“সাহিত্যের বিচার করিবার সময় দুইটা জিনিষ দেখিতে হয়। প্রথম, বিশ্বের উপর সাহিত্যকারের হৃদয়ের অধিকার কতখানি; দ্বিতীয়, তাহা স্থায়ী আকারে ব্যক্ত হইয়াছে কতটা।”—উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ।

“হৃদয়ের জগৎ আপনাকে ব্যক্ত করিবার জন্য ব্যাকুল। তাই চিরকালই মানুষের মধ্যে সাহিত্যের আবেগ।”- উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ।


এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বজগৎ রূপে-রসে-শব্দে-গন্ধে-স্পর্শে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর হয়ে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তে, আর তারি ছায়া পড়ছে আমাদের মনের মুকুরে। কিন্তু সেই মুকুর কাচের পিঠে লেপা পারদে তৈরি নয়, তা ব্যক্তি মানুষের মেজাজ-মর্জিতে সৃষ্ট বলেই সেই বিশ্বজগতের ছায়া বাস্তবজগতের অনুকরণ মাত্র নয়। অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তি মানুষ সেই ছায়ার জগৎকে 'আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে' নিত্য নোতুনভাবে সৃষ্টি করে চলছে। যা ছিল বস্তুবিশ্ব—সাদা-কালো ছোটো-বড়োর জগৎ, ব্যক্তি-মানুষের মনোজগতে ঠাঁই পেয়ে তা হয়ে ওঠে ব্যক্তি-জগৎ—ভালো লাগা মন্দ লাগার জগৎ। নানা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের মনের বিচিত্র রস মিশিয়ে আমরা এই যে নোতুন জগৎ সৃষ্টি করি, তাকে যদি আবার বাইরে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে না পারি, তবে তো তার কোনো মূল্য থাকে না। মনের ভিতর তার সৃষ্টির পরই তার বিলয় ঘটে। কিন্তু এই নিত্য নোতুন সৃষ্টি তো নষ্ট হবার জন্যে নয়। আমাদের হৃদয়-জগতের প্রকাশ-ব্যাকুলতাকে যথাযথভাবে রূপ দিতে পারলেই তার আর বিনাশের আশঙ্কা থাকে না। আর হৃদয় জগৎকে রূপায়িত করে তোলার একমাত্র উপায়ই হলো সাহিত্য। সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়েই আমরা তুলে ধরতে পারি বস্তুবিশ্বের সেই রূপকে, যা প্রতিনিয়ত আমাদের আন্তর্জগতে নিত্য নব নব রূপে প্রকাশিত হচ্ছে।


এই সৃষ্টি প্রক্রিয়াটি বিষয়ে 'সাহিত্যের তাৎপর্য' প্রবন্ধের লেখক রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র ‘পুরস্কার' কবিতায় কবি-নায়কের মুখ দিয়ে বলেছেন—

‘ধরণীর বুকে ধরণীর গায়/সাগরের জলে অরণ্যের ছায়,

আর একটুখানি নবীন আভায়/রঙীন করিয়া দিব।'


বিশ্বজগতের ছায়ারূপে ব্যক্তি-মানসের মাধুরী মিশ্রিত হয়ে যে কল্পজগতের সৃষ্টি হয়, তাকে রূপের মধ্য দিয়ে প্রকাশেই এর সার্থকতা এবং এই প্রকাশিত রূপটিই হলো সাহিত্য। এই সাহিত্যের আবেগ মানুষের মনোজগতে চিরকাল বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। এই সাহিত্য সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় দুটি বিষয়ের উপরই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হয়। এক, পরিদৃশ্যমান বিশ্বজগতের সঙ্গে সাহিত্যিকের মনের যোগ কতটা গভীর ও ব্যাপক এবং দুই, বিশ্বজগতের ছায়ার সঙ্গে সাহিত্যিক আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যে মনোজগৎ সৃষ্টি করেছেন তাকে কতটা সার্থকভাবে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। সোজা কথায় বলা যায়, সাহিত্যিকের বহির্জগৎকে গ্রহণ করবার ক্ষমতা এবং তাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করবার সামর্থ্যই সাহিত্যের বিচার্য বিষয়।


