কীটসের কবিতা বিশেষত প্রশস্তিমূলক গীতিকবিতা 'ওড' সমূহের পরিচয় দাও | কীটসের 'ওড'গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রোমান্টিক কবিদের মধ্যে তাঁর স্বাতন্ত্র্য এবং অনন্যতা নির্দেশ করো।

রোমান্টিক যুগের উল্লেখ্য কবি কীটসের জীবনকাল মাত্র পঁচিশ বছরের (১৭৯৫-১৮২১ খ্রিঃ)। তাঁর কাব্যজীবন আরও ছোটো, মোটামুটি চার বছরের (১৮১৬-১৮২০ খ্রিঃ)।


১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ‘একজামিনার' পত্রিকায় কীটসের একটি সনেট প্রকাশিত হয়। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় 'চাপম্যানের হোমার'-এর ওপর 'অন দ্য ফার্স্ট লুকিং ইনটু চাপম্যানস্ হোমার' (On the First Looking into Chapman's Homer) নামে আর একটি সনেট। তাঁর লেখা সনেটগুলি নিয়ে বন্ধুবর কবি শেলির সহায়তায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে 'পোয়েমস বাই জন কীটস' (Poems by John Keats) নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এখানে রচিত কবিতাগুলি তাঁর কুড়ি-একুশ বছর বয়সের রচনা। স্পেন্সারের সজ্ঞান অনুসরণের স্বীকৃতি রয়েছে কবির ইমিটেশন অব স্পেন্সার' (Imitation of Spencer) নামক কবিতায়। 'ক্যালিডোর' (Calidore) কবিতায় স্পেন্সারের 'ফেয়ারি কুইনের' প্রভাব পড়েছে। স্যর ক্যালিডোর হচ্ছেন বীর নায়ক এবং সৌজন্যের প্রতীক (Knight of Courtesy)। এই সময়ের আর একটি কবিতা 'আই স্টুড টিপ টো আপন এ লিটল হিল' (I stood tip-toe upon a little hill)। নির্জন পাহাড়ের বুকে কবি-অনুভবের এক চমৎকার প্রকাশ কবিতাটিতে রয়েছে। চমৎকার দুটি পত্তি—'মর্মরিত নীরবতা পাতায় পাতায়—'অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস নীরবতাই বাড়ায়।' 'স্লীপ অ্যান্ড পোয়েট্রি' (Sleep and Poetry) আর একটি উল্লেখ্য কবিতা। এই কবিতাটিতে কবি জীবনের নশ্বরতা ও কাব্যের অমরতার কথা বলেছেন। বলেছেন— জীবন তো একদিন! তরুশির থেকে ঝরে পড়া একটি শিশিরবিন্দু' (Life is but a day. / A fragile dew-drop on its perilous way / From a tree's summit.)। তাঁর প্রসিদ্ধ সনেটগুলির মধ্যে 'চ্যাপম্যানের অনুবাদে প্রথম হোমার পর্বে' (On The First Looking into Chapman's Homer) উল্লেখ্য। এ ছাড়া 'ভ্রাতা জর্জ' (To My Brother George), 'কুসিয়ুস্কো' (Kosciusko), ‘লী হান্টের মুক্তিতে' (On the Day that Leigh Hunt Left Prison) প্রভৃতি তাঁর প্রসিদ্ধ সনেটগুলির অন্যতম।


এই কবিতাগুলির মধ্যেই পরবর্তীকালের কীটসের মানসিকতার পরিচয় পাই। একদিকে সৌন্দর্য এষণা, তাঁর রোমান্টিক মানসিকতা অপরদিকে হেলেনিক বা প্রাচীন গ্রিক জগতের প্রতি, ক্লাসিক ভাবনার প্রতি আকর্ষণ তাঁর অন্তরে ক্লাসিক ও বাইরে রোমান্টিক বা ক্লাসিক-রোমান্টিক ভাবনা বিমিশ্রিত তাঁর অন্তর জগৎ গড়ে তুলেছে। এই প্রথমদিকের কবিতাগুলিতে প্রথম বয়সের ভাবপ্রবণতার আধিক্য ও ভাব প্রকাশের বাহন ভাষা ও ছন্দের মধ্যে কিছু কিছু দুর্বলতার জন্য সমকালীন দু'টি পত্রিকা 'ব্লাকউডস ম্যাগাজিন' (Blackwood's Magazine) এবং 'কোয়াটার্লি রিভিয়্যু' (Quarterly Review) এই কাব্যটির কঠোর সমালোচনা করে, কিন্তু সে নিন্দা যে অযৌক্তিক কালের কষ্টিপাথরেই তা প্রমাণিত হয়েছে।


