগুলি কোনো নিগূঢ় ঐক্যসূত্রে প্রথিত হয়ে কোনো প্রথাবদ্ধ তত্ত্বে রূপায়িত হয়ে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ঐ সমস্ত প্রবন্ধ থেকে সাহিত্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বোধ বা ভাবনাকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়।


বাঙালী মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-মীমাংসায় প্রথম পুরুষ না হলেও যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ তা অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে আরো অনেকেই সাহিত্য-বিষয়ে নিজস্ব মতামত জ্ঞাপন করলেও তাঁদের মধ্যে একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রই সাহিত্য সমালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিশিষ্টতা প্রদর্শন করেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, ড. সুবোধ সেনগুপ্তের ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র “শ্রেষ্ঠ সমালোচক, কিন্তু উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যতত্ত্ববিদ নহেন।” বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য ছিল যে পরোপকার ভিন্ন সাহিত্য-গ্রন্থ প্রণয়নের অপর কোনো উদ্দেশ্য নেই, জনসাধারণের জ্ঞানবৃদ্ধি তথা চিত্তোন্নতি সাধনই সাহিত্য রচনার লক্ষ্য। অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র শিক্ষাদান এবং চিত্তোৎকর্ষ সাধনকেই সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য বলে মনে করেন। আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন, “সাহিত্যও ধর্ম ছাড়া নহে, কেন না, সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য তাহা ধর্ম।" বস্তুতঃ বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যতত্ত্ব যেমন কোনো দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তেমনি কোনো দর্শনচিন্তার সঙ্গে তা গভীরভাবে অন্বিতও নয়। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথই প্রথম তাঁর সাহিত্যভাবনাকে দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করেন। ফলতঃ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা এবং দর্শনচিন্তা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে তাঁর জগতত্ত্ব এবং জীবনতত্ত্বের মধ্যে, তাঁর দার্শনিক উপলব্ধিতে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যচিন্তার অনেক মূলসূত্রকেই। রবীন্দ্রনাথের পরিণতি পর্বের সাহিত্যতত্ত্ব-বিষয়ক আলোচনাতেই আমরা তাঁর এই বিশেষ বিশেষ চিন্তাধারার পরিচয় পাই। অতএব, এই হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে আমরা আধুনিক বাঙলার সাহিত্যমীমাংসা শাস্ত্রের অগ্রদূতরূপে গ্রহণ করে নিতে পারি এবং প্রাচীন ভারতের নমস আলঙ্কারিকদের সঙ্গে তাঁর নামও একই সঙ্গে উচ্চারণ করিতে পারি।


রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যে এবং আধুনিক য়ুরোপীয় সাহিত্যেও যে সুন্নাত ছিলেন তার যথাযোগ্য প্রমাণ আমরা তাঁর রচনায় পেয়ে থাকি। রবীন্দ্রসাহিত্যে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব-বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে গবেষকগণ বিস্তর প্রমাণপন্থী উদ্ধার করে উক্ত সাহিত্যসমূহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বিবরণ জানিয়েছেন। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রে ('সাহিত্য মীমাংসা' বা Poetics বিষয়ে প্রচলিত Rhetoric বা অলঙ্কার বিষয়ে নয়) কিংবা য়ুরোপীয় ‘কাব্যতত্ত্ব' বা Poetics-এর সঙ্গে যে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, তেমন মনে হয় না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-মীমাংসায় ভরত, ভামহ, দণ্ডী, লোচন, কিংবা বিশ্বনাথ-আদি আলঙ্কারিকদের প্রভাবের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না; প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রের কিছু সুপরিচিত এবং বহু ব্যবহৃত বাক্য ব্যবহার করলেও তিনি তাদের পারিভাষিক অর্থকে বর্জন করে স্বীয় প্রয়োজনের উপযোগী করে তুলেছেন। অতএব তাঁর সাহিত্য-মীমাংসা যে প্রাচীন ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র-নিরপেক্ষ ছিল তা অবশ্যই মেনে নিতে হয়। কারণ, উক্ত শাস্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই এভাবে তাকে এড়িয়ে যেতেন না। তবে স্বীকার করতে হয়, পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যতত্ত্ব যথা Poetics-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল অপেক্ষাকৃত গভীর, যদিও সেই পরিচয় প্রত্যক্ষ না হয়ে পরোক্ষ হওয়াই সম্ভবপর। এবং রবীন্দ্রনাথের পরিণত জীবনে সেই প্রভাবও অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল বলেই মনে হয়।


