“অপরূপকে রূপের দ্বারা ব্যক্ত করিতে গেলে বচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করিতে হয়" | “ভাষার মধ্যে এই ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সাহিত্য প্রধানত ভাষার মধ্যে দুইটি জিনিষ মিশাইয়া থাকে, চিত্র এবং সঙ্গীত।”

“চিত্র এবং সঙ্গীত সাহিত্যের প্রধান উপকরণ।” অথবা, চিত্র দেহ ও সঙ্গীত প্রাণ।

“বস্তুতঃ বহিঃপ্রকৃতি এবং মানব চরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সঙ্গীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষা-রচিত সেই চিত্র এবং সেই গানই সাহিত্য।"


এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বজগৎ আমাদের মনের জগতে যে ছায়া ফেলে, তার সঙ্গে 'আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে' আমরা মনের মধ্যেই একটা নোতুন জগৎ সৃষ্টি করি। সেই জগতে যেমন থাকে বহির্জগতের প্রতিচ্ছায়া, তেমনি তার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে আমাদের অনুভূতি দ্বারা আয়ত্ত অথবা অভিজ্ঞতালব্ধ হৃদয়বৃত্তির বিচিত্র রস। ফলে বাইরের বিশ্ব আমাদের মনের মধ্যে হৃদয়বৃত্তির নানা রসে নানা রঙে, নানা ছাঁচে নিত্যনোতুনভাবে রূপায়িত হচ্ছে। আমাদের এই মনের জগৎকে আমরা যুগে যুগে মানব হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দিতে পারি বলেই চিরপুরাতন হয়েও এটি নিত্য নবীন রূপে সৃষ্টি হয়ে চলেছে—যদি অপরের হৃদয়ে এটিকে প্রবাহিত করে দিতে না পারি, তবে আর এর কোনো সার্থকতা থাকে না, এটি নষ্ট হয়ে যায়।


ব্যক্তি মানুষের হৃদয়ে সৃষ্ট এই জগৎকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে না পারলে অপরের হৃদয়ে তা সঞ্চারিত করা যায় না। আর এই প্রকাশের মাধ্যমই হচ্ছে সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “হৃদয়ের জগৎ আপনাকে ব্যক্ত করিবার জন্য ব্যাকুল। তাই চিরকালই মানুষের মধ্যে সাহিত্যের আবেগ।” বাইরের জগতের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ সাধন করে তাকে হৃদয়ের রসে জারিত করে আবার তাকে যথাযোগ্যভাবে প্রকাশের মধ্য দিয়েই উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব। অথচ দু'টি কাজের কোনোটিই সহজসাধ্য নয়। একদিকে নিজের কল্পনা-সচেতন হৃদয়কে বিশ্বের সুদূর সীমা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়ে আবার তাকে প্রতিফলিত করতে হবে নিজের মনের মুকুরে, অপরদিকে মনের মধ্যে সৃষ্ট এই নোতুন জগৎকে প্রকাশ করতে হবে এমনভাবে যাতে তা অপরের হৃদয়ের নিকটও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। একের হৃদয়-ভাব অপরের হৃদয়ে উদ্ভিক্ত করার জন্য কিছু সাজ-সজ্জা, কিছুটা কলা-কৌশলের প্রয়োজন। পুরুষের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম চলাবার পক্ষে শাদামাটা আটপৌরে পোশাক যথেষ্ট বিবেচিত হলেও নারীর সম্ভ্রম লজ্জা আদি বজায় রাখবার প্রয়োজনে তাকে কিছুটা সাজ-সজ্জা বেশভূষা করতেই হয়। পুরুষ মানুষের অফিসের কাজ, তাতে বাহুল্য নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু নারীর কাজ—তাকে হৃদয় দিতে হয় এবং হৃদয় আকর্ষণ করতে হয় : কাজেই পুরুষের মতো শুধু যথাযথ হলেই চলে না, তাকে সুন্দর হতে হয় এবং এই কারণেই তাদের ব্যবহারে অনেক আবরণ, আভাস-ইঙ্গিত চাই। সাহিত্যের ভূমিকাও রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর মতোই–তারো চাই কিছুটা সাজ-সজ্জা, কিছুটা আভাস-ইঙ্গিত।