এ বছর 'এণ্ডাইমিয়ন', 'লামিয়া', ইসাবেলা', 'দ্য ইভ অব সেন্ট আগ্নিস', 'হাইপীরিয়ন' প্রভৃতি সমাপ্ত অসমাপ্ত কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। কিন্তু কীটস সবচেয়ে স্মরণীয় তাঁর 'ওড' কবিতাসমূহের জন্য। এই প্রশস্তিমূলক 'ওড' কবিতাগুলি কবির শেষ কাব্য 'লামিয়া এন্ড আদার পোয়েমস' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত।


'ওড়' (Ode) কথাটির গ্রিক অর্থ 'গান'। প্রাচীন গ্রিসে পিন্ডার-রচিত ওডগুলি ও গ্রিক নাটকের অন্তর্গত ওডসমূহ নাচের সঙ্গে গাওয়া হত। পরবর্তীকালে সাহিত্যে গভীর ভাবপূর্ণ একশ্রেণির গীতিকবিতাকে বলা হয় ‘ওড’। এই কবিতা কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়। বাংলায় 'ওড'-কে অনেকে বলেন ‘প্রশস্তিকবিতা'।


কীটসের এই প্রশস্তিমূলক কবিতা 'ওড'গুলির মধ্যে দ্রষ্টা ও শিল্পীর সমন্বয় ঘটেছে। যে সুন্দরের ধারণা প্রথমদিকে কীটসের কাছে শুধু রোমান্টিক ভাবকল্পনার বিস্তার মাত্র ছিল, এই ছোটো ছোটো কবিতাগুলিতে তা যেন আমাদের সামনে প্রতীকরূপ পরিগ্রহ করল, যা একমাত্র ভাস্কর্যের মধ্য দিয়েই অনুভব করা সম্ভব। কবিতাগুলি লেখা হয়েছিল ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে, তখন তার বয়স মাত্র তেইশ পেরিয়েছে।


কীটসের 'ওড' কবিতাগুলির মধ্যে 'ওড টু এ নাইটিঙ্গেল' (Ode to a Nightingale), 'ওড অন ও গ্রীসিয়ান আর্ন' (Ode on a Grecian Urm), 'ওড় অন মেলাংকলি' (Ode on Melancholy) এবং 'ওড টু অটাম’ ( Ode to Autumin)—এই চারটি ইংরেজি সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ। কবিতাগুলিতে একদিকে রোমান্টিক ‘চমৎকার প্রাচুর্য' (fine excess) অপরদিকে ক্লাসিক 'চমৎকার সংযম' একত্র বাঁধা পড়েছে।


‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল' বুলবুলি প্রশস্তি। নাইটিঙ্গেল বা বুলবুলির গান কবির মনে স্বপ্ন জাগায়, জাগায় তন্দ্রাচ্ছন্ন বেদনা। এ বেদনা পৃথিবীতে অপূর্ণতার বেদনা, সৌন্দর্যের নশ্বরতার বেদনা। এই সংসার, ক্লান্তি, চিন্তা, পরস্পরের কাতর আর্তনাদ যদি ভুলে যেতে পারতেন; এই পৃথিবী সৌন্দর্যের নশ্বরতা যেখানে দুদিনেই সুন্দর যুবক জরাগ্রস্ত বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়, সুন্দরীর নয়নের দীপ্তি হারিয়ে যায়, সেখানে চিরন্তনতার আশা ব্যর্থ। তার চেয়ে সুধাবিন্দু পান করে তিনি নাইটিঙ্গেলের সাথী হয়ে সুদূর সৌন্দর্যলোকে প্রয়াণেই প্রত্যাশী। অন্ধকার ঘনায়, কবির পায়ের নীচে অজানা, ফুল, ডালে ডালে মৃদুগন্ধ, তৃণে ঝোপে বনফুলে বিচিত্র সৌরভ। এমন সুখাবেশে মৃত্যুও সুন্দর, অমর নাইটিঙ্গেল। অতীতেও সম্রাট ও পরিষদেরা শুনেছেন এই পাখির গান। প্রবাসে শস্যক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ বুথ এর গানই শুনে হয়েছিল গৃহ-বিধুর। এই সুরে সুরে সিন্ধুতলের পরীরাজ্যে খুলে গেছে নিঃসঙ্গ বন্দিনীর মায়া-বাতায়ন। নিঃসঙ্গ (forlorn) কথাটি বেজে উঠল ঘণ্টার মতো। স্বপ্নরাজ্য থেকে কবি ফিরে এলেন বর্তমানের বুকে। কল্পনার মোহভঙ্গ হল। বিদায়। বিদায়! দূরে মিলিয়ে যায় পাখির গান—পেরিয়ে যায়। মাঠ, নদী, হারিয়ে যায় পাহাড়ের কোল ঘেঁসে ওধারের উপত্যকায়। এ স্বপ্ন না সত্য? কবি জেগে না ঘুমিয়ে? এই নশ্বর জীবনের দুঃখ ও কল্পনার মায়া-মাধুরী মিলিয়ে কবির এক অপূর্ব রসসৃষ্টি।


'ওড টু অটাম' কবিতাটিতে কবি শরতের পরিপূর্ণতার চিত্র এঁকেছেন। বাংলাদেশের শরতের রঙ সবুজে ও গৈরিকে মেশা। ইংলণ্ডের শরৎ ফলের ঋতু, ফুলের ঋতু, কীটসের কথায় কুয়াশা আর পাকা ফলের ঋতু। দ্রাক্ষালতাকে ভরে তোলে ফলে, আপেলগাছগুলিকে আপেলের ভারে নুইয়ে দেয়। রসের ভারে সব ফলই হয় টুসটুসে। ফোটে কুঁড়ির পরে কুঁড়ি, ঋতুশেষের ফুলগুলিকেও ফুটিয়ে তোলে মৌমাছিদের জন্যে। শস্যাগারের মেঝেতে বসে শরৎ ফসল ঝাড়ছে, চুলগুলি তার হাওয়ায় উড়ছে। অথবা অর্ধেক ফসল কাটা মাঠে আফিম ফুলের নেশা ধরানো গন্ধে শরৎ ঘুমে অচেতন, নিড়ানি পাশে পড়ে আছে, ফুল-জড়ানো আগাছা নিড়ানোও হয়নি সব। বসন্তের গান। সে কথা ভেবে কী হবে? শরতেরও তো গান আছে। যখন অস্ত সূর্যের রশ্মিদীপ্তি মেঘেরা মুমূর্ষু দিনটিতে ফুলের মতো ফুটিয়ে তোলে, উপত্যকায় ছড়িয়ে দেয় গোলাপী আভা, তখন বদ্ধ জলার বুকে মশারা তোলে বিলাপের গান শোনা যায় মেষশাবকের ডাক, ঝোঁপে, ঝিঁঝির তান, রঙিন পাখি শিস দেয় বাগানে, আকাশে রয়েছে ভাব, ভাষা ও কল্পনার সুমিত সুষমা ও গাঢ়বদ্ধতা। রঙ ও রেখা, ছবি ও গান একসঙ্গে মিশে গেছে।