সাহিত্যতত্ত্ব বা সাহিত্য-মীমাংসা-বিষয়ে আলোচনা গেলেই 'সাহিত্য' শব্দটির অর্থ-বিষয়ে অবহিত হওয়া প্রথমেই প্রয়োজন। 'সাহিত্য' শব্দটির প্রয়োগ প্রাচীনতর কালে বিশেষ পাওয়া যায় না, তৎসস্থলবর্তী শব্দ ছিল 'কাব্য'। 'সাহিত্য' শব্দটির মূলে রয়েছে 'সাহিত্য' শব্দ। প্রাচীন আলঙ্কারিকগণ 'সাহিত্য' শব্দকে বিশ্লেষণ করেন—‘হিতের সহিত বর্তমান' রূপে—অর্থাৎ এ থেকেই বোঝা যায় যে, প্রাচীন আলঙ্কারিকগণ হিত-সাধনাকেই সাহিত্যের উদ্দেশ্য বলে বিবেচনা করতেন। কিন্তু সাহিত্যের এই উদ্দেশ্যপরায়ণতা অনেকেই মেনে নিতে চান না বলে ওঁরা 'সাহিত্য' শব্দটিকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। এঁরা মনে করেন 'সহ ইত' অর্থাৎ ‘সহ' অর্থই এখানে প্রধান—শব্দের সঙ্গে অর্থের মিলনেই সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এতে সহিত-ত্বের ভাবটা বজায় থাকলেও রবীন্দ্রনাথ এর এত সরল অর্থ মেনে নেন নি। তিনি মিলন বা নৈকট্য অর্থেই 'সাহিত্য' শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু শব্দের সঙ্গে অর্থের মিলন নয়, এই মিলন এক হৃদয়ের সঙ্গে অপর হৃদয়ের, রসস্রষ্টা কবি-হৃদয়ের সঙ্গে রসভোক্তা পাঠক-হৃদয়ের সাযুজ্য স্থাপনে সাহিত্যের সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এর থেকে বুঝতে পারি, ভাষার ক্ষেত্রে সাহিত্য শব্দের তাৎপর্য কী। তার কাজ হৃদয়ের যোগ ঘটানো, যেখানে যোগটাই শেষ লক্ষ্য।” অন্যত্রও তিনি বলেছেন, “সাহিত্যের অর্থই হল সম্মিলন, একত্র থাকবার ভাব। সহিতত্ত্ব অর্থাৎ সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকবার আকাঙ্ক্ষা সাহিত্য কথাটির তাৎপর্য। সাহিত্যের প্রভাবে হৃদয়ে হৃদয়ে শীতাতপ সঞ্চারিত হয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, ঋতুচক্র ফিরে, গন্ধ, গান ও রূপের হাট বসিয়া যায়।” সাহিত্যে এই যে মিলন ঘটে, এটি ত্রিমুখী ধারায় বিকশিত হতে পারে—প্রথমতঃ, এই মিলন সাধিত হয় লেখকের সঙ্গে বহির্জগতের, ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের মিলন। দ্বিতীয়তঃ ঘটে লেখকের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টির মিলন এবং তৃতীয়তঃ, সাহিত্য-সংসারের সঙ্গে মিলন ঘটে পাঠকের এবং এই সূত্রে লেখকের সঙ্গে পাঠকের।