বহির্জগতের সঙ্গে অন্তর্জগতের তথা সাহিত্যিকের হৃদয়ের যোগ স্থাপন খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়; আবার হৃদয় দিয়ে গভীর অনুভূতির সাহায্যে যাকে গ্রহণ করা হলো, তাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করাও দুঃসাধ্য ব্যাপার—তৎসত্ত্বেও যে সাহিত্যিক উভয়কর্মে সিদ্ধকাম হয়েছেন, তাঁর সৃষ্ট রচনাই উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতি-রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। মানুষের দেহটা অতিশয় ছোটো, কিন্তু তার মনের ব্যাপ্তি অসীম, তাই বিশ্বময় তার সঞ্চরণ ঘটতে পারে। মানুষ কল্পনা করতে পারে এবং এই কল্পনার রথে চড়ে তার মন বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারে। এই কল্পনার সাহায্যেই সেই মানুষ বহু বিচিত্রতার মধ্যে ঐক্যের সন্ধান পায়, অবিশেষের মধ্য থেকে বিশেষকে আবিষ্কার করতে পারে। কবি-হৃদয়ের কল্পনা যত বেশি বিশ্বব্যাপ্তি তথা সার্বভৌমত্ব লাভ করতে পারে, তার সৃষ্ট কর্ম তত বেশি গভীরতা লাভ করে পাঠক হৃদয়ে আনন্দ সঞ্চার করে। এর ফলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ততই মানব বিশ্বের সীমা বিস্তারিত হইয়া আমাদের চিরন্তন বিহারক্ষেত্র বিপুলতা লাভ করে।"—এইটি হলো একদিক—বিশ্বজগতের সঙ্গে যোগাযোগের দিক। এরপর আসে প্রকাশের কথা।


বাইরের জগৎকে কবি আপন হৃদয়ে গ্রহণ করে তাকে নিয়ে নোতুন একটা মনোজগৎ সৃষ্টি করলেন; এবার তাকে সাহিত্যরূপে প্রকাশ করতে হবে, যা পাঠকের হৃদয়েও অনুরূপ জগতের তরূপ সৃষ্টি করতে পারে। সেই সৃষ্টি যত স্থায়ী হবে, ততই তার সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, হৃদয়ভাবের উপকরণের সাহায্যে যে মানবজগৎ অন্তরের মধ্যে সৃষ্ট হয়ে উঠছে, তাকে এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে হৃদয়ে ভাব উদ্ভিক্ত হয়, নতুবা নীরব করিত্বের মতো তা-ও এক বিষম ব্যর্থতায় পরিণত হতে বাধ্য। এখন এই হৃদয়-ভাব-উদ্রেকের নিমিত্ত নানাপ্রকার সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন—যা শুধুই কাজের জিনিস, তা একান্তভাবেই সাদামাটা হলেও চলে যেতে পারে। যেমন, অফিসের জন্য পুরুষের শাদাসিধে পোষাকেই চলতে পারে, তেমন পারিপাট্যের প্রয়োজন হয় না, বরং তা যত বাহুল্য-বর্জিত হয়, তা কাজের পক্ষে ততই সুবিধাজনক হয়। কিন্তু মেয়েদের পোশাক এমন আটপৌরে শাদাসিধে হলে চলে না, কারণ তার কাজ তো হৃদয়ের কাজ। অপরের মনে, এই হৃদয়ের ভাব উদ্ভিক্ত করবার জন্য সাজসজ্জা, কলাকৌশলের প্রয়োজন। তাই পুরুষের যথাযথ হলেও চলতে পারে, কিন্তু মেয়েদের সুন্দর হওয়া চাই, পুরুষের ব্যবহারে চাই স্পষ্টতা, কিন্তু মেয়েদের ব্যবহারে অনেক আবরণ এবং আভাস ইঙ্গিতের প্রয়োজন।


সাহিত্যের মাধ্যমে কবি-হৃদয়ের ভাবকে প্রকাশ করবার জন্যও অনুরূপ সাজসজ্জা ও আভাস-ইঙ্গিতের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু শাদামাটাভাবে মনোভাব প্রকাশই যথেষ্ট নয়, এখানে রূপের মধ্যে রূপাতীতে, বাচ্যের মধ্যে অনির্বাচনীয়তার আভাস ইঙ্গিতও প্রয়োজন। তা ছাড়া আপনাকে সুন্দরভাবে প্রকাশিত করবার জন্য সাহিত্যকেও ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার প্রভৃতির সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। দর্শন-বিজ্ঞানের ভাষা নিরলঙ্কৃত শাদাসিধে হলেই চলে, কারণ সেখানে বাচ্যার্থেরই প্রাধান্য। কিন্তু সাহিত্যে বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে যেতে হয় বলে ভাষায় দুটি বস্তুর মিশ্রণ ঘটাতে হয়, তার একটি চিত্র, অপরটি সঙ্গীত। প্রথমটি সৌন্দর্য সৃষ্টির উপাদান, অপরটি সীমাতীতের ইঙ্গিত দান করে। উভয়ের সমাহারে সাহিত্য সার্থকতামণ্ডিত হয়।