'ওড অন এ গ্রীসিয়ান আর্ন' কবিতাটিতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত প্রাচীন গ্রিসের এক ভস্মাধারের গায়ে আঁকা একটি উৎসব-দৃশ্য রচিত। “কারা এঁরা, দেবতা না মানুষ? এই কুমারীই বা কারা? কারা বাঁশী বাজাচ্ছে? কিসের উল্লাস? শ্রুত সঙ্গীতে মধুর, অশ্রুত সঙ্গীত আরও মধুর (Heard melodies are sweet, but those unheard are sweeter)। বংশীবাদক। বাজাও 'তরুতলে হে তরুণ যুবক, কোনোদিন থামবে না তোমার গান, এ তরুণ পাতাও ঝরবে না। বসন্ত কোনোদিন নেবে না বিদায়। এই যজ্ঞভূমিতে কারা আসছেন? পুরোহিত চলেছেন মাল্যভূষিত ধেনু নিয়ে। কোন নদীকূলে বা সমুদ্রতীরের ক্ষুদ্র নগরী আজ জনশূন্য হল? নগরীর পথ নীরব। সুন্দর গ্রিসীয় মূর্তি, মর্মরে অঙ্কিত মানব-মানবী, বৃক্ষচ্ছায়ায় দলিত নীরব এই দৃশ্যসমূহ ভাবনার অতীত লোকে কোথায় নিয়ে যায়। এই যুগই জীর্ণ হয়ে যাবে কিন্তু নীরব সঙ্গতি তখনও থাকবে, ক্লান্ত মানুষকে বলবে— সুন্দরই সত্য; সত্যই সুন্দর পৃথিবীর মানুষ এই কথাই তোমরা জানো, আর এই কথাই তোমাদের জানবার।” 

'Beauty is truth, truth is beauty', that is all 

Ye know on earth, and all ye need to know'


কবির কাছে সত্য ও সুন্দরের বাণীবাহক হচ্ছে এই প্রাচীন গ্রীসের ভস্মাধার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে শাশ্বত অনুভবের কথা।


‘ওড অন মেলাংকলি’ হচ্ছে বিষাদ প্রশস্তি। এই বিষাদের গভীর অনুভূতি কবিকে গভীর ভাবসত্যের সন্ধান দিয়েছে। কবি বলছেন—যেয়ো না বিস্মরণী নদীতে ভেঙো না বিষণ্ণতা। ফুলের ওপর অশ্রুভরা মেঘের মতো, সবুজ পাহাড় আড়াল করা ধূপছায়ার মতো বিষাদ যদি নেমেই আসে তাকে শান্ত করা ভোরের গোলাপে বা বেলাতটে লবণাক্ত তরঙ্গ। বিষাদ থাকে রূপের সঙ্গে, রূপের আছে মৃত্যু। আনন্দ সে তর্জনী ওষ্ঠে তুলে বিদায় জানায়। প্রমোদ মন্দিরই বিষাদের বেদী, আনন্দ দ্রাক্ষা যার ফেটেছে রসনায়, পেয়েছে তার তীব্র বেদনার স্বাদ। কবি বলতে চাইছেন দুঃখে দুঃখ করে কেঁদে লাভ নেই, সুখের মধ্যে দুঃখ লুকিয়ে আছে, উভয়ে অবিচ্ছিন্ন। ‘সুখ দুঃখ দুটি ভাই। সুখের লাগিয়া যে করে পীরিতি, দুঃখ যায় তারি ঠাই'। (চণ্ডীদাস)


এই কবিতাগুলি ছাড়াও কবির 'ওড টু সাইকি' (Ode to Psyche) কবিতাটিতে কবিমানসীর প্রতি প্রশস্তি ধ্বনিত হয়েছে। 'ওড টু ইন্‌ডোলেন্স' (Ode to Indolence) কবিতাটিতে উচ্চারিত হয়েছে আলস্যের প্রতি বন্দনা প্রশস্তি। কবিতাগুলি সমকক্ষতায় পূর্বোক্ত কবিতাগুলির সমানধর্মী না হলেও কবি-সৃষ্ট 'ওড’ মালিকায় এগুলিও এক একটি উজ্জ্বল রত্ন।