হৃদয়ের কথাকে অপরের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে হলে তাকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে হয়, তার জন্য একদিকে প্রয়োজন তার বহিঃপ্রসাধন, অপরদিকে চাই অনির্বচনীয়তার ইঙ্গিত। ভাষার কারুকার্য, ছন্দ-অলঙ্কার প্রভৃতির সাহায্যেই সাহিত্যের প্রসাধনকর্ম সাধিত হয়। এই অলঙ্কারাদির সাহায্যে সজ্জিত সাহিত্য হয়ে ওঠে চিত্রধর্মী। আর সাহিত্যে অনির্বচনীয়তা, রূপকে অতিক্রম করে রূপাতীতের ইঙ্গিত বহন করবার জন্য প্রয়োজন সঙ্গীতধর্মিতার। রবীন্দ্রনাথ এই চিত্র এবং সঙ্গীত—এই দুটিকেই বলেছেন সাহিত্যের প্রধান উপকরণ।


দর্শন-বিজ্ঞান বিষয়ের আলোচনা যদি নিরলঙ্কার হয়, তবে কোনো ক্ষতি নেই; কারণ দর্শন-বিজ্ঞানের বক্তব্য স্পষ্ট উচ্চারিত—এটি জ্ঞানের কথা, সরাসরি পাঠকের মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। কিন্তু সাহিত্যের বক্তব্য কখনো বাচ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; কারণ অপরূপকে যদি রূপের দ্বারা প্রস্ফুট করতে হয়, তাহলে বচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করতে হয়। নারীর দৈহিক রূপই তার নয়, তার অতিরিক্ত থাকে স্ত্রী ও ধী, যাকে অনুভূতির দ্বারাই শুধু গ্রহণ করা চলে–সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনির্বচনীয়তাও অনুরূপ বিষয়। রূপবতী নারীকে অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিত করলেও তার আসল সৌন্দর্য যেমন অলঙ্কারে আবদ্ধ না থেকে তাকে অতিক্রম করে যায়, ভাষার মধ্যে তেমনি চিত্রধর্ম ও সঙ্গীতধর্ম বাচ্যকে অতিক্রম করে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করে।


বৈষুব কবি বলরাম দাসের 'দেখিবারে আখি-পাখি ধায়'—এই কথাটুকুর মধ্য দিয়ে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তাতে শুধু চিত্রটিই নয়, বক্তার ব্যাকুল দৃষ্টির আকুলতাও কী অপূর্ব রূপেই না আত্মপ্রকাশ করেছে। যে কথা শুধুমাত্র ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, উপমা রূপকাদি অলঙ্কারের সাহায্যে তা চিত্ররূপে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। চিত্র ছাড়াও সাহিত্যের অপর একটি প্রধান উপাদান তার সঙ্গীতধর্ম। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “যাহা কোনোমতে বলিবার জো নাই এই সঙ্গীত দিয়াই তাহা বলা চলে। অর্থবিশ্লেষ করিয়া দেখিলে যে কথাটা যৎসামান্য এই সঙ্গীতের দ্বারাই তাহা অসামান্য হইয়া উঠে। কথার মধ্যে বেদনা এই সঙ্গীতই সঞ্চার করিয়া দেয়।" রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়— হাত দিয়া দ্বার খুলবো না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো'—এই সঙ্গীতের সুরই ভাব-ব্যাকুল হৃদয়ের দ্বার উন্মোচনের প্রধান চাবিকাঠি। কবি চিত্রের সাহায্যে যদি ভাবকে রূপায়িত করেন, তবে সঙ্গীত তাকে দান করে গতি। চিত্রকে যদি ভাবা যায় কাব্যের দেহ, তবে সঙ্গীতকে বলা যেতে পারে কাব্যের প্রাণ।