সাহিত্য মীমাংসায় যে প্রশ্নটি সর্বদেশে সর্বকালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তাহলো-সাহিত্যের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য-বিষয়ক। সাধারণতঃ এর উত্তর 'সত্যম শিবম সুন্দরম'-এর মধ্যেই নিবন্ধ থাকে। সত্যের ধারণা দেশকালের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়। একালের বস্তুবাদী দার্শনিক তথা সাহিত্যের ভোক্তাগণ মনে করেন যে সাহিত্যে ঘটে জীবনের রূপায়ণ এবং সাহিত্য সমাজের দর্পণ। বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন সমালোচক সাহিত্য-মীমাংসায় এই সত্যকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। সাহিত্যে 'শিব' অর্থাৎ মঙ্গলের ভূমিকা বিষয়েও সেকালের মতোই একালেও বহু সমালোচকই অভিন্নমত। সমাজের হিতসাধন ব্যতীত সাহিত্যের অপর কোনো উদ্দেশ্যকেই তাঁরা স্বীকার করেন না। সৌন্দর্য বিষয়েও সেকালে-একালে বিশেষ পার্থক্য নেই। সেকালের অলঙ্কারবাদী—যাঁরা মনে করতেন 'কাব্যংগ্রাহাম্ অলঙ্কারাৎ', তাঁরাও স্বীকার করতেন ‘সৌন্দর্যমলঙ্কারম্'—অর্থাৎ সৌন্দর্যই অলঙ্কার। একালের 'নন্দনত্ত্ববাদী' অর্থাৎ ‘ইচ্ছেট্‌'গণও সাহিত্যের মূল লক্ষ্য যে সৌন্দর্যসৃষ্টি এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। অথচ আমাদের প্রচলিত ধারণায় যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা ‘সত্য-শিব-সুন্দরে'র উপাসক বলে মনে করে এসেছি, তিনি কিন্তু সাহিত্যের লক্ষ্য নির্দেশ করতে গিয়ে এদের পাশ কাটিয়ে গেছেন। এদের কোনোটিকেই পরিপূর্ণভাবে অস্বীকার না করেও রবীন্দ্রনাথ 'আনন্দ'কেই সাহিত্যের চরম লক্ষ্য বলে নির্দেশ করেছেন।


রবীন্দ্রনাথ আবাল্য যে ঔপনিষদিক পরিবেশে লালিত পালিত হয়েছেন, সেই উপনিষদ থেকেই তিনি আহরণ করেছিলেন 'আনন্দ'-বিষয়ক ধারণা। 'আনন্দ-রূপমমৃতং যদ্বিভাতি'—যা কিছু আছে, সবই আনন্দ-স্বরূপ, সবই অমৃত। কিংবা 'আনন্দান্ধ্যের খল্বিমানি ভূতানি জায়ত্তে আনন্দেন জাতানি জীবত্তি, আনন্দং সম্প্ৰয়স্ত্যভিসংবিশস্তি'—আনন্দের মধ্যে জীব জন্মগ্রহণ করে, আনন্দে বেঁচে থাকে এবং আনন্দের অভিমুখে যাত্রা করে,—রবীন্দ্রনাথ এটিকেই সাহিত্য মীমাংসার সারবস্তু-রূপে ধরে নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। তিনি উপনিষদের এই উত্তরাধিকারকে স্বীকার করে নিলেও এই আনন্দতত্ত্ব তাঁর মৌলিক উপলব্ধিজাত ও একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব। এই মৌল প্রত্যয়কে ভিত্তি করেই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যমীমাংসায় উপনীত হয়েছেন। শুধু সাহিত্য নয়, এই আনন্দকে তিনি উপলব্ধি করেছেন জীবনতত্ত্বে বিশ্বতত্ত্বে। তাই তিনি বলেন, “আনন্দটিই হচ্ছে সব শেষের কথা, এরপর আর কোনো কথা নেই।” এমন কি যে অপরিমিত দুঃখ বেদনা মানুষকে নিরন্তর নিপীড়িত করে, তার মধ্যেও তিনি আনন্দের সন্ধান পেয়েছেন, তাই তিনি বলেন, “দুঃখের তীব্র উপলব্ধিও আনন্দকর, কেন না সেটা নিবিড়ভাবে অস্মিতাসূচক।”