কবির জীবনের আপন অনুভব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার রসে সিঞ্চিত করে তিনি আপন হৃদয় অভিজ্ঞতার তাপেই এই 'ওড'গুলি সৃষ্টি করেছেন। অবিনশ্বর সুন্দরের স্বপ্ন যেমন মূর্ত হয়েছে 'গ্রীসিয়ান আর্ন’-এ, 'নাইটিঙ্গেল'-এ প্রকাশ পেয়েছে অধরা সৌন্দর্যকে ধরার আকুতি। কবির ছোটো এ জীবনে অনেক কিছু না পাওয়ার দুঃখ এবং অসাধ্য অসুখের যন্ত্রণা যেন লাল হয়ে তার 'মেলাংকলি', 'অটাম', 'সাইকি' প্রভৃতি ওড কবিতায় ধরা পড়েছে। কবির মানসিকতার সবকয়টি বৈশিষ্ট্য—তাঁর ইন্দ্রিয়ানুভূতি, সৌন্দর্য-চেতনা, গ্রিক সাহিত্য ও শিল্পপ্রীতি এবং জীবন রস-রসিকতা এই কবিতাগুলির মধ্যে অদ্বয় সম্বন্ধে যুক্ত হয়েছে। ভাব, ভাষা ও ছন্দ মিলে হয়ে উঠেছে যুক্ত ত্রিবেণী। তৎকালে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘এডিনবরা রিভিয়্যু'-তে উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছিল। লাভ করেছিল সমকালীন কবি-সমাজের সানন্দ অভিনন্দন।


এই রোমাণ্টিক যুগে উজ্জ্বল নক্ষত্র— ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কীটস প্রমুখ প্রায় সমসাময়িক কবি হলেও রোমান্টিক কাব্য গগনে পুরোধা হলেও একই সুরে কথা বলেননি। মানুষ ও প্রকৃতি তাঁদের কাব্যে প্রধান স্থান গ্রহণ করলেও, মানসিক প্রবণতা অনুযায়ী এদের প্রত্যেকের হাতে এই মানুষ ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বৈচিত্র্যময়। ও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় সিদ্ধ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনার দীপ্তিতে প্রকৃতিকে করে তুলেছেন দীপ্তিময়, প্রকৃতি বর্ণনায় এসেছে এক প্রশান্তি। কিন্তু শেলির বর্ণনায় প্রকৃতি কবির চিৎকর্ষ কবির মননের রঙে হয়ে উঠেছে রঙিন। সমাজ-সচেতনতা, মানবপ্রেম মানবমুক্তির দায়িকা শক্তি পুরাতনকে চিতায় চাপিয়ে আগামী দিনের মন্ত্রপাঠ করেছে। শেলির প্রকৃতি বিদ্রোহী, শেলির প্রকৃতি আশাবাদী। শেলি যদি হন স্ফুলিঙ্গ, কীটস হচ্ছেন স্বপ্ন ও সৌন্দর্য। কীটস স্পন্দন অনুভব ও অনুভূতিগ্রাহ্য ষড়ইন্দ্রিয় দিয়েই প্রকৃতিকে আপ্যায়িত ও বরণ করেছেন। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য রূপলোকের মধ্যে শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ-বর্ণময় প্রকৃতির মধ্যেই তিনি শুনেছেন প্রকৃতির সঙ্গীত। নিবিড় উপলব্ধির এই আনন্দই তাঁর কবিতায় ব্যঞ্জিত। কীটসের প্রশস্তিমূলক গীতিকবিতা 'ওড'-এর মধ্যেও এই মানসিকতাই ধরা পড়েছে। ওয়ার্ডওয়ার্থ সুলভ নৈতিক বা আধ্যাত্মিক ভাবনা সুলভ কাব্য-চেতনা বা শেলি সুলভ বিপ্লবী ভাবনার অগ্নি স্ফুলিঙ্গ নয়, এক সৌন্দর্য চেতনাই প্রকাশিত হয়েছে। প্রাণ ও প্রকৃতিতে বিলম্বিত যে সৌন্দর্য তাই 'ওড টু নাইটিঙ্গেল', 'ওট টু অটাম’ প্রমুখ কবিতায় ধরা পড়েছে। এ জগতের অতীত ও বর্তমান উভয়ই তাঁর কাছে সমান সুন্দর। এই সৌন্দর্য ধ্যানই তাঁকে তাঁর যুগের অন্যান্য কবি থেকে অনন্য ও বিশিষ্ট করে তুলেছে।