কবি বাণভট্টের পরিচয় এবং সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর স্থান নির্ণয় করো।

পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সাহিত্যের মতোই সংস্কৃত সাহিত্যেও কাব্য মহাকাব্য এবং নাটকেরই মহোৎসব, গদ্যের স্থান বড় সংকীর্ণ। পদ্যের মহাসমুদ্রে গদ্য যেন দ্বীপসমষ্টিমাত্র। সংস্কৃত সাহিত্যে দ্বীপময় ভূভাগে যে তিনজন মনীষী সদর্পে বিচরণ করবার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের অন্যতম এবং সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ কবি বাণভট্ট। গদ্য-সাহিত্যের সাম্রাজ্যে বাণের ভূমিকা রাজাধিরাজের মতোই এবং সেটি সর্বতোভাবেই। যেখানে আমরা ভাস-কালিদাসাদি মহাকবিগণের সাহিত্যকীর্তি ছাড়া শুধু নামমাত্র অবগত আছি, বাণভট্ট সেখানে সবিস্তারে আত্মকাহিনী বর্ণনা করেছেন। সে কাহিনী আত্মজীবনীর মতোই উপাদেয়, তা আত্মগৌরবে স্ফীতকলেবর নয়, আত্মজীবনের স্খলন-পতন-ত্রুটিগুলিও তাতে সমভাবেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে বলে বস্তুতই সেটি আত্মজীবনীর মতোই উপাদেয়।


‘হর্ষচরিতে’ বাণভট্টের আত্মজীবনী : বাণভট্ট রচিত দু'খানি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়, একখানি ‘হর্ষচরিত’, অপরটি 'কাদম্বরী'। 'হর্ষচরিত' কাব্যের প্রথম দুটি 'উচ্ছ্বাস' এবং তৃতীয়টিরও কিছুটা অংশ জুড়ে বাণভট্ট তাঁর আদিপুরুষের কাহিনী থেকে আরম্ভ করে ক্রমপরম্পরায় কয়েকজন কৃতবিদ্য পূর্বপুরুষের কাহিনী বর্ণনা করে অবশেষে বাণ নিজের কথা বলেছেন। বাণের পিতামহ অসংখ্য যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা মহাত্মা অর্থপতি। অর্থপতির বারোজন পুত্রের মধ্যে অষ্টম পুত্র চিত্রভানু ছিলেন বাণের পিতা। শোণ নদের পশ্চিমতীরে তাঁদের আদি ভদ্রাসন ‘প্রীতিকূট’, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘ব্রাহ্মণবিধান' নামক গ্রাম, এখানেই আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় বৃদ্ধ পিতামাতার শেষ বয়সের সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করেন বাণভট্ট। সম্ভবত তাঁর জন্মকালেই মাতৃবিয়োগ হয়, পিতৃস্বসা মালতী তাঁর মায়ের অভাব পূরণ করেন। বাণের বয়স যখন চৌদ্দ, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তার বয়স তখন আশির কোঠায়।


অভিভাবকহীন বাণ স্বেচ্ছাচারী, দুর্দান্ত এবং অবিনীত হয়ে উঠতে লাগলেন। অদ্ভুত তাঁর সঙ্গীসাথী—এদের মধ্যে ছিল চারণ, ওঝা, পুঁথি-পাঠক, কথক, স্যাকরা, চিত্রশিল্পী, গায়ক, বাদ্যকর, নর্তক, অভিনেতা, জুয়াড়ি প্রভৃতি বিচিত্র পেশার নানা নারী-পুরুষ। এই দল নিয়ে একদিন বাণ বেরিয়ে পড়লেন দেশ-দেশান্তর দেখার কৌতূহলে। এরই মধ্যে বহু জ্ঞানী-গুণীর সাহচর্য পেয়েছেন, অনেক বিদ্যা লাভ করেছেন, বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। একসময় তিনি ফিরে এলেন স্বগৃহে ব্রাহ্মণাধিবাসে। ততদিনে তাঁর প্রতিভার খ্যাতি যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি বহু ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিও তাঁর বিরুদ্ধে নানা কথা রটনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল কোনদিক থেকে এ বিষয়ে কিন্তু তিনি একেবারে নীরব। যাহোক, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও রাজা হর্ষদেব ভ্রাতা কৃষ্ণের আগ্রহাতিশয্যে তাঁরই প্রেরিত দূতের সঙ্গে তিনি রাজদর্শনে এলেন। রাজার সঙ্গে আলাপ করে বিদায় নেবার কয়েকদিন পর গুণমুগ্ধ রাজা হর্ষদেব তাঁকে সাদরে আহ্বান করে নিয়ে তাঁকে সম্মান, অর্থ ও ক্ষমতার চরম আসনে বসিয়ে দিলেন। এখানে কয়েক বৎসর অতিবাহিত করবার পর বাণ আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ফিরে এলেন এবং তাঁদের ঐকান্তিক আগ্রহে ‘হর্ষচরিত' রচনা করেন। তাঁর অপর তথা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কাদম্বরী' কবে রচিত হয়েছিল, জানা যায়নি।


