বাংলা সাহিত্যে ভবভূতির প্রভাব | উত্তররামচরিতে ভবভূতির মৌলিকতা

ভবভূতির পরিচয় সম্বন্ধে কি জানতে পারা যায়?

ভবভূতি তাঁর প্রথম নাটকে বিস্তৃততর ভাবে যে আত্মপরিচয় দান করেছেন, তা থেকে জানতে পারা যায় যে কবির পূর্বপুরুষরা থাকতেন দক্ষিণাপথের পদ্মপুর নামক নগরে। সেখানকার কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় শাখার নিষ্ঠাবান যাগযজ্ঞাদিতে রত ব্রাহ্মণ বংশে ভবভূতির জন্ম। এই বংশের বাজপেয়যাজী মহাকবি ভট্টগোপালের পঞ্চম পৌত্র পবিত্রকীর্তি নীলকন্ঠের আত্মসভূত ‘শ্রীকণ্ঠ পদলাঞ্ছনো ভবভূতিনাম' কবি আবির্ভূত হন। ভবভূতির মাতার নাম জাতুকর্ণী। অনেকের অনুমান ভবভূতির পিতৃদত্ত নাম 'শ্রীকণ্ঠ' পরে তিনি 'ভবভূতি' নামে পরিচিত হন। কারো মতে 'ভবভূতি’ তাঁর উপাধি, কেউ আবার 'ভবভূতি'-ই কবির প্রকৃতনাম বলে অনুমান করেন। তবে বীররাঘর, জগন্ধর, ত্রিপুরারি, ঘনশ্যাম প্রভৃতি টীকাকার ‘শ্রীকণ্ঠ'-ই পরে ভবভূতি নামে পরিচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তবে পরবর্তীকালে যে-সকল কোষগ্রন্থ কিম্বা অলংকারগ্রন্থে কবির রচনা থেকে দৃষ্টাত্ত উদ্ধৃত হয়েছে, সর্বত্রই কবির ‘ভবভূতি' ভিন্ন অন্য কোনো নামের উল্লেখ নেই।



বাংলা সাহিত্যে ভবভূতির প্রভাব সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মহাকবি কালিদাসের মতো কবি ভবভূতিও বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল স্রষ্টাদের রচনায় ভবভূতির প্রসঙ্গ এবং প্রভাব অস্বীকার্য নয়। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্ৰ, কবি রবীন্দ্রনাথ, বহুমুখী প্রতিভাধর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বহু লেখকের রচনায় ভবভূতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এরা প্রায় সকলেই ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত 'কেই আলোচ্য বিষয় বা অবলম্বন করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাসে’র কিছু অংশকে ভবভূতির রচনার স্বচ্ছন্ন ও সংক্ষেপিত বঙ্গানুবাদ বা ভাবানুবাদ বললেও দোষ হয় না। বিদ্যাসাগর মহাশয় 'সীতার বনবাস' গ্রন্থের 'বিজ্ঞাপনে' লিখেছেন – 'এই পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের অধিকাংশ ভবভূতি-প্রণীত উত্তরচরিত নাটকের প্রথম অঙ্ক হইতে পরিগৃহীত। অবশিষ্ট পরিচ্ছেদ সকল পুস্তকবিশেষ পরিসূচীত নহে, রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বন পূর্বক সংকলিত হইয়াছে। পরবর্তীকালে 'সীতা' নামধেয় একাধিক নাটকেও উত্তররামচরিতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।


'উত্তররামচরিত' মূল থেকে কতটা পৃথক সৃষ্টি আলোচনা করো, উত্তররামচরিতে ভবভূতির মৌলিকতা

ভবভূতিকে কোনো কোনো সমালোচক মহাকবি আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ভাব-ভাষা-কল্পনা-বৈদগ্ধ্যের প্রতি মুগ্ধ হয়েই যে এই আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভবভূতির নাট্যত্রয়ের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন উত্তররামচরিতের বিষয়স্তু বাল্মীকি রামায়ণ থেকে গৃহীত হলেও কবি এখানে কাহিনী উপস্থাপনা, পরিবেশ রচনা, চরিত্রসৃষ্টি এমনকি কাহিনীর পরিণতিতেও মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথমত যে রামচন্দ্র বাল্মীকি রামায়ণের মুখ্যচরিত্র সেই রামচন্দ্রই উত্তররামচরিতের নায়ক কিন্তু তা সত্ত্বেও দুটি চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য লক্ষিত হয়। বাল্মীকির রামচন্দ্র শৌর্যে বীর্যে পরাক্রমে ব্যক্তিত্বে অটল, স্থিতপ্রজ্ঞ দেবকল্প ব্যক্তি। কিন্তু ভবভূতির রামচন্দ্র কারুণ্যের অবতার, বড় বেশি আবেগ বিহ্বল। রামায়ণে রামসীতার বিচ্ছেদ ঘটেছে কিন্তু উত্তররামচরিতের কাহিনী মিলনান্তক। সীতাকে পৌরজনের সম্মতিতে রামচন্দ্র গ্রহণ করলেন এবং বাল্মীকির সঙ্গে লব এবং কুশ পুত্রদ্বয় রামের কাছে এলে রামচন্দ্র পত্নী এবং পুত্রদের সঙ্গে মিলিত হলেন। এই মিলনান্তক পরিণতি যে ভবভূতির অভিনবত্বের অন্যতম স্বাক্ষর একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য।