'ধ্বনি' প্রবন্ধের বিষয়বস্তু' | ভারতীয় আলঙ্কারিকদের মতে 'অলঙ্কার' থেকে 'রস' পর্যন্ত বিভিন্ন পরিচয়।

আদিকবি বাল্মীকি ক্রৌঞ্চমিথুনের শোকে অভিভূত হয়ে নিষাদের প্রতি অকস্মাৎ যে অভিশাপ বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, তার পরমুহূর্তেই তাঁর মনে হয়েছিল 'কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া'। তিনি শিষ্যকে বলেছিলেন, পাদবদ্ধ সমাক্ষর তন্ত্রীলয়যুক্ত এই রচনা শোক-হেতু উৎপন্ন বলেই ‘শ্লোক' নামে পরিচিত হবে। কিন্তু এই যে রচনা, কবিমনের সৃষ্টি—যাকে বাল্মীকি বলেছিলেন 'কিমিদস্'-এর স্বরূপ আলোচনাতেই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে ‘অলঙ্কারশাস্ত্রে’র উৎপত্তি ঘটে। এর মূল উপপাদ্য—কাব্যের কাব্যত্ব কোথায় অথবা কাব্যের আত্মা কী তারই স্বরুপ-উদ্ঘাটন। এ-বিষয় নিয়ে অতি প্রাচীনকাল থেকেই আলঙ্কারিকদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেওয়াতে কালে কালে বহু মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বপ্রথম আদি আলঙ্কারিক আচার্য ভরত তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র' নামক গ্রন্থে 'রস'-কেই ‘সাহিত্য’-বৃক্ষের বীজ বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বশেষ মীমাংসায়, এবং 'সাহিত্যদর্পণ'-কার আচার্য বিশ্বনাথও 'রস'কেই কাব্যের আত্মা বলে নির্দেশ করেছেন। এ বিষয়ে মধ্যবর্তী পর্যায়ের আলঙ্কারিকদের অভিমতগুলিও অবশ্য বিচার্যরূপে পরিগণিত হয়।


সপ্তম শতকের আলঙ্কারিক ভামহ তাঁর 'কাব্যালঙ্কার’ গ্রন্থে বলেন ‘শব্দার্থো সহিতৌ কাব্যম্'—অর্থাৎ শব্দ ও অর্থের সহযোগে কাব্য গড়ে উঠে। তিনি বলেন, অনলঙ্কৃত প্রেয়সীবদনও যেমন শোভন হয় না, অনলঙ্কৃতও হয় না তেমনি কাব্য অর্থাৎ অলঙ্কারযোগেই কাব্যের কাব্যত্ব। কাব্য-দর্শনে দেহাত্মবাদীরা মনে করেন, শব্দ ও অর্থ ছাড়া কাব্যের স্বতন্ত্র আত্মা নেই, তবে শব্দ ও অর্থকে সাজিয়ে দিতে হবে। এখন এই সাজিয়ে দেওয়াটাই অলঙ্কার। বামন বলেন, 'কাবাং গ্রাহামলষ্কারাৎ'—একমাত্র অলঙ্কারের জন্যই কাব্য গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। লোকায়তবাদীরাও মনে করেন যে, কাব্যের আস্বাদন এবং শব্দ ও অর্থের আস্বাদনে কোনো পার্থক্য নেই। আবার এর বিরুদ্ধবাদী সমালোচকরা দেখিয়েছেন যে, অনেক উৎকৃষ্ট কাব্যেই কোনো অলঙ্কার নেই। পক্ষান্তরে ‘সাহিত্যদর্পণ’–কার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন যে, অনুপ্রাস-রূপকাদি দ্বারা অলঙ্কৃত এমন বহু বাক্য বর্তমান, যাকে কেউ কখনো ভুলেও কাব্য বলে দাবি করে না। পক্ষান্তরে অলঙ্কৃত নয়, এমন রচনাও কাব্য হতে পারে। তিনি 'কুমারসম্ভব’ কাব্যের ‘অকালবসন্তে’র একটি বর্ণনা উদ্ধার করে দেখিয়েছেন যেখানে সামান্য অনুপ্রাস ছাড়া অপর কোনো অলঙ্কার নেই, অর্থও নিরলঙ্কৃত অথচ মনোহারিত্বে যা মনকে পরিপূর্ণভাবে অধিকার করে নেয়।