বাণ-রচিত 'হর্ষচরিত' আখ্যায়িকা কাব্য এবং 'কাদম্বরী' কথা-জাতীয় কাব্য-সাহিত্য। তাঁর আত্মজীবনী যেমন অসমাপ্ত রেখেছেন, 'হর্ষচরিত’ কাব্যটিকেও তেমনি অসমাপ্ত বলেই মনে হয়। ‘কাদম্বরী’ কাব্যটিও তিনি শেষ করতে পারেন নি, এর উত্তরার্ধ বাণভট্টের পুত্র ভূষণবাণ তথা পুলিন্দ সমাপ্ত করেছেন বলে জানা যায়। কেউ কেউ অনুমান করেন 'রত্নাবলী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’ এবং ‘নাগানন্দ' নামে যে তিনখানি গ্রন্থ রাজা হর্ষ-রচিত বলে প্রচলিত আছে, সম্ভবত সেগুলিও বাণভট্টই রচনা করে পৃষ্ঠপোষক রাজার মনস্তুষ্টিবিধানের জন্য গ্রন্থকর্তৃত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করেছেন। যাহোক্ এ বিষয়ে প্রমাণের অভাব থাকায় প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না। 'হর্ষচরিত' সমকালীন রাজা হর্ষদেবের কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও সেটি কেন অসমাপ্ত রইলো, তার কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, রাজা হর্ষবর্ধনের বৌদ্ধতোষণনীতিকে সমর্থন করতে না পেরেই বাণভট্ট গ্রন্থটি সমাপ্ত করেন নি। আবার কারও কারও মতে, অনুরূপ সমাপ্তিই হয়তো কবির ঈপ্সিত ছিল।


কাদম্বরীঃ কথাকাব্য : 'কাদম্বরী' কথা-জাতীয় সাহিত্য অর্থাৎ এর বিষয়বস্তু কবি-কল্পিত। অবশ্য কেউ কেউ অনুমান করেন, 'কাদম্বরী'তে অনেকগুলি কাহিনী পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তার কোনো কোনোটি হয়তো বীজাকারে গুণাঢ্য-রচিত ‘বৃহৎকথা’য় বর্তমান ছিল। থাক্ বা না থাক্ তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ বাণভট্ট যে কল্পনাকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে ঋণ থাকলেও কুশলতার লাঘব হয় না। সংস্কৃত সাহিত্যে 'কাদম্বরী' এক অনন্য সৃষ্টি। একেই তো সংস্কৃত কথা-জাতীয় সাহিত্যের অতিমাত্র স্বল্পতা তার অন্যতম দুর্বলতা বলে পরিগণিত হয়। সেখানে কাদম্বরীর মতো এমন বিরাট বিশাল ব্যাপার – একটি মাত্র কাহিনী নয়, কাহিনীর পর কাহিনী, যেন কাহিনীর লহর চলেছে। এ হেন 'কাদম্বরী'র অন্তর্ভুক্ত সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যকে মহাধনে ধনী করে তুলেছে। একালে যাকে বলা হয়, Fiction বা Novel অর্থাৎ উপন্যাস, সেকালের বিচারে 'কাদম্বরী'কে সেই মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচের কারণ থাকে না।