সত্য, শিব ও সুন্দর-বিষয়েও রবীন্দ্রনাথের মনোভাব ছিল অনুকূল। এ বিষয়ে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, "রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সাহিত্যের আসল লক্ষ্য আনন্দ। যা আনন্দকর তাকেই আমরা সুন্দর বলি। যা ললিত মধুর, কমনীয় জীবনে সচরাচর যাকে আমরা সুন্দর বলি তা সাহিত্যের আসল লক্ষ্য নয়। হিতসাধনবাদী না হয়েও, তত্ত্বগতভাবে কলাকৈবল্যবাদী হয়েও কার্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কলাকৈবল্যবাদীদের সহগামী নন। সৌন্দর্যের প্রশ্নে 'ই’েদের সঙ্গে তাঁর মনের মিল নেই। ত্বক্‌চিক্কণতাকে, ভাসমান পেলবতাকে তিনি কখনোই সুন্দর বলেন নি। জীবনের অপরাপর মূল্য থেকে যে সৌন্দর্য বিচ্ছিন্ন তাকে রবীন্দ্রনাথ ধিক্কারই দিয়েছেন। তাঁর কাছে আনন্দ ও সত্য যেমন অভিন্ন, তেমনি সত্য ও সামস্যও তেমনি অভিন্ন। সৌষম্য বা সামঞ্জস্য–এরই অপর নাম সুন্দর। আবার একেই রবীন্দ্রনাথ বলেন কল্যাণ তাঁকে হিতসাধনবাদী না বলি, গভীর অর্থে, কল্যাণবাদী বলতে কোন বাধা নেই। এই কল্যাণ-ভাবনা রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়, অনুভবে কর্মে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। এই কল্যাণ-ভাবনা রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সাহিত্যতত্ত্বের ভিত্তিমূলে সব সময় সক্রিয়।”


এক্ষণে সাহিত্য মীমাংসা-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মূল ভাবনাগুলিকে একটু গুছিয়ে আনা যেতে পারে। তিনি সাহিত্যের অবলম্বন-রূপে স্বীকার করেছেন ভাবের বিষয়কে, সেখানে জ্ঞানের বিষয় অপাংক্তেয়। তবে ভাব-অর্থে তিনি সমগ্র মনকেই গ্রহণ করেছেন, যেখানে বুদ্ধিরও স্থান রয়েছে। তিনি বুদ্ধিবাদী নন, কিন্তু রোম্যান্টিকদের মতো বুদ্ধি-বিরোধীও নন। রবীন্দ্রনাথ ভাবকে হৃদয়ধর্মী অনুভূতিজাতীয় বৃত্তি তথা প্রজ্ঞাবৃত্তি-রূপে গ্রহণ করেছেন—এখানে রোম্যান্টিকদের সঙ্গে তাঁর সাধম। সাহিত্য বা শিল্পের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ 'লীলাবাদী’ তথা অপ্রয়োজনবাদী। এমন কি 'কলাকৈবল্যবাদ' বা 'শিল্পের জন্যই শিল্প' নীতি (art for the sake of art)—রোম্যান্টিকদের যাতে ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন, তাতেও রবীন্দ্রনাথের সায় ছিল না। তিনি শিল্পের স্বরাজ্য, পরিপূর্ণ স্বাধিকারে বিশ্বাসী। সাহিত্যতত্ত্বে রবীন্দ্রনাথ অনুভূতি বা উপলব্ধির যে গুরুত্ব স্বীকার করেছেন, সেইদিক থেকে রোম্যান্টিকদের সঙ্গে তাঁর মানসিক ঐক্যবোধ রয়েছে। সাহিত্য-মীমাংসায় রবীন্দ্রনাথ সৃজনশীল কল্পনার উপর অসাধারণ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাধারণভাবে রোম্যান্টিক সাহিত্যতত্ত্বের সঙ্গে এখানে সাদৃশ্য থাকলেও “রবীন্দ্রনাথ তাঁর কল্পনাতত্ত্বকে সৃষ্টিকর্তা মানুষের তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে একটি সার্বভৌম বৃত্তি হিসেবে কল্পনাকে এমন এক দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ঊনবিংশ শতকীয় রোম্যান্টিকদের মধ্যে যার সন্ধান মিলবে না।” তবে পাশ্চাত্ত্যের রোম্যান্টিকদের মতোই রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যে ছিলেন প্রকাশবাদী, কিন্তু তা শুধুই কবির আত্মপ্রকাশ নয়, তিনি বলেন মান-প্রকাশের কথা। প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় অন্তরঙ্গতায় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ এখানেও রোম্যান্টিকদের সমধর্মী, অবশ্য পরবর্তীকালের রচনায় রবীন্দ্রনাথ রোম্যান্টিকতা থেকে উত্তীর্ণ হতে চেষ্টা করেছেন।