বামন অলঙ্কারবাদকেই একটু সংশোধন করে আবার বলেছেন, 'রীতিরাত্মা কাব্যসা'। অর্থাৎ পদরচনায় বিশিষ্ট ভঙ্গি বা রীতিই (style) হলো কাব্যের আত্মা। এই রীতি বা style হলো অবয়বসংস্থান—পৃথিবীর বহু কবির বহু কাব্যই এই গুণে লোকরঞ্জক হয়েছে। কিন্তু অন্য আলঙ্কারিকরা দেখিয়েছেন যে, নির্দোষ অবয়বেও শুধু ভূষণ যোগ করলেই সৌন্দর্য আসে না– দেহেও নয়, কাব্যেও নয়। 'ধ্বন্যালোক' গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রমণীদেহের লাবণ্য যেমন অবয়ব সংস্থানের অতিরিক্ত অপর কিছু, তেমনি মহাকবিদের বাণীতেও এমন কিছু অতিরিক্ত বস্তু আছে, যা শব্দ নয়, অর্থ নয়, অলঙ্কার, রীতিও নয় এবং এটিই কাব্যের আত্মা। লাবণ্যের মধ্যেই যেমন রমণীদেহের সৌন্দর্য নিহিত, তার অবয়ব-সৌষম্য হয়তো বা সহায়ক হতে পারে, তেমনি কাব্যদেহেও তার আত্মার সন্ধান পাওয়া যায় দেহাতিরিক্ত সেই বস্তুতে।


বাক্যকে যা ছাড়িয়ে যায় এবং বিষয়াত্তরেরও ব্যানা দান করে যে অতিরিক্ত বস্তু, আলঙ্কারিকগণ তাকেই ‘ধ্বনি' নামে অভিহিত করে থাকেন। এই ব্যত্থিত অর্থের আলঙ্কারিক পরিভাষা হলো 'ব্যঙ্গ' বা ‘ব্যঙ্গার্থ'—ধ্বনিবাদীরা এই ‘ধ্বনি’ বা ‘ব্যঙ্গ’কেই কাব্যের আত্মারূপে স্বীকার করেন। অনেক সময় কবিদের কৌশলে অলঙ্কার এমন সুপ্রযুক্ত হয় যে, মনে হয়—এই অলঙ্কার বুঝি কাব্যকে বাচ্যার্থ অতিক্রম করে ধ্বনিতে নিয়ে গেল। এখানে বিশেষভাবে 'সমাসোত্তি' এবং 'সঙ্কর' অলঙ্কারের নাম উল্লেখ করা চলে এই সমস্ত ক্ষেত্রেও সময় সময় ব্যানাগুণ বর্তমান থাকে, অতএব ধ্বনির স্থলে অলঙ্কারের আবির্ভাব ঘটা বিচিত্র নয়। কিন্তু এ বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন যে, সমাসোত্তি অলঙ্কারে এক বস্তু দ্বারা অপর বস্তুর ব্যানা হয় এবং সঙ্করালঙ্কারে এক অলঙ্কার দিয়ে অপর অলঙ্কারের ব্যঞ্ছনা হয়; এ-জাতীয় ব্যঞ্ছনাকে কাব্যের আত্মা ধ্বনি-রূপে কখনো স্বীকার করা চলে না। ধ্বনির ব্যঞ্ছনা কাব্যের বাচ্যার্থকে বস্তু ও অলঙ্কারের অতীত এক ভিন্ন লোকে পৌঁছে দেয়।