‘হর্ষচরিতে’ চিত্রধর্মিতা : কাহিনীর বিস্তার, এক ঘটনার সঙ্গে অপর ঘটনাকে টানাপোড়েনের মতো করে জড়িয়ে নিয়ে তাকে সমগ্রতা দান, অসংখ্য চরিত্র সৃষ্টি করে তাদের প্রত্যেকের প্রতি মনোনিবেশ প্রভৃতি বহুগুণের সমন্বয়েই 'কাদম্বরী' গড়ে উঠলেও তার সর্বপ্রধান সম্পদ-রূপে বিবেচিত হয় চিত্রধর্ম। 'কাদম্বরী একটি চিত্রশালা'— এটি প্রায় প্রবাদবাক্যতুল্য মর্যাদা অর্জন করায় বাণভট্টের অপর কাব্য 'হর্ষচরিতে'র প্রতি যে কিছুটা অবিচার হয়নি এমন কথা বলা চলে না। সত্য বটে, নানাগুণে বিভূষিত 'কাদম্বরী'র সঙ্গে ‘হর্ষচরিত' হয়তো তুলিত হবার যোগ্য নয়, কিন্তু বৃহত্তর সংস্কৃত সাহিত্যের পটভূমিকায় রেখে যখন বিচার করা যায়, তখন ‘হর্ষচরিত'ই কি উপেক্ষার যোগ্য বলে মনে হবে? চিত্রসম্পদ কি ‘হর্ষচরিতে' অনুপস্থিত? ‘হর্ষচরিতে’ প্রদত্ত একটি গ্রামের চিত্র–“গ্রামপ্রান্তে সযত্নেরোপিত ইক্ষুক্ষেত্রগুলি শ্যামায়মান হয়ে উঠেছে। দূরে দূরে অবস্থিত বাড়িগুলির ফাঁকে ফাঁকে স্নিগ্ধ ফণীমনসা এবং হিজলগাছের বেড়া তাদের পাশে সকণ্টক করঞ্জের দ্বারা দুষ্প্রবেশ্য বেষ্টনী। মধ্যে গৃহবাটিকার গুল্মগুচ্ছে রয়েছে উরূবুক, বচ, বঙ্গক, সুরণ (ওল/মান), শিগ্রু (সজনে?), গ্রন্থিপূর্ণ, গোধুক এবং গমুৎ ঘাস। সেখানে উঁচু কাঠের মাচায় ঝুলছে লাউ— তা বিস্তার করছে ছায়া; মাচায় খদির কাঠের খোঁটায় ঝুলছে বাদুড়ের দল, তার পাশে ফলন্ত ডুমুরের শোভা–কখনো কখনো দূর কুটির থেকে ভেসে আসে মোরগের ডাক।”


হর্ষচরিত – একমাত্র আখ্যায়িকা কাব্য : কাশ্মীরীয় কবি কলহণের ‘রাজতরঙ্গিনী'কেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত একমাত্র ঐতিহাসিক কাব্যের মর্যাদা দেওয়া হলেও তার পূর্বে একমাত্র বাণভট্টই সমকালীন চরিত্র এবং কাহিনী অবলম্বন করে কাব্য রচনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতে খাঁটি ‘আখ্যায়িকা কাব্য’ বলতে 'হর্ষচরিত'কেই বোঝায়। তবে বাণভট্ট ইতিহাস রচনা করেন নি, ইতিহাসকে অবলম্বন করে কাব্য রচনা করেছেন—'হর্ষচরিত'-বিচারে এই তথ্যটি বিস্মৃত হলে চলবে না। কাব্যে তত্ত্ব কিংবা তথ্যকে পুঞ্জীভূত না করে বাণভট্ট বরং যথেষ্ট সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়ে অনেকটা সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন। তবে ইতিহাস-বিষয়ে ভারতীয়দের বিমুখতা একালের মতো সেকালেও যথেষ্টই ছিল। এ বিষয়ে ড. দে বলেন, “The reproach that India had little history sense is not perhaps entirely just, but India was little interested in historical incident as such, and never took seriously to chronolising, much less to what is known as history in mod ern times.... It would not be proper, therefore, to attach the qualification historical' to what is Messentially a 'kavya.' কাজেই কাব্যের বিচারে ‘হর্ষচরিত’ উপেক্ষণীয় নয়।


কাদম্বরীর শ্রেষ্ঠত্ব : বাণভট্টের সর্বাধিক প্রশংসিত কাব্য অবশ্যই 'কাদম্বরী'। 'কাদম্বরী'র কাহিনী বয়নে কুশলতা এবং চিত্র-রচনার অপূর্বতার কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। পাঞ্চালী রীতির কবি বাণভট্টের ভাষা ব্যবহার বিষয়েই সমালোচকদের শুধু আপত্তি। তাঁর গদ্যকে কেউ কেউ ‘ভারতের অরণ্য' বলে অভিহিত করে মন্তব্য করেছেন যে সেখানে প্রবেশ দুঃসাধ্য। জনৈক সুধী সমালোচক ‘কাদম্বরী' সম্বন্ধে বলেন, “বাণের ভাষার দুর্বোধ্যতা ভেদ করে তাঁর কাব্যজগতে প্রবেশ করতে পারলে তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও বর্ণনাকৌশলে মুগ্ধ হতে হয়।...মনোভঙ্গিতে তিনি রোমান্টিক কল্পনার অধিকারী, অথচ বর্ণনায় তিনি ক্লাসিক কবির মতো পুঙ্খানুপুঙ্খ ও ঐশ্বর্যপূর্ণ ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। তাঁর সৌন্দর্যবিলাসী স্নিগ্ধ কল্পনা যদি প্রাঞ্জল ভাষায় বাণীমূর্তি লাভ করত তা হলে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রোমান্স রচয়িতাদের মধ্যে স্থান পেতেন।” অতএব সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে বাণভট্টের স্থান অনন্য।