বাংলা সাহিত্যে ওয়ার্ডওয়ার্থের প্রভাব আলোচনা করো।

ইংরেজি সাহিত্যে উনিশ শতকের প্রথমদিকে যে রোমান্টিক সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটল, বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব অনুভূত হল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই মধুসূদনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। যদিও মধুসুদন মহাকাব্যের কবিরূপে পরিচিত এবং মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করলেও তাঁর অন্তরের গভীরে রোমান্স পিপাসা ছিল আন্তরিক। প্রথম জীবনে মধুসুদনের মানস পরিমণ্ডল গঠনে বায়রন, মুর ও স্কটের প্রভাব সহায়তা করেছে তবু তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রতি অনুরাগের কথা ব্যক্ত করেছেন। বন্ধুকে লিখিত তাঁর এক পত্রে কবি বলেছেন, 'I like Wordsworth better.'


অবশ্য মধুসূদন একথা বললেও মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রমুখ কবিদের ওপরে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব ততখানি নয়, যতখানি রয়েছে বায়রন, স্কট ও মুরের প্রভাব। এমনকী গীতিকবি বিহারীলালের ওপরেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর থেকে শেলীর প্রভাব অধিকতরভাবে দৃষ্ট হয়। বাংলা কবিতায় ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে রবীন্দ্রনাথের কথাই এসে পড়ে। প্রকৃতির কোনও সৌন্দর্য ওয়ার্ডওয়ার্থের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাকে তিনি জেনেছেন, প্রাণময়ী, স্নেহময়ী, করুণাময়ী, ঐশ্বরিক শক্তির আধাররূপে। তাঁর এই অনুভূতিই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ওয়ার্ডওয়ার্থের Lines Written in Early Spring ( প্রথম বসন্তে) কবিতা—

"To her fair works did Nature link.

The human soul that through me ran....

•••••

And is my faith that every flower

Enjoys the air it breathes."


কবি ভাবনার সঙ্গে তুলনীয় রবীন্দ্রনাথের—

“এ আমার শরীরের শিরায় শিরায় 

যে প্রাণতরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়

সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্ব দিগ্বিজয়ে।

সেই প্রাণ............

..............চুপে চুপে 

বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে

লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরযে 

বিকাশে পল্লবে পুষ্পে।".....

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘বসুন্ধরা', 'অহল্যার প্রতি' প্রভৃতি কবিতার কথাও মনে পড়বে।


অধ্যাত্মবোধ, নৈতিক চেতনা এবং জীবনসাধনাতেও এই দুই কবির মধ্যে বেশ কিছুটা মিল রয়েছে, আর এইজন্যই কি কৌতুকচ্ছলে 'শেষের কবিতা'য় রবীন্দ্রনাথ অমিতকে দিয়ে বলিয়েছেন : “রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওয়ার্ডওয়ার্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায় রকমে বেঁচে আছে।” সৃষ্টির মূলে যে দৈবী প্রেরণা যে অলৌকিক উন্মাদনা অথবা চৈতন্যের এক আকস্মিক উদ্ভাস বা জাগরণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ওয়ার্ডওয়ার্থের সাদৃশ্য বিশেষ লক্ষণীয়।


এই নিসর্গ চেতনা বা প্রকৃতি পূজায় ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাদৃশ্যের কথা স্মরণ করেও উভয় কবির মধ্যে প্রকৃতি চেতনার পার্থক্যটুকুও আমাদের মনে রাখতে হবে। উভয় কবিই প্রকৃতি যে প্রাণময়ী এবং প্রকৃতি ও মানব যে একই মহান সত্যের বিভিন্ন প্রকাশ তা অনুভব করেছেন। কিন্তু ওয়ার্ডওয়ার্থ প্রকৃতির রূপের মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তাহা যে পরমসুন্দরের রূপচ্ছটার প্রকাশ—এই অনুভূতিকেই তাঁর প্রকৃতি পূজার মূলমন্ত্র করেননি। প্রকৃতির সৌন্দর্য উদ্ঘাটন তাঁর কবি- কর্ম নয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাঁর প্রাণে যে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সেই অনুভূতিই তাঁর কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে। কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের দৃষ্টিতে প্রকৃতি মানুষের মনকে নববলে বলীয়ান করে, তাঁকে সাংসারিকতার কলুষ থেকে মুক্ত করে, ধর্মবিশ্বাসকে দৃঢ় করে ও গভীর আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা দেয়। প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনা ওয়ার্ডওয়ার্থে আছে, কিন্তু প্রকৃতির এইসব রূপ বা দৃশ্য, সমস্ত বাসনা-ভাবনা-চিন্তা দূর করে হৃদয়ের গভীর স্থৈর্য সম্পাদন করে, মনে গভীর ভগবদ্ভক্তি, ভগবদ্ উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে।


কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সৌন্দর্যে চিরসুন্দরেরই সৌন্দর্য অনুভব করেছেন। প্রকৃতির খণ্ড সৌন্দর্যে তিনি পেয়েছেন অনন্ত সৌন্দর্যের আভাস। রবীন্দ্রনাথের লীলাবাদের রসোপলব্ধি ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কাব্যে নেই, আছে খ্রিস্টীয় ভক্তিবাদ এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শুচিতার আবেদন। ওয়ার্ডওয়ার্থের কাব্যের মূলদেশে আছে ধর্ম ও নীতি—রবীন্দ্রনাথের পরমসুন্দরকে ও পরম রসময়কে আস্বাদন। ধরণীর সমস্ত সৌন্দর্য যে সেই মহান চিরসুন্দরের অংশ তা তিনি অনুভব করেছেন।—ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর দুই গোলার্ধের দুই মহাকবির মধ্যে এখানেই রয়েছে নৈকট্য ও পার্থক্য।


রবীন্দ্র-অনুসারী কবি-সমাজের ওপরও প্রকৃতি প্রেমিক কবি ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের প্রভাব অনুল্লেখ্য নয়। সরল পল্লী কবিতাগুলিতে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ওয়ার্ডওয়ার্থের ভাবাদর্শ দ্বারা অল্পাধিক প্রভাবিত হয়েছেন। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের The Reveries of Poor Susan (দিবাস্বপ্ন) কবিতার অনুবাদ করেছেন। Evening of Calais Beach ( সমুদ্র সৈকতে) কবিতার অনুবাদ করেছেন আলোক সরকার।


The Stepping Stones এবং The Solitary Reaper কবিতা দুটির যথাক্রমে 'সাঁকো' এবং 'কৃষাণী আপন মনে' নামে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অনুবাদের কথাও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।


প্রকৃতি-তন্ময়তা, মানবতাবোধ এবং প্রকৃতি-রহস্যময়তা নিয়ে বিস্ময়বোধের যে পুনর্জাগরণ রোমান্টিক যুগে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মধ্য দিয়ে ঘটল, রবীন্দ্র ও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যে সেই চেতনা আজও বহমান।