বাচ্য এবং বক্তব্য এক হলেও যে কোনো কাব্য ধ্বনির অভাবে কাব্য-রূপে স্বীকৃতিলাভে সক্ষম হয় না এবং অপরটি ‘ধ্বনি’-যোগে উৎকৃষ্ট কাব্যরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে, তা সহজেই দৃষ্টান্ত দ্বারা বোঝানো যেতে পারে। ‘বিবাহ-প্রসঙ্গে বরের কথায় কুমারীরা লজ্জানতমুখী হলেও পুলকোগমে তাদের অন্তরের স্পৃহা সূচিত হয়', —এই ভাবটি প্রকাশ পেয়েছে নিম্নোক্ত শ্লোকটিতে—

‘কৃতে বরকথালাপে কুমাৰ্যঃ পুলকোগমৈঃ।

সূচয়ত্তি স্পৃহামন্তর্লজ্জয়াবনতাননাঃ।।


একটি সাধারণ তত্ত্ব বর্ণনামাত্র, বক্তব্যের অতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা এতে নেই, তাই কোনো কাব্যরসিকই এখানে কাব্যরসের সন্ধান পাবেন না। প্রায় অনুরূপ একটি ঘটনার বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে। মহাদেবের সঙ্গে পার্বতীর বিবাহ প্রসঙ্গ দেবর্ষি যখন হিমালয়ের নিকট উত্থাপন করেন, তখন পার্শ্বে উপবিষ্টা পার্বতী লীলাকমলের পত্রগুলি গণনা করতে লাগলেন—এই বর্ণনায় যে কাব্যত্ব পরিস্ফুট হয়েছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শ্লোকটি এরূপ—

‘এবংবাদিনি দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী।

লীলাকমলপত্রানি গণয়ামাস পার্বতী।।'


এখানে নিঃসন্দেহে শব্দার্থ বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে পূর্বরাগের লজ্জাকে বাঞ্ছিত করেছে এবং এতেই এর কাব্যত্ব পরিস্ফুট হয়েছে। অনুরূপ আরো একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা চলে। মদনভস্ম-বিষয়ে একটি কবিতায় বলা হয়েছে, 'সেই এক কুসুমায়ুধ তিন লোক জয় করেছেন—শম্ভু তার দেহ হরণ করেছেন কিন্তু বল হরণ করতে পারেন নি।' অপর একটি কবিতায় পূর্বোক্ত মদনেরই গুণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে—‘দগ্ধ হলেও কর্পূরের মতো প্রতিজনকে তার গুণ জানাচ্ছে, অবার্যবীর্য সেই কুসুমধনু মদনকে নমস্কার।' এই দুটি শ্লোকের প্রথমটিতে মদনের অচিন্ত্য শক্তির পরিচয় অর্থাৎ একটি ভাবের কথা এবং দ্বিতীয়টিতে কর্পূরের সঙ্গেই তার তুলনামাত্র প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু কোথাও বাচ্যার্থের অতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্ঝনা না থাকায়, এদের কাব্যগুণ স্বীকৃত নয়। কিন্তু মদনের একই সর্বাতিশয়ী শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছেন

‘পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী,

বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে! 

ব্যাকুলতার বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি,

অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।


তখন কবির বক্তব্য শব্দ ও অর্থেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে ব্যগ্মিত হচ্ছে যে, মানব-মনের চিরন্তন বিরহ-মিলনের মধ্যেও বর্তমান থাকে। অতএব দেখা যাচ্ছে, কাব্যের আত্মা হচ্ছে তার বাচ্য নয়, 'ব্যঞ্জনা' এবং কথা নয়, 'ধ্বনি'। প্রশ্ন হতে পারে, এই ব্যানা বা ধ্বনি কীসের? তার উত্তর, এ ব্যঞ্ঝনা রসের ব্যানা, এ ধ্বনি 'রসধ্বনি'। ধ্বনিবাদীরাই পরিণামে রসকে কাব্যের আত্মা বলে স্বীকার করেছেন। অতএব কাব্য-বিষয়ে শেষ কথা-'বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্।